--- বিজ্ঞাপন ---

সমুদ্র সীমানা নিয়ে গ্রীসের সাথে বিরোধ, ৬০টি পরমাণু বোমা দখলে নিতে পারে তুরস্ক?

0

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম: ন্যাটো জোটভুক্ত দুই দেশ গ্রীস ও তুরস্ক। ভুমধ্যসাগরের সমুদ্র সীমানায় তেল, গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে সীমানা বিরোধে উভয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি। অতীতেও দীর্ঘসময় ধরে দেশ দুটি এধরনের সমুদ্র সীমানা নিয়ে সংঘর্ষের প্রায় দ্বারপ্রান্তে গেছে বেশ কয়েকবার। তবে বর্তমানের বিরোধকে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় বিস্ফোরনম্মুখ বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। তুরস্ক সম্প্রতি পূর্ব ভ’মধ্যসাগরে সমুদ্র তলদেশে তেল ও গ্যাস হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের জন্য গবেষণা জাহাজ ’ওরাক রেইস’কে বিরোধপূর্ণ ঐ সমুদ্র এলাকায় যুদ্ধ জাহাজের কড়া প্রহরায় পাঠায়। পাশাপাশি তুর্কী নৌ বাহিনী ঐ সমুদ্র এলাকায় দফায় দফায় নৌ মহড়াও চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রীস দাবী করছে তুরস্ক যে এলাকায় গ্যাস তেল অনুসন্ধান চালাচ্ছে সেটি তার সীমানায়। দুদেশই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রেটি অর্গানাইজেশন) জোটের সদস্য। তুরস্ক ন্যাটো জোটের সদস্য হলেও ইয়োরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দেশগুলোর সদস্য করা হয়নি। যদিও তুরস্ক ইদানিং বলছে মুসলিম দেশ হওয়ায় অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে এটি তার প্রতি একধরণের বৈষম্যমূলক আচরণ। বর্তমানে এহেন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে একদিকে আলোচনা অন্যদিকে নেভটেক্স (নেভিগেশনাল টেলেক্স) ঘোষণা দিয়ে সাগরের বিরোধপূর্ণ এলাকায় নৌ মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক ও গ্রীস।

তুরস্কের নৌ বাহিনীর প্রহরায় সমুদ্রে অনুসন্ধানরত জাহাজ ‘ওরাক রেইস’

ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রেটি অর্গানাইজেশন) ভুক্ত দেশ হলেও সম্প্রতি ন্যাটো জোটের অন্যতম সদস্য ফ্রান্সের যুদ্ধংদেহী ভূ’মিকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হতে শুরু করেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রন তড়িঘড়ি করে যুদ্ধবিমান ও অস্ত্রশস্ত্রে গ্রীসের পক্ষ নিয়েছে। অথনৈতিকভাবে দুর্বল দেশ গ্রীস যাতে তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য বিনামূল্যে ৮টিসহ মোট ১৮টি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ৪.৫ জেনারেশন ‘রাফেল’ জঙ্গী বোমারু বিমান, ফ্রিগেট যুদ্ধ জাহাজসহ যা যা প্রয়োজন সব ধরনের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। গ্রীসের দৈনিক প্যারাপলিটিকা গত ২ সেপ্টেম্বর সংবাদটি নিশ্চিত করে বলেছে এর ফলে গ্রীসের বিমানবাহিনী তুরস্কের চাইতে আধুনিক বিমানের ক্ষেত্রে এগিয়ে গেল। ফ্রান্স তুরস্কের বিরুদ্ধে এতটাই আক্রমণাত্নক ভুমিকা নিয়েছে যে, ‘রাফেল’ বিমানগুলো আগের অর্ডার দিয়েছিল মিসর। এবং মিসরকে পরে সরবরাহ করা হবে জানিয়ে দ্রুত ঐ বিমানের চালান গ্রীসে পাঠাতে শুরু করেছে।

নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ও ন্যাটো জোটের শরিক দেশ ফ্রান্সের প্রকাশ্য এ ভুমিকায় তুরস্কের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তির সম্মিলিত আক্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি বলেই মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। গ্রীসের সাথে আরো যোগ দিয়েছে ফ্রান্স থেকে সুবিধাজনক দামে অস্ত্রের ক্রেতা মিসর, সংযুক্ত আরব আরব আমিরাত। সৌদি আরবও তুরস্ককে দমনের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে জানা গেছে। ন্যাটোর অপর শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও গ্রীসের সাথে নৌ মহড়া চালিয়েছে। ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন রয়েছে ডুইড ডি. আইসেনহাওয়ার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের সমন্বয়ে মার্কিন ৫ম নৌবহর। ফ্রান্সের মাঝারি পাল্লার পরমাণু শক্তিতে চালিত বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘চালর্স দ্য গল’সহ একটি টাস্ক গ্রুপ গ্রীস নৌ বাহিনীর সাহায্যে ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছেছে। এবং নৌ মহড়া চালাচ্ছে।

পশ্চিমা শক্তির পাশাপাশি কয়েকটি আরব মুসলিম দেশের সমর্থন গ্রীসের সাহায্যে এগিয়ে এলে তুর্কী নৌ-বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। বলছেন সমরবিদরা। সব মিলিয়ে গ্রীস এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে। তুরস্ক থেকে ক্রীট দ্বীপে ন্যাটো ঘাঁটি স্থানান্তরের পরিকল্পনার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনই এধরনের পরিকল্পনার নেই জানিয়েছে। তবে অস্বীকার করলেও সাইপ্রাসের উপর থেকে অস্ত্র ক্রয়ের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং গ্রীসে নৌ বাহিনীর সাথে মহড়া করায় অদূর ভবিষ্যতে তুরস্কের সাথে যুদ্ধ বেঁধে গেলে মার্কিনীরা তুরস্কের ইনসারলিক থেকে ন্যাটো ঘাঁটি সরিয়েও নেয়ার সম্ভাবনাই বেশী। 

ইনসারলিক ন্যাটো ঘাঁটির ৬০টি আণবিক ওয়ারহেড তুরস্ক দখলে নিতে পারে
পূর্ব ভুমধ্যসাগরে চলমান তুরস্ক-গ্রীস উত্তেজনা যতই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে এখন প্রায় চরমে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষক তুরস্কের ব্যাপারে এখনই ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তাদের আশংকা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ নীতি থেকে সরে এসেছেন এবং তুরস্ককে এতদঞ্চলে ইসলামিক সুপারপাওয়ারে পরিণত করার পাঁয়তারা শুরু করেছেন। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা আরও বলছেন তুরস্কের এরদোয়ান দেশটির অতীতে উসমানী খেলাফতের সময় খোয়ানো তুর্কী সাম্রাজ্য ও খেলাফত প্রতিষ্ঠায় তৎপর।

তুরস্কের এফ-১৬ জঙ্গী বিমান

পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম বিশ্লেষক মার্ক ল্যাঙ্গফান গত ১৩ সেপ্টেম্বর তার এক প্রবন্ধে বলেছেন, পশ্চিমা সভ্যতা ও রাশিয়ার জন্য তুরস্ক ক্রমেই হুমকি হয়ে উঠছে। দেশটিকে সম্মিলিত সামরিক হামলায় পর্যদুস্ত করা না গেলে এই তুরস্ক অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে পশ্চিমা, খ্রীস্টান ও রুশ সভ্যতা মুছে দিবে। তিনি ২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একটি তুরস্কে নির্মিত একটি যুদ্ধজাহাজ পানিতে ভাসানো উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দেয়া তুর্কী সাম্রাজ্যের অতীত বিজয়ের কথা পশ্চিমাদের স্মরণ করার উল্লেখ করেন। এতে তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পশ্চিমা দেশগুলোকে প্রিভিজা যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিতে বলেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৫৩৮ খ্রীস্টাব্দের প্রীভিজার বিজয়ের যুদ্ধে তুর্কী উসমানী সাম্রাজ্যের মুসলিম বাহিনীর হাতে সম্মিলিত খ্রীস্টান বাহিনীর চরমভাবে পরাজিত হয়। মার্ক ল্যাঙ্গফান আরও ভয়ংকর আশংকার উল্লেখ করেছেন। তিনি শংকা ব্যক্ত করে বলেন, তুরস্কের ইনসারলিক ন্যাটো ঘাঁটিতে ৬০টি বি-৬১ পরমাণু বোমা মজুদ রয়েছে। এর প্রতিটি বোমা দ্ধিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমার চাইতে ৪১ গুণ বেশী ধ্বংসক্ষমতাসম্পন্ন যা বৈজ্ঞানিক হিসেবে ৩৪০ কিলোটনের সমান। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের আশংকা তুরস্ক পরিস্থিতি আরও জটিল হতে থাকলে এরদোয়ান এই পরমাণু বোমা সহজে তুরস্ক থেকে অন্যত্র সরাতে বাধা দেবে। এমনকি দখলেও নিতে পারে। অপর পশ্চিমা বিশ্লেষক মারেক জান সোডাকিউইকজ ১৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার একই আশংকার সুরে বলেছেন, তুর্কীকে হয়ত ন্যাটো জোটে আরা রাখা যাবেনা। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

তুরস্কের ভয়ংকর ড্রোন ‘আকসুঙ্গার’

গ্রীসের বিরুদ্ধে তুরস্কের নতুন অস্ত্র সশস্ত্র ড্রোন ‘আকসুঙ্গার’

এদিকে তুরস্ক বসে নেই। গ্রীসকে ফ্রান্স সম্প্রতি তড়িঘড়ি করে রাফালে জঙ্গী বোমারু বিমান ও বিপুল অস্ত্রসম্ভার সরবরাহ করার ঘোষণা দেয়ায় আংকারাও নতুন নতুন অস্ত্র উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। তুরস্কের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, দেশটির অন্যতম অস্ত্রনির্মাতা কোম্পানী রকেটসান ‘আকসুঙ্গার’ নামে একটি অত্যন্ত ভয়ংকর এ্যাসল্ট ড্রোনের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। ইতিমধ্যে সিরিয়ার আসাদ সরকারের বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং লিবিয়ায় তুর্কী ড্রোনের আক্রমণাত্নক ক্ষমতা ও এর সাফল্যের খবর পশ্চিমা পত্রিকাগুলোতে ফলাও প্রচার হয়। নতুন এই ’আকসুঙ্গার’ পশ্চিমা দেশগুলির জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হবে সন্দেহ নেই। এই সশস্ত্র ড্রোনটি ৭৫০ কেজি বোমা নিয়ে একটানা ৪৯ ঘন্টা আকাশে অবস্থান করতে পারে। ৪০ হাজার ফুট উঁচুতে আকাশে থেকে এই ড্রোনটি নীচের লক্ষবস্তু ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিসহ বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে হামলা চালাতে সক্ষম। এর উল্লেখযোগ্য দিক হল, এই ড্রোনে ব্যবহৃত ’টিবার’ গাইডেন্স কিট বোমাকে স্মাট বোমায় রুপান্তর করে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যস্থলে হামলা চালাতে পারবে।

তুর্কী পত্র-পত্রিকায় দেশটির মেরিন বাহিনী গ্রীসের দ্বীপগুলোতে হামলা চালাতে সক্ষম ‘জাহা’ নামের মেরিন উভচর যানেরও সফল পরীক্ষার কথা জানিয়েছে। সেদেশের সামরিক গবেষণা বিভাগের প্রধান ইসমাইল ডেমিরের উদ্ধৃতি দিয়ে তুর্কী মিডিয়া এসকল খবর দেয়। তুরস্ক এজিয়ান সাগরে গ্রীসের অধিকৃত ২৩টি দ্বীপের মধ্যে ১৮টিতে দেশটি সামরিক ঘাঁটিতে রুপান্তর করে বিপুল সৈন্য সমাবেশের অভিযোগ করেছে যা তুরস্কের ভাষায় দুদেশের মধ্যে ১৯২৩ সালে যুদ্ধ শেষে লুসান চুক্তির লংঘন। ঐ সকল দ্বীপে গ্রীস এক ডিভিশন সৈন্য রসদ ও নৌ ঘাঁটি নির্মান করেছে। এদিকে দুদেশের পরস্পর নিজ নিজ সমরসজ্জা ও মহড়ার মধ্যে তুরস্ক বিরোধপূর্ণ জলসীমায় হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানকারী জাহাজ ‘ইয়াভুজ’ প্রেরণ করেছে । এবং এই অনুসন্ধানকারী জাহাজটি তুরস্কের নৌ বাহিনীর যুদ্ধজাহাজের প্রহরায় ১২ অক্টোবর পর্যন্ত তৎপরতা চালাবে এজন্য নেভটেক্স জারী করেছে।

ফ্রান্সের ‘রাফেল’ জঙ্গী বিমান

ভবিষ্যতে তুরস্কের সাথে যুদ্ধ বেঁধে গেলে উভয় দেশের বিমানবাহিনী অন্যতম ভুমিকা রাখবে। বিমানের সংখ্যায় গ্রীসের বিমান বাহিনীতে প্রথম সারির বিমানের তালিকায় রয়েছে ১৫০টি এফ-১৬ জঙ্গী বিমান। তুরস্কের সংখ্যা বেশী ২৪৫টি। পশ্চিমা দেশগুলি গ্রীসের এই শূণ্যতা পূরণ করতে দ্রুত গ্রীসে জঙ্গী বিমান পাঠাতে শুরু করেছে।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.