--- বিজ্ঞাপন ---

বিলেতে কয়েকদিন …(৫) অক্সফোর্ডে

0

::রেফায়াত কবির শাওন ::

আমেরিকানরা নাকি প্রতি দশটি বাক্যের নয়টি বলে গাড়ি নিয়ে আর বৃটিশরা আবহাওয়া নিয়ে। আমার আমেরিকান বান্ধবি জেসা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাদের গাড়ি নিয়ে এরকম অস্থিরতার কারণ। জবাবে সে বলেছিল, স্ধাধীনতা যুদ্ধ আর গৃহযু্দ্ধের কষ্ট তাদেরকে স্ধাধীনচেতা করে তুলেছে। আর গাড়ী তাদের কাছে স্ধাধীনতার প্রতিক। আর বৃটিশদের আবহাওয়া নিয়ে ব্যাকুলতার কারনটি শিখতে আমাকে যেতে হয়েছিল খোদ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনেছিলাম বৃটিশ সামার আমাদের দেশের শীতের মত। তবে আসার আগে প্রবাসী বন্ধু বান্ধবরা জানিয়েছিল এ বছর বৃটেনের গ্রীস্ম মধ্যপ্রাচ্যকে হার মানায়। হালকা টি শার্ট পরে হাঁটছিলাম অক্সফোর্ডের রাস্তায়। পুরোন সব দালানে পুরোন সব কলেজে পড়ানো হয় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান। তবে অক্সফোর্ড কেমব্রিজ যেখানে যান না কেন, পাশে একটা বিশাল মার্কেট থাকবেই। বৃটিশদের ব্যবসায় বুদ্ধির কাছে সব কিছুই হার মানে। এদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও টুরিস্ট এট্রাকশন। বেড়াতে গেলে পর্য়টক যাতে গাঁটের পয়সাও কিছু খরচ করে তার ব্যবস্থা সর্বত্র।

প্রচন্ড গরমে অক্সফোর্ডের প্রান্তে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত, সকালের স্বাস্থ্য সম্মত ইংলিশ ব্রেকফাস্টের কিছুই মুখে রোচে নি। ক্ষুধা তৃষ্ঞা নিবারনে ঢুকে পড়লাম মেগডোনাল্ডসে, বার্গারের সাথে কোকাকোলা। এদেশের কোকাকোলা বড়ই স্বাদের। অসংখ্য বরফের টুকরো মেশালেও এর তৃপ্তির ঘাটতি হয় না। ঠান্ডা কোকাকোলায় চুমুক দিতে দিতে দেখি বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। বেরোতেই হাঁড় কাপানো শীতের কামড়। আধঘন্টা আগেও গরমে সেদ্ধ হচ্ছিল পুরো রাজ্য। আমাদের আজকের গাইড পোর্টসমাউথের মেয়ে সল্পবসনা এলি তার ব্যাকপ্যাক থেকে স্পোর্ট্স জ্যাকেট বের করতে করতে মুচকি হেঁসে জানাল এটাই বৃটিশ আবহাওয়া। বুঝলাম এদেশের মানুষ কেন সুযোগ পেলেই আবহাওয়ার পিন্ডি চটকায়। তড়িঘড়ি স্টারবাকে ঢুকে পরলাম। একটু আগে কোকাকোলা খেয়ে ঠান্ডা হয়েছি, এখন আবার একটু উস্ঞতার জন্য চুমুক দিতে হচ্ছে স্টারবাকের কফিতে।

গাছপালা ঘেরা একটা সরু রাস্তার একপ্রান্তে বাস থেকে নেমে হাটছিলাম আধুনিক বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। এখানকার ছাত্র – ছাত্রীরা সারা বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়। মহাত্মা গান্ধী থেকে ইন্দিরা গান্ধী, আর সাম্প্রতীক ড. মনমোহন সিং – ভারতের নেতৃত্ব দিয়েছেন আরো অনেক অক্সফোর্ড স্কলাররা। লিয়াকত আলি খান, বেনজরি ভুট্রো, আর পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট তারকা বর্তমান প্রধানমন্ত্রি ইমরান খানও অক্সফোর্ডের ছাত্র। শ্রিলংকা, থাইল্যান্ড, মালেশিয়ার নেতৃত্বেও ছিলেন অনেক অক্সফোর্ড স্কলার, সিঙ্গাপুরের কথা না হয় বাদই দিলাম, এমনকি ভুটানের রাজপরিবারের অনেক সদস্যও এখানকার ছাত্র। প্রতিবেশিদের মধ্যে আমাদের আর মায়নমারেরই কখনো অক্সফোর্ড স্কলারের প্রয়োজন হয়নি যদি হোসেন শহীদ সোহরোয়ার্দির অল্প কিছুদিনের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি হওয়াকে হিসেবে না নেই। অবশ্য অক্সফোর্ড স্কলারের কথা আসছে কেন, কোন স্কলারই যাতে রাজনীতির ধারে কাছে ঘেঁসতে না পারে সে ব্যবস্থা মোটামুটি পোক্ত। তারচেয়েও এগিয়ে এমন ব্যবস্থা হচ্ছে যেন বিশ্ববিদ্যালয় আর স্কলার তৈরিই করতে না পারে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হত, এখানকার সত্যেন বোসদের গবেষণায় ইশ্বরকণার মত আবিস্কার সম্ভব হয়েছে। এখানকার গোবিন্দ চন্দ্র দেবরা ঔপনিবেশিক শাষকদের তাদের মেধার কাছে নত হতে বাধ্য করেছিল। আজ সেই অধ্যাপকরা কোথায়? দূর্নিতিবাজ রাজনীতিকদের প্রসংশা করতে করতে গবেষণার সময় তাদের নেই।

অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসে ঢুকে প্রথমেই গেলাম বলডিয়ান কলেজে। দরজায় বেজায় ভীড় । বিখ্যাত হ্যারি পটার ছবির শুটিং হয়েছিল এই বিল্ডিয়ে তাই টুরিস্টদের প্রধান আকর্ষণও এটি। এ কলেজের ভেতর ঢুকতে হলে এ যাত্রায় আর অক্সফোর্ডের অন্য কিছু দেখা হবে না। তাই আশপাশটা একটু ঘুরে, বিশাল ঘাসের লনে ঘেরা কুইনস কলেজ পেরিয়ে একটি বনমত জায়গায় এসে পৌছুলাম। অসংখ্য চিত্রল হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে জায়গাটা জুড়ে। আরেকটু আগাতে কেয়ারী করা বিশাল ফুলের বাগান। আধুনিক বৃটেনের যতটুকু দেখেছি গাছগাছালি, ফুল আর ঘাসের কোন অভাব নেই। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পরলাম মেগডেলান কলেজে। আমাদের বুঝিয়ে দেয়া হল এখানকার শিক্ষা আর গবেষণা পদ্ধতি।

অক্সফোর্ডের পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, ক্যাম্পাসের আকার আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কোন অংশে কম নয়, হয়ত অক্সফোর্ড কেমব্রিজের মত এত বড় ঐতিহ্যের ধারক এখনও হতে পারে নি। একটু পরিচর্য়া, একটু যত্ন হয়ত এটিকেও করে তুলতে পারত টুরিস্ট এট্রাকশন। তবে শুধু অক্সফোর্ড কেমব্রিজ নয়, বিলেতের যতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গিয়েছি সবখানেই দেখেছি, লেখাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা। একদিন মাঝরাতে হাটতে হাটতে রয়েল হলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পৌঁছে দেখি পুরো ভবনটি আলোকিত। লাইব্রেরির বিভিন্ন প্রান্তে এখনও পড়ছে অনেকে। যারা পড়ছে তাদের মধ্যে সাদা ইউরোপিয়ানের চেয়ে, চাইনিজ কোরিয়ানদেরই দেখলাম সংখ্যায় বেশি। বুঝতে বাকি রইল না আগামী পৃথিবীর নেতৃত্ব কারা দেবে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিই নয়, একদিন শহরতলির রাস্তায় হাটতে হাটতে পৌঁছি এগহাম লাইব্রেরি। ছিমছাম দোতলা বিল্ডিং, ইচ্ছেমত বই পড়া যায়, বাড়িতে নিয়ে পড়া যায় যত ইচ্ছা। এসব দেশে বইয়ের সবচেয়ে বড় ক্রেতা সরকার। ভাবতে দূ:খ হল, আমার শহরে দূটো পাবলিক লাইব্রেরির একটা মৃত, আরেকটাও টিকে আছে অযত্ন, অবহেলায়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিশটি কলেজের প্রতিটিই স্বয়ংসম্পূর্ণ। শিক্ষা গবেষনায় এখনো বিশ্বে নেতৃত্ব দেয় এই প্রতিষ্ঠান। পাশ্চাত্যের অবক্ষয় নিয়ে আমাদের অনেক সমালোচনা। কিন্তু জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি পাশ্চাত্যের যে মমত্ববোধ তার কি কিয়দংশও আমাদের আছে। নোয়াম চমস্কিরা যতই সমালোচনা করুক বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যাক্তি কিন্তু তাকে জেলে পুরছে না। পত্রিকায় সত্য মিথ্যা যাই লিখুক, আইন করে নিজকে রক্ষা করতে হয় না এদের। প্রতিশোধস্পৃহায় টুকরো টুকরো করতে হয় না সাংবাদিকের মরদেহ। এই প্রাচ্য যতই অতীত গৌরবের অহংকার করুক, পাশ্চাত্যের মত জ্ঞান আর জ্ঞানীদের সম্মান করতে না শেখা পর্য়ন্ত পরাজিতই থেকে যাবে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.