--- বিজ্ঞাপন ---

চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রগতিতে বড় বাধাঁ ওমেরা ফুয়েল

0

লন্ডন ভিত্তিক শিপিং বিষয়ক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ‘লয়েডস লিস্ট’ এ তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর এখন বিশ্বমানের ৬৪ তম বন্দর।  এ তালিকায় ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের স্থান ছিল ৯৫ তম, ২০১৭ সালে ৭০ তম। বিশে^ও যেসব বন্দর কন্টেনার বাণিজ্যে এগিয়ে থাকে সেগুলো নিয়ে সাধারনত র‌্যাংকিং হয়। সে হিসেবে ২০১৮ সালে ২৭ লাখ ৯৭ হাজার টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে বন্দর এগিয়েছে ৬ ধাপ। তবে বন্দরের এ ধারা ধওে রাখা কঠিন হবে যদি পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি) দ্রুত নির্মান করা না হয়। বিশ্বমানের এ র‌্যাংকিং এ প্রথমে রয়েছে চীনের সাংহাই, আর দ্বিতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের আমদানি রফতানির সিংহভাগ চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে। প্রতিবছর বাড়ছে কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর পরিমান। বিশে^ কন্টেনার বানিজ্য দ্রুত সম্প্রসারনের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে পাল্লা দিয়ে চলতে অনেক হিমসিম খেতে হয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, বন্দর চেয়ারম্যানের ক্ষমতা না বাড়া, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন হস্তক্ষেপের কারনে বন্দরের গতি স্লো হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দর ২০০৮ সালে ১০ লাখ ৬৯ হাজার টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করেছে। এ সময় বন্দরে নতুন কন্টেনার টার্মিনাল হিসেবে ‘নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল’ কাজ শুরু করে। বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনালে বেসরকারী অপারেটর নিয়োগের ফলে গত ১১ বছওে গতি ফেরে বন্দরে। গত ১১ বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ১০ লাখ কন্টেনার হ্যান্ডলিং থেকে বর্তমানে প্রায় ২৮ লাখ কন্টেনারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্দর যে গতিতে এগুচ্ছে তাতে আশ পাশের দেশগুলোর সমানে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের গতি বাড়াতে হলে এ মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার দ্রæত পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল নির্মান করা। তা না হলে বন্দরের অর্জন ধরে রাখতে পারবে না। লয়েডস এর হিসাব মতে, চট্টগ্রাম বন্দর ২০১২ সালে ৯০ তম, ২০১৪ সালে ৮৭ তম, ২০১৫ সালে ৭৬ তম, ২০১৬ সালে ৭১ এবং ২০১৮ সালে ৬৪ তম স্থান লাভ করেছে। এগিয়েছে ৬ ধাপ। অথচ বিগত ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে বন্দরের অগ্রগতি ছিল ১১ ধাপ। চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় আমাদের পাশের দেশগুলোর অবস্থা অনেকাংশে উন্নত। চীনের ২০টি বন্দও এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এ ছাড়া শ্রীলংকার কলম্বো ২৪ তম এবং ভারতের জহরলাল নেহেরু বন্দর ২৮ তম স্থানে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেনার টার্মিনাল স্থাপনে দীর্ঘসূত্রতা ও কন্টেনার রাখার জন্য বড় ধরনের জায়গার অভাবের কারনে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা বন্দরের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। যে কারনে ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত রাজ্যগুলো এখনও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য এগিয়ে আসছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামি দিনে চট্টগ্রাম বন্দরকে লযেডস এর হিসাব মানে এগুতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে দ্রæত পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের বাস্তবায়ন। প্রকল্পটি নানা জটিলতার কারনে গতি পাচ্ছে না। প্রকল্প হাতে নেয়ার পরও বছরের পর বছর ধরে দীর্ঘসূত্রতা লেগে আছে। অথচ আগামী ২০২১ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এটির মূল কাজ এখনও কার্যত শুরুই হয় নি। কাগজে কলমে কাজ শুরু হলেও দৃশ্যমান কাজের কোন অগ্রগতি নেই। বন্দরের হিসাব মতে, ২০ ভাগ কাজ হয়েছে। কিন্ত বাস্তবে মূল প্রকল্পের ডলফিন জেটির কাজে হাত দেয়া যায়নি। প্রকল্প কাজে এ ধীর গতির অন্যতম কারণ হচ্ছে, প্রকল্প এলাকায় বিদ্যমান স্থাপনা খালি করে প্রকল্পটির কাজ শুরুর জন্য এলাকাটি এখনও উপযোগী করে তোলা যায়নি। নগরীর চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেড হতে চিটাগাং বোট ক্লাবের মধ্যবর্তী জায়গায় এ কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় কয়েকটি সরকারী স্থাপনা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কাজ প্রায় সম্পন্ন হলেও একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপনা সরিয়ে নিতে গড়িমসির কারণে গোটা প্রকল্পের কাজই এখন থমকে আছে। বন্দরের পক্ষ থেকে এ প্রকল্পকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত বিধায় গুরুত্ব দিয়ে শুরু থেকেই আগে থেকে বিদ্যমান স্থাপনাসমূহ বন্দরের দেয়া বিকল্প স্থানে সরিয়ে নিতে বারংবার তাগিদ দেয়া হয়। গত ২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারী শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ হয়েছে সব মিলিয়ে মাত্র শতকরা ২০ ভাগ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে কাজের সাইট হস্তান্তর করা হলেও বিদ্যমান স্থাপনাসমূহ খালি করে দেয়ার কাজটি ঝুলে থাকে। ফলে, স্থাপনা সরানো সংক্রান্ত জটিলতার মুখে ডলফিন জেটিসহ মূল কাজ করতে তাদের বিলম্বতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বর্তমানে সেনাবাহিনী প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ বালি ভরাট, ভূমি উন্নয়ন, নতুন প্রস্তাবিত রাস্তা, বক্্র কালভার্ট নির্মাণ, কন্টেইনার জেটি, ডলফিন জেটি, ফ্লাইওভার নতুন রাস্তা নির্মাণ করছেন। প্রকল্প সাইটে বিদ্যমান কাস্টমস, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, মেরিন ফিসারিজ ও ওমেরা ফুয়েলস লিমিেিটড এর স্থাপনাসমূহ বন্দরের নিজস্ব অন্য জায়গায় স্থানান্তরের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে বেশ কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গত ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড রুমে বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে এব্যাপারে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রকৌশল) কমোডর খন্দকার আখতার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকে পিসিটি প্রকল্পটি নির্মাণ কাজ দ্রæত সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়, বাংলাদেশের আমদানী রফতানি পণ্যের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয়। বর্তমানে বন্দরের যে পরিমাণ জেটি এবং ইয়ার্ড আছে, তা দিয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোনমতে এই প্রবৃদ্ধি মোকাবেলা করা যাবে। বৈঠকে জোর দিয়ে বলা হয় যে, ২০২০ সালের শুরুতেই নতুন জেটি এবং ইয়ার্ড নির্মাণ পূর্বক তা ব্যবহারের আওতায় না নিতে পারলে চট্টগ্রাম বন্দরের তথা সমগ্র জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মারাতœকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। ডিপিপি মোতাবেক, চিটাগাং নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকার ১ হাজার ৮৬৮ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্প সমাপ্ত হলে চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেড নামক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানটি তাদের স্থাপনা সরাতে ২৪ সময় লাগবে জানালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এটা প্রকল্প মেয়াদেরও বেশী উল্লেখ করে দ্রæততম সময়ে তাদের স্থাপনা বন্দরের দেয়া বিকল্প স্থানে সরিয়ে নিতে তাগিদ দেয়। অভিযোগ উঠেছে, এ কাজটি করতে ওমেরা ফুয়েলস লি: নামক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অহেতুক সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। তাদেরকে বৈঠকে জানানোর পর দফায় দফায় চিঠি দেয়া হয়। কিন্ত গত ৭/৮ মাস হতে চলল স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার কোন পদক্ষেপ তারা গ্রহন করছে না। এ স্থাপনা না সরালে বন্দরের অগ্রগতি মূখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে খোদ বন্দরের মধ্যেই গুঞ্জন রয়েছে। এ প্রকল্পের কাজের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিআরটিসি ও বুয়েট। প্রকল্পের আওতায় ৬০০ মিটার দীর্ঘ ৩ টি বার্থ নির্মাণ, ২২০ মিটার দীর্ঘ একটি ডলফিন জেটি, ২,১২৮ বর্গমিটার কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশন শেড অন্যতম। এছাড়াও, আভ্যন্তরীন ইয়ার্ড রাস্তা, ৪২০ মিটার ফ্লাইওভার, পোর্ট অফিস বিল্ডিং, যান্ত্রিক ও মেরামত কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি, ৫০ টনের ২ টি টাগ বোট এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।
পিসিটি প্রকল্প সম্পর্কে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কর্ম কর্তকর্তা বলেন, ‘ বর্তমান সরকার কর্তৃক দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে নেয়া সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে এই পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্পটি অন্যতম। বাংলাদেশের আমদানী রফতানির ৯০ শতাংশ এ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ১৬ ভাগ যা সমগ্র দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিরই প্রতিফলন। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন কাজে শিথিলতা দেখানোর সুযোগ নেই।’ তিনি এ প্রকল্পের কাজ তরান্বিত করার উপর গুরুত্বআরোপ করেন।
নিদ্দিষ্ট সময়ে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্পটি সমাপ্ত হবে কিনা এব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোহাম্মদ জিয়াউল হকের দৃষ্টি আকর্ষন করলে তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, প্রথমত: প্রকল্পের স্থানে আগে থেকে বিদ্যমান বিভিন্ন অফিস স্থাপনা সরানোর কাজ শেষ হয়নি। দ্বিতীয়ত্ব, যেহেতু এটি একটি বিশেষায়িত প্রকল্প এর কাজের ধরণ অনুযায়ী প্রকল্পের নকশা প্রণয়নে বিলম্ব হয়েছে । তাছাড়া, এই প্রকল্পটিতে ভিন্নধর্মী কাজ রয়েছে। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থাসহ আরও জটিল কাজসমূহের সমন্বয় রয়েছে বিধায় কাজে তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবেনা। এ প্রকল্পের কাজ নিদ্দিষ্ট সময়ে সমাপ্ত হতে বিলম্বিত হবে।’ তবে তিনি কাজের মান সম্পর্কে বলেন,‘সময় একটু বেশী লাগলেও আমরা বেস্ট কোয়ালিটি কাজ করছি। শীগগীরই চীন থেকে বড় এবং অত্যাধুনিক পাইল ড্রাইভিং মেশিন আসছে। আমরা ভাল কাজ উপহার দেব।’
প্রকল্পের জায়গায় স্থাপনা সরানোর বিলম্বের বিষয়ে পিসিটি’র বন্দর কতৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘ আমরা সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে চিঠি দিয়েছি, বৈঠক করেছি। তাদেরকে বিকল্প জমি দেয়া হয়েছে। অন্তবর্তীকালীন সময়ে অফিস স্থানান্তরের জায়গাটিও দেয়া হয়েছে। বন্দরের বর্ধিত আমদানী রফতানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পিসিটি প্রকল্প দ্রæতসময়ে শেষ করার বিকল্প নাই।’
অহেতুক সময়ক্ষেপণের বিষয়টি সত্য নয় দাবী করে ওমেরা ফুয়েলস কতৃপক্ষ বলেন, ‘আমরা যতদ্রুত সম্ভব স্থাপনাসমূহ সরিয়ে নিতে পারব আশা করছি। আমরা সাদ্যমত চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি প্রকল্পের জন্য স্থানটি খালি করে দেয়া যায়।’

চট্টগ্রাম বন্দরকে আগামি দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে যত দ্রুত সম্ভব পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের নির্মান কাজ শেষ করতে হবে। যেভাবে কন্টেনার বাণিজ্য বাড়ছে তাতে কন্টেনার রাখার জায়গায় যদি না থাকে তাহলে বিশ্বমানের উপযুক্ততা লাভ করা বন্দরের অগ্রগতি থমকে যেতে পারে। আগামী দিনে লয়েডস তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও সংশ্লিষ্টরা মত ব্যক্ত করেন।### ১.১২.১৯

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.