--- বিজ্ঞাপন ---

টাকশাল ছিল চট্টগ্রামে

0

কাজী আবুল মনসুর ::‘চট্টগ্রামেই একসময় হাতিশালে হাতি ছিল, ঘোড়াশালে ঘোড়া, পুকুর ভরা মাছ ছিল, গোলা ভরা ধান।’ টাকশাল ভরা ছিল টাকা। আর এ টাকার লোভেই বিদেশী বণিকরা একে একে ছুটে আসে চট্টগ্রামে। কেউ এ জনপদকে উন্নয়ন করলেও ইংরেজ ছিল লুটেরার দলে। চট্টগ্রাম থেকেই তারা লুটে নিয়ে যায় কোটি কোটি টাকা। যে টাকার কোন হিসেব নেই। নানা অজুহাতে টাকা লুটপাট ছিল ইংরেজ শাসকদের প্রধান কাজ। তবে চট্টগ্রামকে সমৃদ্ধশালী করেছে সুলতানরা। বিভিন্ন সুলতান চট্টগ্রাম অধিকার করে এখানে গড়েছে নানা স্থাপনা। গড়েছে টাকশাল। প্রচার করেছেন মুদ্রা।
ঐতিহাসিকদের বর্ননায় চট্টগ্রাম একটি প্রাচীন দেশ বলেই কথিত আছে। সমৃদ্ধশালী এ দেশের উপর নজর পড়ে অনেকের। সমুদ্র-নদী পরিবেষ্টিত দেশটির আবিস্কারে অনেকে এখানে আসেন। এ দেশের সৌর্ন্দযে মুগ্ধ হয়ে থেকে যান বছরের পর বছর। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড নানা ইতিহাস বহন করে চলেছে। সীতাকুন্ডের পাহাড়ে প্রাচীন যুগের সভ্যতার নিদর্শন স্বরূপ প্রস্তর যুগের হাতিয়ার ‘কৃপান’ আবিস্কৃত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়। লন্ডনের বৃটিশ মিউজিয়ামে এখনও সেই কৃপান রয়েছে বলে জনশ্র“তি আছে। তবে ইংরেজরা এখান থেকে এটি নিয়ে গেছে কিনা তা বলাবাহুল্য। এখন থেকে ১০/১২ হাজার বছর আগে দক্ষিণ আরবের জনগোষ্টি এ অঞ্চলে ছিল বলে ঐতিহাসিক সূত্র জানায়। আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস ‘রাজেয়াং’ সূত্রে জানা যায়, খৃষ্টিয় দ্বিতীয় দশকের মধ্যভাগে চন্দ্রসূর্য নামক মগধের এক সামন্ত আদিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ভূখন্ড চট্টগ্রাম আরাকান অধিকার করে একটি রাজ্য স্থাপন করেন এবং তিনি সেখানকার রাজা হন। এরপর থেকে একের পর এক রাজা চট্টগ্রামে শাসন করেন। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী রাজা ও উপজাতিরা তাদের ধর্মও প্রচার করেন। চট্টগ্রাম শাসনে আরাকানীরাও পিছিয়ে ছিল না। চতুর্দশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত কোন না কোনভাবে আরাকান রাজ চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রনে রাখেন।

চট্টগ্রামে সুলতানদের প্রবেশ ঘটে ১৩৪০ খৃষ্টাব্দের দিকে। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন সোনার গাঁ রাজ্যের সুলতান ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ্র সেনাপতি কদল খাঁ গাজি বা কদর খাঁ সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম অধিকারকরত সোনার গাঁ রাজ্যভুক্ত করেন। বিজিত চট্টগ্রামের শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল শায়দা নামক জনৈক দরবেশকে। ভন্ড দরবেশ শায়দা বিদ্রোহী হয়ে সুলতান ফখরউদ্দিন শাহ্র প্রতিনিধিরূপে চট্টগ্রামে অবস্থানকারী তাঁর এক পুত্রকে হত্যা করে। তাতে জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়ে শায়দাকে তার দরবেশ সাঙ্গপাঙ্গসহ হত্যা করে। চট্টগ্রামের ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরীর বর্ননা থেকে পাওয়া যায়, ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে মুর পর্যটক ইবনে বতুতা সফর উপলক্ষে সোদকাওয়ান বা চট্টগ্রাম আগমন করেন। কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন, সোদকাওয়ান পশ্চিম বঙ্গের সাতগাঁও। ইবনে বতুতা সাতগাঁয়েই আসেন। কিন্তু বিষয়টি সঠিক নয়। কারণ ইবনে বতুতা যে বছর বঙ্গদেশ ভ্রমণে আসেন (৭৪৬ হিজরিতে), সে বছর গৌঁড়ের শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ সাতগাঁও টাকশাল থেকে মুদ্রা প্রচার করেন। সাতগাঁও গৌঁড়ের অধিকারভুক্ত ছিল। সুতরাং ইবনে বতুতা সোনারগাঁও স্বাধীন সুলতান ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ্র অধিকৃত সোদকাওয়ান ‘চট্টগ্রামেই’ আসেন। সুলতান ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ্ চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করিয়েছিলেন। কুমিল্লার লালমাই গিয়ে প্রসারিত এই রাস্তাটি সেখানে আজো ফখরউদ্দিনের হদ (ফখরউদ্দিনের পথ) নামে খ্যাত হয়। চট্টগ্রামে তাঁর নৌবহরের ঘাঁটি ছিল। ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ্র মৃত্যুর পর তাঁর অপর পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজিশাহ্ (১৩৫০-৫২ খ্রি.) সোনারগাঁও সুলতান হন। তাঁকে ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে হত্যা করে সুলতান শামসুদ্দিন ।ইলিয়াস শাহ্ (১৩৪২-৫৮ খ্রি.) চট্টগ্রামসহ পূর্ববঙ্গ অধিকার করে গৌড়রাজ্যভুক্তকরত সমগ্র বঙ্গদেশের প্রথম স্বাধীন সুলতান হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তাঁর সময়েই চট্টগ্রাম প্রথম সমগ্র বঙ্গদেশের বন্দররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাঁর মৃত্যুর পর তৎপুত্র সিকান্দর শাহ্ (১৩৫৯-১৪০৯ খ্রি.) গৌড়ের সুলতান হন। তাঁর সময়ে বিহারের দরবেশ শামস বলখি গৌড়ের অধিকৃত বন্দর চট্টগ্রাম থেকে জাহাজযোগে হজযাত্রা করেন।
গৌঁড়ের শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ আমলে টাকশাল ছিল। পরে ‘চাটগাঁও টাকশাল’ থেকে তৈরি গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্ প্রচারিত মুদ্রা আবি®কৃত হয়েছে। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্ তিনবার ১৪০৫, ১৪০৮, ১৪০৯ খ্রি. উপহার সামগ্রীসহ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজযোগে চীন সম্রাটের দরবারে দূত পাঠিয়েছিলেন। আবদুল হক চৌধুরী আরও লেখেন, আরাকানরাজ নরমিখলা (প্রথমবার ১৪০৪-০৬ খ্রি.) ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যচ্যুত হয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্র দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুলতান রাজা গণেশ নামক একজন প্রভাবশালী হিন্দু জমিদারকে প্রধান অমাত্য পদে নিযুক্ত করেন। গণেশ মনিব আজম শাহকে হত্যা করেন এবং মনিবপুত্র সাইফউদ্দিন হামজা শাহকে (১৪১০-১২ খ্রি.) গৌড়ের সিংহাসনে বসান। তিনি সুলতান হওয়ার পর চীন সম্রাটের কাছে তাঁর পিতার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজযোগে দূত পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আমলে চীন সম্রাট প্রেরিত দূত চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে গৌড়ে গমন করেন। কিছুদিন পর গণেশের ষড়যন্ত্রে ক্রীতদাস শিহাব উদ্দিন বায়েজিদ মনিব হামজা শাহকে হত্যা করে নিজে (১৪১২-১৪ খ্রি.) গৌড়ের সুলতান হন। বায়েজিদ শাহ জিরাফ, ঘোড়া, রেশমি বস্ত্র ইত্যাদি উপহারসহ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজযোগে চীন সম্রাটের দরবারে দূত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু অবশেষে গণেশের চক্রান্তে বায়েজিদ শাহও পদচ্যুত বা নিহত হন। এবং গণেশ দনুজমর্দন দেব নাম গ্রহণ করে প্রথমবার গৌড়ের সিংহাসনে (১৪১৪-১৫ খ্রি.) বসেন।

ওদিকে বায়েজিদ শাহর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৪১৪ খ্রি.) দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে পালিয়ে গিয়ে কয়েকমাস রাজত্ব করেন। রাজা গণেশ তাকে পরাস্ত ও হত্যা করেন। রাজা গণেশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাধক শেখ নূর কুতুবে আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীকে গৌড় আক্রমণ করতে আমন্ত্রণ জানান। তিনি গৌড় আক্রমণ করলে রাজা গণেশ দরবেশ শেখ নূর কুতুবে আলমের নিকট আত্মসমর্পণ করেন এবং জ্যেষ্ঠপুত্র যদুকে মুসলমান করে গৌড়ের সিংহাসনে বসান (প্রথমবার ১৪১৫-১৬ খ্রি.)। যদুর ইসলামি নাম হয় জালালউদ্দিন মোহাম্মদ শাহ। কিন্তু বাৎসরাধিক কালের মধ্যে নূর কুতুব আলম পরলোকগমন করলে যদুকে পদচ্যুত ও বন্দী করে গণেশ দ্বিতীয়বার (১৪১৭-১৮ খ্রি.) গৌড়ের সিংহাসনে বসেন এবং তাঁকে শুদ্ধিকরত পুনরায় হিন্দুধর্মে দীক্ষা দান করেন। রাজা গণেশ দু’বছর রাজত্ব করার পর পরলোকগমন করলে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মহেন্দ্র দেব ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের রাজা হন। তাঁর বহু মুদ্রা আবি®কৃত হয়েছে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে মহেন্দ্র দেবকে পদচ্যুত করে যদু দ্বিতীয়বার (১৪১৮-৩২ খ্রি.) গৌড়ের সুলতান হন এবং জালালউদ্দিন মোহাম্মদ শাহ্ নাম ও ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজযোগে উপহার সামগ্রীসহ চীন সম্রাটের দরবারে দূত পাঠিয়েছিলেন এবং চীন সম্রাটের প্রেরিত দূত চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে নদীপথে গৌড়ে গিয়েছিলেন। জালালউদ্দিন মোহাম্মদ শাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহ (১৪৩৩ খ্রি.) গৌড়ের সুলতান হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হলে গৌড়ে রাজা গণেশের বংশের পতন ঘটে। তখন ভূতপূর্ব ইলিয়াসশাহি বংশের এক রাজপুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহকে (১৪৩৩-৫৮ খ্রি.) খুঁজে এনে গৌড়ের সুলতান করা হয়। তাঁর রাজত্বকালে চৈনিক রাজদূত চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে নৌকাযোগে গৌড়ে গমন করেন। তিনি ১৪৩৮ এবং ১৪৩৯ খ্রিস্টাব্দে দুবার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজযোগে উপহার সামগ্রীসহ চীন সম্রাটের দরবারে দূত পাঠিয়েছিলেন। সুলতান জালালউদ্দিন মোহাম্মদ শাহই নির্বাসিত রাজা নরমিখলাকে আরাকানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে দেন। এই সময় থেকে আরাকানের বৌদ্ধ রাজারা বৌদ্ধ নামের সঙ্গে পদবি হিসেবে একটি মুসলমানি নাম গ্রহণ ও তাঁদের মুদ্রার এক পৃষ্ঠায় ফারসি অক্ষরে কলেমা এবং তাঁদের মুসলমানি নাম উৎকীর্ণ করা প্রথা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এই প্রথা ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দ অবধি ২১৫ বছর কাল সময়ে আরাকানের ১৮ জন রাজা অনুসরণ করেছিলেন। রাজা নরমিখলার মুসলমানি নাম কি ছিল সঠিকভাবে জানা না গেলেও আরাকানের বিজ্ঞ রোয়াইঙ্গা পরিবারসমূহে বংশপরম্পরায় প্রচলিত জনশ্র“তি সূত্রে জানা যায় যে নরমিখলার মুসলমানি নাম ছিল সোলায়মান খাঁ। নরমিখলা চার বছর রাজত্ব করার পর ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই মেংখেরী (আলি খাঁ ১৪৩৪-৫৯ খ্রি.) আরাকানের রাজা হন। তিনি রাজা হয়ে গৌড়ের অধীনতা ছিন্ন করে গৌড় অধিকৃত চট্টগ্রামের রামু পর্যন্ত জয় করে আরাকান রাজ্যভুক্ত করেন। সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহর মৃত্যুর পর তৎপুত্র রুকনুদ্দিন বারবক শাহ (১৪৫৯-৭৬ খ্রি.) গৌড়ের সুলতান হন। তাঁর রাজত্বকালে আরাকানরাজ বসপিয়ু (কলিমা শাহ ১৪৫৯-৮২ খ্রি.) গৌড়ের অধিকার থেকে কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ-পূর্ব তীর অবধি চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ আরাকান রাজ্যভুক্ত করে নেন। বারবক শাহ অধিকৃত উত্তর চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন মজলিশই আলা রাস্তি খাঁ। তাঁর রাজত্বকালে রাস্তি খাঁ হাটহাজারি থানার জোবরা গ্রামে ১৪৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে একখানি পাকা মসজিদ নির্মাণ ও একটি দিঘি খনন করিয়েছিলেন। ধবংসপ্রাপ্ত সে মসজিদের শিলালিপিখানি সেখানে পুনর্নিমিত মসজিদের দেয়ালে স্থাপিত আছে। তাঁর মৃত্যুর পর তৎপুত্র শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (১৪৭৬-৮০ খ্রি.) গৌড়ের সুলতান হন। তাঁর রাজত্বকালে হাটহাজারি থানা কেন্দ্রে একগম্বুজবিশিষ্ট পাকা মসজিদ নির্মিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর সিকান্দর শাহ গৌড়ের সুলতান হন (১৪৮০-৮১ খ্রি.); কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তাঁকে পদচ্যুত করে অপর এক রাজপুত্র জালালুদ্দিন ফতে শাহ (১৪৮১-৮৭ খ্রি.) গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে হাবশি অমাত্যরা ফতে শাহকে হত্যা করে অমাত্য সুলতান শাহজাদা গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন থেকে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ অবধি সাতবছর কাল চারজন হাবশি সুলতান গৌড়ে রাজত্ব করেন। এই যুগের বাংলার সুলতানদের অধিকৃত চট্টগ্রামের শাসনকেন্দ্র ছিল হাটহাজারির জোবরা গ্রামের মাইঝপট্টি এলাকায়। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে হাবশি শাসনের পতন ঘটিয়ে সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ গৌড়ের সুলতান হন। চট্টগ্রামে তাঁর আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন ত্রিপুরার মহারাজ ধন্যমাণিক্য।

উভয়ের মধ্যে ১৫১৩-১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তীব্র সংঘর্ষ হয়। ধন্যমাণিক্যের মৃত্যুর পর সমগ্র চট্টগ্রাম গৌড়ের অধিকারভুক্ত হয়। হোসেন শাহর রাজত্বকালে উত্তর চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন পরাগল খাঁ ও তৎপুত্র ছুটি খাঁ। মধ্য চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন আমির্জ্জা খাঁ। দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন খোদাবক্স খাঁ। ডক্টর আহমদ শরীফের মতে, উত্তর চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁর আদেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর সম্ভবত ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে জৈমিনী মহাভারত সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। পরাগল খাঁ পুত্র ছুটি খাঁর আদেশে কবি শ্রীকর নন্দী সম্ভবত ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ দুটি পরাগলী মহাভারত ও ছুটিখানী মহাভারত নামে সুবিখ্যাত। হাটহাজারি থানার পরাগল খাঁ ও ছুটি খাঁর দিঘি অবস্থিত। সেখানকার ছুটি খাঁর দিঘির পাড়ে হোসেনশাহি আমলে নির্মিত ছুটি খাঁর মসজিদের ধবংস¯ত’প এখনও বিদ্যমান। হোসেন শাহর মৃত্যুর পর প্রথম পুত্র নশরত শাহ (১৫১৯-৩২ খ্রি.) গৌড়ের সুলতান হন। তিনি হাটহাজারি থানার ফতেয়াবাদে চট্টগ্রামের বৃহত্তম দিঘি, মসজিদ ও প্রাসাদ নির্মাণ করান এবং হালদা নদীর পূর্ব তীরবর্তী রাউজান থানার কোতোয়ালি ঘোনা গ্রামে একটি কোতোয়ালি (দুর্গ) এবং মসজিদ নির্মাণ ও তৎসংলগ্ন দলইনগর গ্রামে একটি দিঘি খনন করান।সে দিঘিটি বিদ্যমান এবং আজো নসরত বাদশার দিঘি নামে সুবিখ্যাত। নশরত শাহর মৃত্যুর পর তৎপুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৫৩২-৩৩ খ্রি.) গৌড়ের সুলতান হন। নশরত শাহর মৃত্যুর পর ত্রিপুরারাজ বিজয়মাণিক্য স্বল্পকালের জন্য চট্টগ্রাম অধিকার করেন। কিন্তু অতি সত্বর তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু বছরের মধ্যেই ফিরোজ শাহকে হত্যা করে হোসেন শাহর দ্বিতীয় পুত্র গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ওরফে আবুল বদর (১৫৩৩-৩৮ খ্রি.) গৌড়ের সুলতান হন। তাঁর পিতা হোসেন শাহর আমলে ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে প্রথম পর্তুগিজ বণিকদের আগমন ঘটেছিল। মাহমুদ শাহর রাজত্বকালে আফগান শেরশাহ গৌড় আক্রমণ করেন। তাঁর আক্রমণে ভীত গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ পর্তুগিজ বণিকদের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থী হন। তাঁকে সামরিক সাহায্যদানের বিনিময়ে পর্তুগিজরা আনোয়ারা থানার দেয়াঙ্গে বাণিজ্যকুঠি ও গির্জা নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক আদায়ের অধিকার লাভ করেন।ইংরেজ চট্টগ্রামে শাসন শুরুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের বহুমূখী উন্নয়ন ছিল সেকালের বিশ্বব্যাপি স্বীকৃত। বিশেষ করে চট্টগ্রামের সাথে চীন-বার্মার যোগাযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে চট্টগ্রাম সমৃদ্ধ জনপদে রূপ নেয়। সুলতানি আমলে বেশ কয়েকজন রাজার টাকশাল থেকে মুদ্রা প্রচার ছিল এ অঞ্চলের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। সুলতান-মোগল আমলে চট্টগ্রামের নাম চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে তখন ইংরেজদের প্রবেশ ঘটছিল। তাদের কাছেও তখন সম্পদশালী হিসেবে চট্টগ্রামের নাম নজরে আসে। সমুদ্র-নদী-পাহাড়-হ্রদ বেষ্টিত এমন অঞ্চল বিশ্বে বিরল। ইংরেজরা চট্টগ্রামের নানা বর্ননা শুনে এবং ধন-সম্পদের লোভে চট্টগ্রামে তাদের শাসন শুরু করার পরিকল্পনা নেয়। শেষপর্যন্ত নবাব মির কাসিমের সাথে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৬০ খৃষ্টাব্দের চুক্তির শর্ত মতে চট্টগ্রামের শেষ মুসলিম শাসনকর্তা নবাব মির মোহাম্মদ রেজা খাঁ ১৭৬১ খৃষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারী ইংরেজ চীফ ভেরলস্ট এর হাতে তুলে দেয় চট্টগ্রামের শাসনবার। ## ৪.১০.১৯

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.