--- বিজ্ঞাপন ---

টেকনাফ- মাথিন এর অভিশপ্ত জনপদ?

0

কাজী ফেরদৌস:

কোলকাতার ছেলে ধীরাজ ভট্টাচার্যের “যখন পুলিশ ছিলাম” বইটি পড়ে ছিলাম তখন মাত্র নবম শ্রেণির ছাত্র। সেই প্রথম টেকনাফ থানার নাম শুনেছিলাম।ধীরাজ বাবু টেকনাাফের ওসি ছিলেন বৃটিশ রাজের শেষ দিকে। তাঁর প্রেমে মজে ছিলেন এক রাখাইন সর্দার কন্যা।কিন্তু ধীরাজ বাবু বদলি হয়ে চলে গেলেন কোলকাতা।শোকে মুহ্যমান মাথিন অনাহার অর্ধাহারে মৃত্যুকেই বরন করে নিলেন। পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল রবিঠাকুর এর পোস্ট মাস্টার গল্পের মত কিছু টা। তবে তরুণ হৃদয়ে মাথিন এর বিরহ বেদনা স্পর্শ করেছিল বেশ। তখনও কক্সবাজার দেখা হয়নি, টেকনাফ দুরে থাক। চুয়াত্তর সালে প্রথম কক্সবাজার গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। উঠে ছিলাম হোটেল সাইমনে।ইন্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের হোটেল।

এখনো প্রতিযোগিতায় টিমটিম করে টিকে আছে। সিঙ্গেল রুম পাইনি তাই নীচের তলায় একটা ডবল রুম নিলাম। ভাড়া বিশ টাকা। পরদিন সকালে লালদীঘির পাড়ে দেখা হলো আর এক সহকর্মী এবিএম হাবিব এর।তিনি বয়সে আমার কিছু সিনিয়র ছিলেন। গজল গেয়ে বেশ নাম করেছিলেন তখন।তিনি থাকার জন্য রুম খুঁজছিলেন। বললাম রুমের দরকার হবে না। চলেন আমার রুমে দুটো সিট আছে। দুই দিন কক্সবাজার ছিলাম হাবিব ভাই আর আমি।সারাদিন সারা রাত গজল শুনাতেন।বেশ আনন্দে কেটেছিল দুটি দিন। কক্সবাজার তখন একেবারে সাদামাটা শহর।একেবারে প্রাকৃতিক। তিনটি ছোট ছোট কটেজ ছিল মাত্র।

মানুষের আনাগোনা তেমন ছিল না। তবুও এর নির্জন সমুদ্র সৈকতের নিঃস্বর্গ প্রকৃতির মাঝে এক ধরনের আকর্ষণ ছিল। পরদিন উখিয়া গিয়েছিলাম আমাদের শাখা অফিসের সাথে পুলিশ ফাঁড়ির একটা ঝামেলা হয়েছিল সেটা তদন্ত করতে। উখিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল।কক্সবাজার এর ছেয়ে ও বেশি ভাল লেগেছিল। পুলিশ ফাঁড়ির ছোট্ট টিলার উপর থেকে উখিয়ার পাহাড়ি অঞ্চল দেখে মনে হয়েছিল জেন সুইজারল্যান্ড।

সেই স্মৃতি এখনো স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। পরের বার কক্সবাজার গিয়েছিলাম সস্ত্রীক আটাত্তর সালে।সেবার মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কক্সবাজার গিয়েছিলেন।তিল ধারনের জায়গা ছিল না কোথাও। কোন রকমে রামুর বর্তমান এমপি সাইমুম সরওয়ার এর পিতা সাবেক এমপি ও রাষ্ট্রদূত মরহুম ওসমান সরওয়ার এর হোটেল নিদমহলে কোন রকমে একটু ঠাঁই পেয়ে ছিলাম। উনার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল আমার।মোহাম্মদ আলী চলে গেলে পরদিন শহর একেবারে খালি। আবার গিয়ে উঠলাম হোটেল সাইমনে।বিকেলে গেলাম রামু। ওসমান সরওয়ার সাহেবের এর বাড়িতে। আমার চাচাতো ভাই ওমর ফারুক সাহেবর শশুর বাড়ি।

ভালোই সময় কাটালাম। পরদিন ঠিক করলাম টেকনাফ যাব।আমার সাথে আমার স্ত্রী ছাড়াও আরও তিনজন বন্ধু ছিল। একটা টয়োটা সিডান গাড়ি নিয়ে গাদাগাদি করে সবাই টেকনাফ গেলাম। ভাল লাগা বা উৎসাহ কিছুর কমতি ছিল না। আসলে তারুণ্যের একটা আলাদা আমেজ আছে।সবকিছুই তখন পজিটিভলি গ্রহন করা যায়।এত লোকজন গাদাগাদি করে একটা গাড়িতে কক্সবাজার যাওয়া এখন কল্পনা ও করা যাবে না।তখন কিন্তু উপভোগই করেছি বেশ । টেকনাফ যখন পৌঁছলাম তখন বেলা বারটা হবে হয়ত। নাফ নদীর নীল জল আর ওপারে মায়ানমারের সবুজ পাহাড়, ভীষন মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে ছিল হৃদয়ে।বাংলাদেশ এত সুন্দর আগে কখনো মনে হয়নি। সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্র নাক ভ্রমণ কাহিনি পড়ে প্যারিসের সীন নদীর সৌন্দর্যের কথা শুনে মনের মাঝে একটা কাল্পনিক ছবি তৈরি হয়েছিল। নাফ নদীর সৌন্দর্য যেন সীন নদীর সৌন্দর্যের সাথে মিলে গেল একবারে। টেকনাফে এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিল। আমার এক ভাগ্নির শশুর বাড়ি। সেই হিসেবে বেয়াই বাড়ি।আদর যত্ন ভালোই হয়েছিল। ধীরাজ ভট্টাচার্য এর মাথিনের কুপ এবং থানা ভবনটি দেখে ফিরে আসলাম কক্সবাজার। 

বলছিলাম টেকনাফ এর কথা। একটা অখ্যাত জনপদ ছিল টেকনাফ।কোন অবকাঠামো ছিল না। দেখা’র ও কিছু ছিল না। তবে কক্সবাজার এর উন্নয়নের সাথে সাথে টেকনাফ এর গুরুত্ব ও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে সেন্টমার্টিন যখন পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে উঠে। তখন টেকনাফ গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকে।তবে স্বাধীনতার পরের বছর গুলোতে ধীরে ধীরে মায়ানমারের সাথে সীমান্ত বানিজ্য এবং একই সাথে চোরাচালানের কাজ বৃদ্ধি পেতে থাকলে একসময় পানিশমেন্ট পোস্টিং এর জায়গা টেকনাফ থানা হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক পোস্টিং এর জায়গা।

রাতারাতি দৃশ্যপট বদলে যায়। তার সাথে যোগ হয় সাম্প্রতিক সময়ের ইয়াবা ব্যবসা ও মানব পচার এর রুট হিসেবে এর গুরুত্ব। একসময়ের পানিশমেন্ট পোস্টিং এর জায়গা টেকনাফ থানা হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ণ প্রাইজড পোস্টিং এর জায়গা। এখন অনেক তদবির ও কড়ি ঢালতে হয় সেখানে যাওয়ার জন্য। ধীরাজ ভট্টাচার্য এর দীর্ঘ নিঃস্বাসের জায়গা অনেকের চোখে এখন মোহের অঞ্জন মাখে।ধীরাজ বাবু বেঁচে থাকলে এখন ভীষণ আফসোস করতেন কেন যে টেকনাফ ছাড়তে পেলাম! ইয়াবা বানিজ্য ও গেল প্রেমিকা মাথিন ও গেল!সাম্প্রতিক সময়ে মেজর সিনহা হত্যা ও ওসি প্রদীপ এর কারণে টেকনাফ এখন আবার লাইম লাইটে এসে গেল।এর আগে সাংসদ বদির কারণে আলোচনায় উঠে এসেছিল।

দ্বিতীয় বার টেকনাফ গিয়েছিলাম বন্ধু নজরুল ও এক ভাগিনা খোকন কে নিয়ে ২০১০ সালে।তখন কেন জানি মোটেই ভাল লাগেনি। ভর গ্রীষ্মের দিন ছিল।নাফ নদীর নীল জল কেেমন ঘোলাটে মনে হল।ওপারে মায়ানমারের সবুজ পাহাড়ের রং ও কেমন যেন ফ্যাকাসে লাগলো। টেকনাফ বাজার যেন একটা বস্তি।কোন রকমে মাথিনের কুপ টা দেখে ফিরে এসেছিলাম।তদুপরি সকাল বেলা হিমছড়ি সৈকতে কখন যে সেলফোন টা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল তাতেই মেজাজ টা খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল।

একসময়ের স্নিগ্ধ সুন্দর অজপাড়াগাঁ টেকনাফ এখন এক ভয়াল হিংস্র এক জনপদে পরিনত।ক্রসফায়ার খুন গুম কখন যে কে বেঘোরে প্রান হরায় তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এক সময়ের একটি শান্ত নিরিবিলি জনপদ এখন এভাবে হঠাৎ অশান্ত ও ভয়াল জনপদে পরিনত হওয়া খুবই দুঃখ জনক। অথচ কক্সবাজার সহ এই এলাকা হতে পারে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র এমন কি অদুরবর্তী বান্দরবান কে এর সাথে যুক্ত করে নেওয়া যায়।তাহলে আমার ধারণা পুরো বিশাল এলাকা চলে আসবে পর্যটন শিল্পের আওতায়। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে পুরো দুটি জেলা যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকতে পারে সেনাবাহিনী।

শুনেছিলাম কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের কাজ চলছে। কতটা অগ্রগতি হয়েছে জানি না। তবে এটা চালু হলে কক্সবাজার টেকনাফ এর আকর্ষণ আরো বাড়বে। তবে সবকিছু নির্ভর করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর। পর্যটকদের নিরাপত্তা হলো পর্যটন শিল্পের প্রান। ওসি প্রদীপ এর মত লোক দিয়ে তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। তাই পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ ভার সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করাই সঠিক হবে বলে ধারণা। একসময় টেকনাফে তেমন বাড়ি ঘর ছিল না। ইয়াবা ও মানব পাচার বানিজ্যের কারনে রাতারাতি অনেক মানুষ কোটিপতি হয়ছে।প্রায় সবাই অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত কুখ্যাত মানুষ। ওখান কার জনপ্রতিনিধি এখন যারা তারা ও কুখ্যাত। সবাই কমবেশি অবৈধ ব্যবসা বানিজ্যের নিয়ন্ত্রক।এখন আলী শান বাড়ি ঘর হয়েছে শত-শত। দশ বছর আগে ও এমনটা ছিল না।অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে টেকনাফ নিয়ে গত এক দশকে।সংবাদ পত্রের হেডলাইন হয়েছে অনেক সময়। কিন্তু অবস্হার কোন পরিবর্তন হয়নি। অনেকে বলেছেন বদির মত লোকেরা যতদিন জনপ্রতিনিধি থাকবে ততদিন টেকনাফের সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে না। বিষয় টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের।কিন্তু রাজনৈতিক মহলে সেই ধরনের সদিচ্ছার কোন আলামত এখনো লক্ষ্যনীয় নয়।সুতরাং যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে। শুধু মাঝে মাঝে সংবাদ শিরোনাম হবে।

উপজাতি বালিকা মাথিন এর অশরীরী অতৃপ্ত আত্মা কি এখনো ঘুরাঘুরি করে টেকনাফে? তার কি কোন অভিশাপ আছে এই জনপদের মানুষের উপর? প্রশ্ন টি এখনো আমার মনের কোনে উঁকি দেয় মাঝে মাঝে যদিও এধরণের কোন সংস্কার এ আমার কোন বিশ্বাস নেই।।
চট্টগ্রাম
১১/৮/২০

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.