--- বিজ্ঞাপন ---

প্রাণ যায় কর্ণফুলির!!

0

বিশেষ প্রতিনিধি ##
অব্যাহতভাবে নাব্যতা হ্রাস, দখল ও দূষণের ফলে বিপর্যস্ত এখন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী। নাব্যতা হ্রাসের কারনে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল মারাত্মক ঝুঁকির দিকে এগিয়ে চলেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বলে খ্যাত সদরঘাট ১নং জেটি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকায় পড়েছে বিশাল চর। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি সম্প্রসারন যাচ্ছে না। কয়েকবছর ধরে এখানে জাহাজ চলাচলও সীমিত। অপরদিকে কর্ণফুলিকে টার্গেট করে স্থাপিত প্রায় ৩’শ কারখানার বর্জ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদীতে পড়ছে। প্রায় ৮৫ টি কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে। কর্ণফুলির পাড় দখল করে চলছে অবৈধ স্থাপনা নির্মান বাণিজ্য থেমে নেই। প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি স্থাপনা এখন নদীকে ঘিরে। ফলে নদীর প্রস্থ দিন দিন কমছে। প্রভাবশালীরা এসব স্থাপনায় বহুতল ভবনসহ ঘর-বাড়ী বানিয়ে বছরের পর বছর ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কর্ণফুলির দখল বাণিজ্য এখন জমজমাট। কর্ণফুলি নদীকে দখলমুক্ত করার জন্য ব্যাপক দৌড়ঝাপ চলে। বিগত ১ বছর আগে দখল উচ্ছেদ শুরু হয়। উচ্ছেদের ফলে নদী হতে কোটি কোটি টাকার ভূমি উদ্ধারও হয়। কিন্ত মাঝপথে হঠাৎ উদ্ধার কাজ গুটিয়ে ফেলা হয়। ধারনা করা হচ্ছে, প্রভাবশালী মহলের চাপে এটি থমকে যায়। ফলে বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আর উচ্ছেদ হয়নি। দখলাকারীরা বহাল তবিয়তে রয়ে যায়। দখলের কারণে নদীটির ভৌগোলিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নদীর প্রস্থ কোন কোন ক্ষেত্রে প্রস্থ কমে গেছে ৫০ থেকে ২৫০ মিটার পর্যন্ত। জেলা প্রশাসনের ২০১৫ সালের হিসাব মতে, কর্ণফুলি নদী ঘিরে অবৈধ স্থাপনা ২ হাজারেরও বেশি। গত পাঁচ বছরে অবৈধ স্থাপনা আরও বেড়ে আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। দখলের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের বেশ ঐক্য রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তৃতীয় সেতুর আশপাশে জেগে ওঠা চর দখল করে বস্তি-বাণিজ্য বেশ লাভজনক। চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখে অন্ত ৩০ একর সরকারি খাসজমি ২০ বছর ধরে দখল ছিন্নমূল দরিদ্র লোকজনকে ভাড়া দিয়েছে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। বকশিরহাট ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আমিন তৃতীয় সেতু–সংলগ্ন কলেজ রোড এলাকায় নদীর জায়গা দখলে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর কলোনির নাম ‘শান্তি কলোনি’। ভাড়াটে রয়েছেন প্রায় ৫০ জন। বাকলিয়া বহুমুখী বাস্তুহারা কলোনির নামে অন্তত ৫০ একর জমি দখলে রয়েছে জসিম উদ্দিন নামে বিএনপির এক নেতার কাছে। এই জমি বেচাকেনাও চলে। অভিযোগ রয়েছে, উত্তম কুমার সুশীল নামের এক ব্যক্তি আওয়ামী লীগ দলকে ব্যবহার করে তার সাথে রয়েছেন। এই দিকে দখল সুসংহত করার জন্য গঠন করা হয়েছে ‘ভেড়া মার্কেট শ্রমজীবী সমবায় কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সংগঠন। সমিতির নেতা বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি আকতার হোসেন। উচ্ছেদ ঠেকাতে আকতার হোসেন ২০১৪ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ওই রিট এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নামে বিএস রেকর্ড অনুসারে পূর্ব পতেঙ্গা মৌজার ৬ নম্বর খতিয়ানের ১২৬ দাগে ৫ দশমিক শূন্য ৪ একর জমি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে কর্ণফুলী নদী অবৈধ দখলদার চিহ্নিতকরণের সময় এ প্রতিষ্ঠানের তিন একর জমি নদীর সীমানায় পরিলক্ষিত হয় এবং তা অবৈধ স্থাপনার তালিকায় উল্লেখ রয়েছে বলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পরিদর্শন দলকে অবহিত করেন। একই প্রতিষ্ঠানকে আরেকটি প্রকল্পে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যে জমি ইজারা দিয়েছে, তার মধ্যে নদীর সীমানার মাঝে বিএস ৫০৭ ও ৫০৮ দাগের (আরএস ১৬০১) মোট ১৯ দশমিক শূন্য ৬ একর নদীর জমি এবং পাশের খালটি নতুন করে ভরাট করা হয়েছে। এটি প্রাকৃতিক জলাধার আইন, ২০০০/এসএটিএ ১৯৫০, পানি আইন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০০৩ অনুযায়ী দÐনীয় অপরাধ। ইজারা দিয়ে দখল ও স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে নদীটিকে সংকুচিত করার অভিযোগ উঠেছে খোদ চট্টগ্রা বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। স¤প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক প্রতিবেদনে এ অভিযোগ করা হয়েছে।
কর্ণফুলী রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে সুফল মিলছে না। নদী খেকোদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হওয়া অভিযানও থমকে গেছে। সরকারি দলের নেতা এবং প্রভাবশালীদের অসংখ্য স্থাপনা অক্ষত আছে। ফলে কর্ণফুলী নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। গত বছরের ৪ ফেব্রæয়ারি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সময় বুলডোজারের উদ্বোধনী ধাক্কাটি লাগে এই ঘাটের অবৈধ স্থাপনার ওপর। তবে অবমুক্ত করা জায়গা পুনরায় দখল হয়েছে বালু আর পাথরের স্তুপে। জেঁকে বসেছে রিকশার গ্যারেজ। ঘাটের ইজারাদার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবু কায়সার এই দখলের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সদরঘাট থেকে পতেঙ্গার লালদিয়ার চরের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। কয়েক দশক আগে থেকে অবৈধ দখলদারদের ছোবল পড়েছে এখানে। গত বছরের ২২ জুলাই চরের এ বøকে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছিল ৩০ একর জমি। পুনর্দখল ঠেকাতে একটা সীমানাদেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে এ বøকের এক পাশে। তবে অন্য পাশে ভেঙে দেওয়া অনেক দোকান ও ঘর আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে। থেমে থেমে উচ্ছেদ একই সাথে নদীর দু’পাশ দখল মুক্ত করতে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলে সংসদীয় কমিটি।
নদী রক্ষায় রিট আবেদনকারি ব্যারিস্টার মনজিল মোরসেদ গণমাধ্যমকে জানান, উচ্ছেদ করা জায়গা যাতে বেদখল না হয়, সেদিকে উচ্ছেদকারী সংস্থা বন্দর ও জেলা প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে। উচ্ছেদ ও সংরক্ষণ একসঙ্গে হতে হবে। কর্ণফুলীকে ঘিরে একটা মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। কোথায় কীভাবে জায়গা সংরক্ষণ করা হবে, তা মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী করার কথা রয়েছে।
দখলের সাথে সমানে এগিয়ে চলেছে কর্ণফুলির দূষণও। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, রাঙ্গামাটির চন্দ্রঘোনা থেকে পতেঙ্গাস্থ কর্ণফুলীর মুখ পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার স্থান জুড়ে অন্তত ৩০০টি কারখানা কিংবা শিল্প স্থাপনা রয়েছে। এসব কারখানা এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যতে কারখানার বর্জ্য নদীতে চলে যেতে পারে। এসব কারখানাগুলো মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পেপার মিল, তেল শোধনাগার, পাওয়ার প্ল্যান্ট, ট্যানারি, সার প্রস্তুতকারক, সাবান এবং সিমেন্ট তৈরির কারখানা। পরিবেশ অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যায়, অন্তত ৮৪টি কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। এগুলোর মধ্যে ৭৪টি কারখানায় তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) থাকলেও উৎপাদন খরচ কমাতে মালিকরা সেগুলো ব্যবহার করছে না। দুই পাড়ে গড়ে উঠা কল-কারখানার বর্জ্যও পড়ছে নদীতে। মারাত্মক ক্ষতিকর সব বর্জ্যরে ভারে কর্ণফুলীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে হরেক প্রজাতির মাছ। চরম হুমকিতে জীব-বৈচিত্র্য। নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে বৃষ্টিতে পাহাড় থেকে নেমে আসছে কাদা মাটি আর বালুর ঢল। অসংখ্য ছোট বড় খাল, নালা, ছরা হয়ে তা জমছে নদীতে। অভিযোগ রয়েছে, কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকার কারণেই কারখানাগুলো ইটিপি ব্যবহার করছে না।
কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকায় যেসব মানুষ বসবাস করছেন, নদী দূষণের প্রভাব তাদের ওপরেও পড়ছে। এর কারণে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ। নদীর তীরের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি স্থানান্তর করতে হচ্ছে। এছাড়া, দূষণের ফলে নদীতে কমছে মাছ। ফলে পেশা পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকছেন জেলেরা। নদী দূষণ থেকে সৃষ্ট দুর্গন্ধের কারণে সেখানে অবস্থান করা মত পরিবেশ নেই। গত ২০১২ সালে করা পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কর্ণফুলীতে ১৪০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। যেগুলো মিঠা পানি, মিশ্র পানি ও সামুদ্রিক প্রজাতির। কিন্তু, দূষণের কারণে ৩৫ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়া, বাকিগুলোও বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
কমিটির প্রতিবেদনে কর্ণফুলী রক্ষায় বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে নদীর সীমানা নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের উন্নয়নকাজ বন্ধ রাখা, নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য পানি আইন, ২০০৩; জলাধার আইন, ২০০০; বন্দর আইন, ১৯০৮; মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩ (সংশোধিত ১৯৯৫) ইত্যাদি বিবেচনা করে বন্দর থেকে সমুদ্রের মোহনা পর্যন্ত চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় সমন্বিত কাজ করা, কর্ণফুলী ড্রাইডক স্পেশাল ইকোনমিক জোনকে দেয়া নদী তীরবর্তী ভূমির বন্দোবস্ত বাতিল করা। জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সদরঘাট এলাকা হতে নবনির্মিত কর্ণফুলী তৃতীয় সেতুর প্রায় তিন কিলোমিটার। এ এলাকাটি বন্দরের হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ এটি ব্যবহার করতে পারছে না। কারণ এ তিন কিলোমিটার এলাকায় কোন ড্রেজিং হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর ধরে এখানে পলি জমতে জমতে বন্দরের অন্যান্য জেটিগুলোকেও হুমকির মূখে ফেলেছে। বর্তমান অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, এ তিন কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং না হলে বন্দরের জাহাজ চলাচলেও অচলাবস্থা দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।###৩০.৯.২০

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.