--- বিজ্ঞাপন ---

বিলাতে কয়েকদিন (৪)…লন্ডনের রাস্তা কিন্তু জার্মানির দখলে

0

রেফায়াত কবির শাওন###

মহাযুদ্ধের ফলাফল যাই হোক লন্ডনের রাস্তা কিন্তু জার্মানির দখলে। বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ, ম্যান, ভক্সওয়াগন, অডি – ছোট বড় হেন জার্মান গাড়ী নেই যেটি ছুটছে না বৃটেনের রাস্তায়। বিচিত এই বৃটিশ মোটর সোসাইটিতে আমেরিকা, ইউরোপের অন্যান্য দেশ, জাপান আর হালে কোরিয়া ও ভাগ বসিয়েছে, তবে সংখ্যায় আর মানে সবাই জার্মানদের পেছনে। ছোট বেলায় তিন গোয়েন্দা বইতে পড়া লস এন্জেলেসের কাছে রকি বিচের পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডে কাজ করত দুই বিশাল দেহি ব্যাভারিয়ান। কিশোর মুসা রবিনকে কোন সন্ত্রাসী আক্রমন করতে আসলে আগলে রাখত তারা। তখন ভেবেছিলাম ব্যাভারিয়া আমেরিকার কোন জায়গা হবে হয়ত। অনেক পরে জেনেছি ব্যাভারিয়া জার্মানিতে আর এটি জনপ্রিয় কার ব্রান্ড বিএমডব্লিউর জন্মস্থান। ব্যাভারিয়া থেকেই এর নাম বিএমডব্লিউ (ব্যাভারিয়ান মোটর ওয়ার্কস)। ব্রিটনদের প্রিয় ছোট গাড়ী মিনি। অস্টিন মিনি থেকে মিনি হয়ে যাওয়া এই বিলেতি গাড়ির কোম্পানির মালিকও এখন জার্মান বিএমডব্লিউ।

সুন্দরবনে যেমন হরিণ, বানর, কুমিরের ভীড়ে বনের রাজা রয়েল বেঙল টাইগারের দেখা পাওয়া দূস্কর, তেমনি রাজার দেশ বৃটেনের রাস্তায় রাজকীয় রোলস রয়েসের দেখা পাওয়াও যায় কালে ভদ্রে। তবে বিশাল বিশাল রেন্জ রোভারদের রাস্তা কাঁপানো গতি মাঝে মাঝে জানান দেয় গাড়ীর দুনিয়ায় বৃটেন এখনও চুরান্ত পরাজিত হয়নি। Corbell of London কোম্পানির জার্মান MAN ব্র্যান্ডের বাসে চেপে কেমব্রিজ যাওয়ার পথে রাস্তার দূপাশে তাকিয়ে সত্যি মনে হল, হিটলার পরাজিত হলেও বিলেতের রাস্তার গতি নিয়ন্ত্রন করছে জার্মান গাড়িরা। এম ১১ হাইওয়ে ধরে ১০০ কিলোমিটারের রাস্তা পার হতে দুই ঘন্টাও লাগে নি। আমাদের আবাস রয়েল হলওয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হতেই Ferrari গাড়ীর শো রুম। ভেতরে বাইরে পরে আছে অসংখ্য স্পোর্টস কার। প্রতিদিন যেতে আসতে এই দৃশ্য আমাদের দেখতে হত আর অধরা সপ্নের কথা ভেবে বুক চাপড়াতাম।

বাসে উঠতেই বৃদ্ধ ড্রাইভার ভারী গলায় জানাল সবাইকে সিট বেল্ট পরে নিতে। বলে কি, ব্যাটা নিশ্চয় আগে পাইলট ছিল। তবে রাশভারী বৃদ্ধের সাথে তর্ক করার সাহস হল না। ভদ্রলোকের মত সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম। ড্রাইভার আবার জানাল, চলন্ত বাসে ভেতরে হাঁটা যাবে না। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। চলন্ত বাসের বাম্পারে ঝুলে পরাও আমাদের জন্য কোন ব্যাপার নয়। তারপরও সে অনড়, জানাল, গাড়ীতে দাঁড়ানো যাত্রি থাকলে তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। তর্ক না করে চুপচাপ বসে পরলাম। মানুষ খুন করা আমাদের দেশের বাস ড্রাইভারদের একটা খেলা, আর বোকা ইংরেজ ড্রাইভার আছে তার লাইসেন্স বাতিল হওয়ার টেনশনে।

দুঘন্টার যাত্রা পথে দু’পাশের দৃশ্য মোটামুটি একই, কিছু পর পর উঁচু নিচু টিলা। আর মাঝে মাঝে সোনালী শষ্য ক্ষেত। প্রাকৃতিক দৃশ্যের চেয়ে গাড়ি বৈচিত্রই বেশি দৃশ্যমান। তবে বৃটিশ গাড়ি বহরের একটি ব্যাপার খুব অদ্ভূত। পৃথিবী যখন চালকবিহীন গাড়ীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন লন্ডনের রাস্তায় চলা অধিকাংশ গাড়ীই চলে ম্যানুয়েল গিয়ারে। এক অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাদের এই আধুনিকতা বিমুখতার কারণ। হেসে জবাব দেন, তাঁদের গাড়ীর গিয়ারখানা ছাড়া আর সবকিছুই আধুনিক। ম্যানুয়েল গিয়ারে গাড়ী চালালে গতির উপর যেমন নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে তেমনি জ্বালানী খরচ আর পরিবেশের ক্ষতিও কম। কিছুটা রসিয়েই বললেন, আমেরিকানদের নিজেদের ইন্টেলিজেন্স বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই বলে তাদের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর উপর এত নির্ভর করতে হয়, তারা ম্যানুয়েল গাড়ি চালাতে পারে না। দেশে আমার লক্কর ঝক্কর মিতসুবিসি গাড়িখানা ম্যানুয়েল গিয়ারে চলে বলে অনেকে আমাকে ব্যাকডেটেড ভাবে, তাদের জন্য একখানা মোক্ষম জবাব পেলাম অধ্যাপকের কথায়। দশ বছর লন্ডনে প্রবাস কাটানো ছোট ভাই তান্না জানিয়েছিল বৃটেনে কেউ ম্যানুয়েল গিয়ারে গাড়ি চালাতে না পারলে তার লাইসেন্সে লিখে দেয়া হয়, সে শুধু অটো গিয়ারের চালক। এটা তাদের জন্য চরম অসম্মানের।

শুধু গাড়ীর গিয়ারের ক্ষেত্রে নয়, বৃটিশরা এখনো কয়েন বক্স টেলিফোন ব্যবহার করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাল টেলিফোন বক্সগুলো দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম, এগুলো ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাখা। পরে জানলাম এর সবগুলোই ব্যবহার উপযোগী। ওরা এমনকি চিঠিও পোস্ট বক্সে ফেলে। পত্রিকায় পড়েছি জাপানের লোকজন এখনও ক্যাসেটে গান শোনে। কারণ তাদের পুরনো টেপ রেকর্ডারগুলো এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি। আধুনিকতার নামে ভাল জিনিষ ফেলে দেওয়ার অদ্ভুত রোগ শুধু আমাদেরই আছে।

কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসে প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কক্ষ এত বেশি ঐতিহ্য আর এত কাহিনীতে ঠাসা যে কোনটা ফেলে কোনটা বলব সিদ্ধান্ত নেয়া দূস্কর। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছুলাম কুইন্স কলেজের সামনে। এই কলেজের দুই অংশের মাঝে ছোট কেম নদী। নদীর উপর বিখ্যাত মেথমেটিকাল ব্রিজ। অনেকের ধারণা্ এই ব্রিজের মুল স্থপতি বিজ্ঞানী নিউটন, আসলে এর নির্মাণ নিউটনের মৃত্যুর পরে। উইলিয়াম এথরিজ এর ডিজাইনে, জেমস এসেক্স নির্মাণ করা এই ব্রিজের বেশিষ্ট্য হল, দেখতে এটিকে বাঁকানো কাঠের সাঁকো মনে হলেও এটি আসলে তৈরি করা হয় লম্বা সোজা কাঠের টুকরো দিয়ে, নিপূণ গানিতিক দক্ষতায়। এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের কারণে এটিকে মেথমেটিকাল ব্রিজ বলা হয়।

এগিয়ে যেতে লাগলাম ক্যাম্পাসের সরু রাস্তা দিয়ে, দূপাশে শত বর্ষের পুরনো ভবন। হঠাত একটি গলিপথের শুরুতে দেখলাম তির চিন্হ দিয়ে লেখা ট্রিনিটি কলেজ। পথ ধরে এগিয়ে গেলাম। ছবি তোলার জন্য মোবাইল বের করতেই দেখলাম ফেসবুক থেকে নোটিফিকেশন এসেছে। বছর চারেক আগে আজকের এই দিনে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম এসেছেন আমার কর্মস্থল সানশাইন গ্রামার স্কুলে এক অনুষ্ঠানে। কি অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা। এই ট্রিনিটি কলেজেই পড়েছেন এই বিজ্ঞানী। চার বছরের কোর্স দুই বছরে শেষ করে তাক লাগিয়েছেন বিশ্বকে। অধ্যাপনা করেছেন এখানে আঠারো বছর। হঠাত একদিন দেশের জন্য মন কাঁদায় ফিরে গেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আমাদের দেশ এখনো স্কলার তৈরি করছে। এই ক’দিন আগেও এখানে অধ্যাপনা করে গেছে আমাদের সানশাইনেরেই দুই ছাত্র ইয়াসির, ইয়ামিন। এখন তারা নাসায় গবেষনা করছে এরোস্পেস নিয়ে। দেশে এসে একমাস পর যখন আমি এই লেখা লিখছি তখন আমার আরেক ছাত্র আশফাক হামিদ, ক্যাম্ব্রিজে শুরু করেছে তার পি এইচ ডি গবেষনা। বাংলাদেশে বসে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে ও লেভেল, এ লেভেলে World Highest পাওয়া আমার অসম্ভব প্রিয় আরেক ছাত্র ফারহান তানভীর ডাক পেয়েছে ক্যামব্রিজে তার কাজ নিযে কথা বলার জন্য। এ অসামান্য মেধাগুলি হয়ত কখনো আর দেশে ফিরে যাবে না। কিন্তু তাদের গবেষণায় উপকৃত হবে সমগ্র মানবজাতী। অদ্ভূত ভাল লাগায় মনটা ভরে গেল। মানুষ গড়ার কারিগরদের দলে থাকতে পারাটা সত্যি আনন্দের, হোক না ভূমিকাটা অতি ক্ষুদ্র।

কেম নদীতে হাঁসের সন্তরণ আর পেডেল বোটে টুরিস্টদের আনাগোনা দেখতে দেখতে কিংস কলেজের দিকে এগিয়ে গেলাম। Corpus Clock এর সামনে এসে থামলাম কিছুক্ষণের জন্য, গ্রীক পুরাণের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এই অদ্ভূত কাঁটাবিহীণ ঘড়ি, আধুনিক কেমব্রীজের এক ব্যাতিক্রম আবিস্কার। এর নির্মাণ রহস্য আর কর্ম পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা এ স্থলে সম্ভব নয়।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুপরিচিত ভবন কিংস কলেজ চ্যাপেলের কাছে আসতেই এক বৃদ্ধা আমাদের এর ইতিহাস আর সম্মানার্থে জোরে শব্দ না করার প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে দিলেন। ভেতরে ঢুকতেই অদ্ভূত শিহরণ লাগল। শতাব্দি প্রাচীন এই ভবনটি গোথিক ইংলিশ আর্কিটেকচারে তৈরি, ফেন ভল্ট ডিজাইনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। প্রতিবছর ক্রিসমাসে এখানে যে বিশেষ প্রার্থনা হয় তা সরাসরি সম্প্রচারিত হয় সারা বিশ্বে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বসে পরলাম ফুটপাথে। ঠান্ডা ফলের রস হাতে বিশ্রাম নিয়ে চুমকু দিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি, আমরা বিখ্যাত গিল্ডহলের উঠোনে বসে আছি।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.