-- বিজ্ঞাপন ---

এশিয়ার স্বপ্নভূমি হচ্ছে মালয়েশিয়া

0

 

কাজী আবুল মনসুর:: ইউরোপ-আমেরিকা নয়, এশিয়ার মালয়েশিয়া এখন পরিণত হচ্ছে সাধারণ মানুষের স্বপ্নের শহর। আকাশচুম্বী অট্টালিকা, নির্মল বাতাস, পথের দ্বারে অরণ্যরাজি কী নেই। অল্প সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়া আধুনিক একটি দেশে পরিণত হয়েছে। এখন মালয়েশিয়া প্রস্তুত হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোকে টেক্কা দেওয়ার জন্য। স্বপ্নের এ দেশে সারা বিশ্বেও পর্যটকরা হামলে পড়েছে। জায়গা করে নিচ্ছেন আরব বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলিমরা। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ার শত শত মানুষ মালয়েশিয়াকে বেছে নিচ্ছে নিজেদের থাকার জায়গা হিসেবে। বাদ যাচ্ছে না বাংলাদেশিরাও। কয়েক লাখ বাংলাদেশি এখন মালয়েশিয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়ছে। আধুনিক মালয়েশিয়াকে ইউরোপের সমকক্ষ করতে চীনা, ভারতীয়, মালয় ও ইউরোপীয়দের পাশাপাশি এখন বাংলাদেশি শ্রমিকরাও কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন।

আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক বলা হয় ড. মাহাথির মোহাম্মদকে। কথিত আছে ১৮৮১ সালে মালয়েশিয়ার সেলেংগার এলাকায় বিশাল অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মালয়েশিয়ার ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিশাল এলাকাজুড়ে আগুনের লেলিহান শিখা পাহাড়-পর্বত ছাড়িয়ে লোকালয় ধ্বংস করে। কাঠের বাড়িঘর আগুনে ছাই হয়ে যায়। সে ধংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে মালয়েশিয়াকে আধুনিক দেশে রূপান্তরিত করার প্রথম দায়িত্ব নেন ইয়াপ এহ লয় নামের এক ব্যক্তি। এখনো মালয়েশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তার নামটি উচ্চারণ হয়। সম্ভবত তিনি ছিলেন চীনা নাগরিক। তারপর থেকে দেশটিতে চীনাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। বর্তমান মালয়েশিয়ার এ পর্যায়ে আসার পেছনে চীনাদের ভূমিকাই শতভাগ বলা যায়। চীনের প্রযুক্তি দিয়ে মালয়েশিয়াতে একের পর এক গড়তে থাকে রাস্তা, ভবন, শপিংমলসহ নানা ঘরবাড়ি। মালয়েশিয়ার বেশ কয়েকটি বড় রাস্তার ডিজাইন ও প্রশস্ত দেখলে মনে হবে কত পরিকল্পনামাফিক তারা কাজ করে যাচ্ছে। দাবি করা হয় তাদের ১০টি রাস্তা এশিয়াখ্যাত। নতুন করে এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে। জালান রাজা লাউট, মেদান পাচার, জালান টু এইচ লি, জালান টিংকু আবদুর রহমান, জালান হেং জেবাত, জালান সুলতান ইসমাইল, জালান মকামাহ পার্সেকুতুয়ান, জালান মসজিদ ইন্ডিয়া, জালান সুলতান হিশাম উদ্দিন, জালান তুংতান চেং লক। এসব নামের পেছনে রয়েছে এক একটি ইতিহাস।

জানা গেছে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা বর্তমান মালয়েশিয়া অঞ্চলে উপনিবেশ এবং আশ্রিত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। একে ব্রিটিশ মালয় বলা হতো। ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপান ধীরে ধীরে মালয়েশিয়া দখল করতে থাকে। ১৯৪৮ সালে মালয় উপদ্বীপে অবস্থিত ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলসমূহের সমন্বয়ে মালয় ফেডারেশন গঠিত হয়; যা ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। সিঙ্গাপুরের ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং পূর্ব মালয়েশিয়ান রাজ্য ১৯৬৩ সালে ফেডারেশনে যুক্ত হয়; আর তখনই মালয়েশিয়া স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ। যার মোট আয়তন ৩,৩০,০০০ বর্গকিলোমিটার। দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুর। দক্ষিণ চীন সাগর দ্বারা দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত, পেনিনসুলার মালয়েশিয়া এবং পূর্ব মালয়েশিয়া। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রুনাই-এর সঙ্গে স্থলসীমান্ত রয়েছে মালয়েশিয়ার; এর সমুদ্র সীমান্ত রয়েছে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের সঙ্গে। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার জনসংখ্যা ৩০ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের কাঠামোতে পরিচালিত হয় মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থা। রাজা হলেন রাষ্ট্রের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। মালয়েশিয়ার সরকার ও ১৩টি অঙ্গরাজ্য সরকারের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত। সরকার এবং আইনসভার দুই কক্ষের (দেওয়ান নেগারা ও দেওয়ান রাকিয়াত) ওপর যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ন্যস্ত। বিচার বিভাগ নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন বিভাগ অপেক্ষা স্বাধীন, তবে নির্বাহী বিভাগ বিচারক নিয়োগদানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

মালয়েশিয়ার অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত মুক্ত কিন্তু রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। গত ৩০ বছরে দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে মালয়েশিয়া একটি উঠতি শিল্প উন্নত বাজার অর্থনীতি বলে বিবেচিত। বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সরকার। যদিও এই প্রভাব দিন দিন হ্্রাস পাচ্ছে। মালয়েশিয়ার অর্থনীতি মূলত মুক্তবাজার অর্থনীতি। মালয়েশিয়ার সরকারি ভাষা মালয়। প্রায় অর্ধেক সংখ্যক লোক মালয় ভাষাতে কথা বলে। সর্বজনীন ভাষা হিসেবে ব্যবহার হয় ইংরেজি। এ ছাড়া চাইনিজ, তামিল, তেলেগু, পাঞ্জাবী ও থাই ভাষাসহ প্রায় ১৩০টি ভাষা মালয়েশিয়ায় প্রচলিত। মাধ্যমিক পর্যায় থেকে ইংরেজি ভাষাতে শিক্ষা দেওয়া হয়।

এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে প্রতিযোগিতার অন্ত নেই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদ আবারও ক্ষমতায়। মাহাথির মালয়েশিয়ার উন্নয়নে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। দীর্ঘ সময় ধরে মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে মালয়েশিয়াকে আধুনিক মালয়েশিয়াতে পরিণত করেছেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীরা এরই ধারাবাহিকতায় কাজ করে যাচ্ছেন। আবারও তিনি প্রধানমন্ত্রী। কোন প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প নতুন প্রধানমন্ত্রী বাদ দেন না। জনগণ ও দেশের স্বার্থে এরা যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পিছপা হন না।

যেমন মালয়েশিয়ার চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিতার একটি প্রকল্পের নাম ‘ইস্কান্দর মালয়েশিয়া’। বিগত ২০১২ সালের টাইম ম্যাগাজিনে এই শিরোনামটি অনেক দেশের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। ২০২৫ সালকে সামনে রেখে তিনটি সিঙ্গাপুরের সমান এলাকা নিয়ে গড়ে উঠছে এ প্রকল্পটি। ২০ বছরে এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮৩ বিলিয়ন রিঙ্গিত (এক রিঙ্গিত সমান বাংলাদেশি ২০ টাকা)। অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে। মালয়েশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের জহুর বারু থেকে শুরু করে পাঁচটি বিশাল এলাকাজুড়ে ইস্কান্দার মালয়েশিয়ার কাজ চলছে।

বলা হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মালয়েশিয়ার চেহারা আরও পাল্টে যাবে। এ অঞ্চলের ইউরোপ হিসেবে বিশ্বের খাতায় নাম উঠবে এ দেশটির। আর এ লক্ষ্যে মালয়েশিয়া তার নিজস্ব গতিতে ছুটছে। মালয়েশিয়ার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা শুধু সময়ই বলে দেবে। (চলবে)

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.