--- বিজ্ঞাপন ---

আধুনিক অস্ত্রের যোগান বাড়াচ্ছে ভারত-পাকিস্তান, টার্গেট কাশ্মির…২

0

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম ##

বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির নয়াদিল্লীর সাংবাদিক শুভজ্যোতি ঘোষ ৫ আগস্ট ২০১৯ বাংলা বিভাগের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে শিরোনাম দিয়েছেন “মুসলিম-প্রধান কাশ্মীরের চরিত্র বদলানোই মূল লক্ষ্য?”

বিবিসি বলেছে, মুসলিম-গরিষ্ঠ কাশ্মীরের ‘ডেমোগ্রাফি’ বা জনসংখ্যাগত চরিত্র বদলে দেওয়াই সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কি না, তা নিয়ে এখন তীব্র বিতর্ক দানা বাঁধছে। ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি বা তাদের পুরনো অবতার জনসংঘ অবশ্য বহু বছর ধরেই ভারতীয় সংবিধানের এই বিতর্কিত ধারাটি বিলোপ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। বিজেপির বক্তব্য ছিল, কাশ্মীর যাতে সম্পূর্ণভাবে ভারতের সাথে সংযুক্ত বা ‘আত্মীকৃত’ হতে পারে সে জন্যই এই ধারাটি বিলোপ করা দরকার।

স্বাধীনতার সাত দশক পর ভারতে একটি বিজেপি সরকার অবশেষে তাদের এই বহু পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাটি বাস্তবায়ন করল। কিন্তু এদিন পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্-র নাটকীয় ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বুঝিয়ে দেয়, তারা এই পদক্ষেপের মধ্যে অন্য অভিসন্ধি দেখছে। রাজ্যসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ তৃণমূল-সহ অন্য কিছু বিরোধী দলকে পাশে নিয়ে ঘোষণা করেন, “ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকভাবে কাশ্মীরের যে অনন্য চরিত্র, কলমের এক খোঁচায় বিজেপি সেটাই বরবাদ করে দিতে চাইছে।”

তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে সীমান্তবর্তী রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর এমন একটি প্রদেশ, যার সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি সবই বাকি দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।” কংগ্রেস নেতা ও ভারত-শাসিত কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী  গুলাম নবি আজাদ বলেন, “এমন একটি রাজ্যকে যদি কেউ এক সূত্রে বেঁধে রাখতে পারে, সেটা ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারা। এই ধারায় রাজ্যের সব ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষের জন্যই বিশেষ ব্যবস্থা ছিল – যা আজ বিজেপি শেষ করে দিল।” “এই রাজ্যের লাদাখে বৌদ্ধ ও মুসলিমরা থাকেন, কাশ্মীরে থাকেন মুসলিম, পন্ডিত ও শিখরা। আর জম্মুতে জনসংখ্যার ষাট শতাংশ হিন্দু, আর বাকি চল্লিশ শতাংশ মুসলিম।” ভারত-শাসিত কাশ্মীরের সাবেক এই মুখ্যমন্ত্রী যে কথাটা কিছুটা রাখঢাক করে বলছেন, কাশ্মীরি অ্যাক্টিভিস্টরা সেটাই বলছেন আরও খোলাখুলি – যে এর মাধ্যমে কাশ্মীর উপত্যকা বা ভ্যালির ডেমোগ্রাফি বদলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক: ইসরাইল ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ভূমিতে যেভাবে বসতি স্থাপন করছে সেটিই কাশ্মীরে অনুসরণ করতে চলেছে  ভারত ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সামরিক সম্পর্ক অনেক দৃঢ়-তা সবার জানা। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে বিজেপি সরকার আসার পর ভারত হয়েছে ইসরাইলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড় বাজার। ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়- গত কয়েক বছরে দেশ দুটির অস্ত্র বাণিজ্য ছয় বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই ভারত সরকার ৭৭৭ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনতে ইসরাইলের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে।

ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে বিদ্যমান সামরিক সম্পর্কের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে যুক্তরাজ্যের দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘাতে বড় ভূমিকা রাখছে ইসরাইল’ এ শিরোনামে মতামত লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক (স্টার অনলাইন, ১ মার্চ, ২০১৯)। সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহের ওপর বিশ্লেষণ লিখে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তিনি। তবে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাম্প্রতিক পাকিস্তান অভিযান তার দৃষ্টি এড়ায়নি। এক বিশ্লেষণে তিনি তুলে ধরেছেন  প্রায় ২,৫০০ মাইল দূরে থেকে তেলআবিব কীভাবে সহযোগিতা করছে নতুন দিল্লিকে।

তবে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের এই সখ্যতার বিষয়ে অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন বলেও মন্তব্য রবার্ট ফিস্কের। ব্রাসেলসের এক গবেষক শৈরি মালহোত্রা ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ‘হারেৎজ’-এ এক প্রতিবেদনে গত বছর লিখেছেন, “ভারত-ইসরাইলের (সুদৃঢ় সামরিক) সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে বিজেপি এবং লিকুদ পার্টিও রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে।”

সেই গবেষকের মতে, ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের বিশেষ করে মুসলমানদের হত্যা করছে তা দেখে অনুপ্রাণিত ভারতের ‘ইন্টারনেট হিন্দুরা’। ইন্টারনেট ব্যবহার করে যারা সেই খবর নিয়মিত রাখছেন তারাই মূলত ইসরাইলের ব্যাপক ভক্ত। তারাও যেনো চান সেই একই কায়দায় পাকিস্তানকে ঘায়েল করা হোক।

কারলেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিবেক দেহেজিয়ার ইচ্ছা- ভারত, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে একটি ‘ত্রিশক্তি’ জোট গড়ে উঠুক। তবে তার এই ধারণাটিরও বিরোধিতা করেন মালহোত্রা। তার মতে- ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠুক বাস্তবতার নিরিখে, কোনো আদর্শগত ভিত্তির ওপর ভর করে নয়। কেননা, এই দুটি দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে গায়ের জোরে পরের জমি দখল করে রাখার।

কাশ্মীরের বারামুলা কলেজে একসময় অধ্যাপনা করেছেন নাজির আহমেদ শল, কাশ্মীরিদের ‘সেলফ ডিটারমিনেশন’ বা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে তিনি গত বহু বছর ধরে লন্ডনে আন্দোলন চালাচ্ছেন। লন্ডন-ভিত্তিক জাস্টিস ফাউন্ডেশনের কর্ণধার অধ্যাপক শল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “৩৭০ ধারা বিলোপের আগেই অন্তত: দুটি পদক্ষেপ থেকেই পরিষ্কার আঁচ করা যাচ্ছিল বিজেপি সরকার কাশ্মীরের আবহমান কালের চরিত্রটা পাল্টে দিতে চাইছে।”

“প্রথমত:  ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল কাশ্মীরের জন্য যে ‘ডোভাল ডকট্রিন’ ফর্মুলেট করেছিলেন তার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা ছিল ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে লোকজনকে কাশ্মীরে এনে বসত করানো।” “যেমন ওই ডকট্রিনে কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের জন্য আলাদা বসতি স্থাপন, কাশ্মীরে শিল্পাঞ্চলের জন্য বাকি ভারত থেকে  শিল্প শ্রমিক      এনে বসতি গড়া কিংবা ভারতীয় সেনার সাবেক সদস্যদের এনে কাশ্মীরে জমি দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল।”

“দ্বিতীয়ত:, বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও আর্টিকল ৩৫এ বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।” “এমন কী তারা সরাসরি ঘোষণা করেছিল বিজেপিকে ভোট দিয়ে জেতালে কাশ্মীরে জমি জিরেত কিনতে পারবেন আনায়াসেই।”

এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী  ইমরান খান ভারতের এ পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে বলেছেন, তার মনে হচ্ছে কাশ্মীরের ওপর থেকে বিশেষ মর্যাদা তুলে নেয়ার ফলে ভারত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই এলাকায় জনসংখ্যার কাঠামো পরিবর্তন করতে পারবে। তিনি বলেন ”আমার আশঙ্কা, (ভারত) এখন কাশ্মীরে জাতিগত বসনিয়ার সেব্রেনিৎসায় মুসলিম নিধনের মত এখানেও নির্মূল অভিযান চালাবে ভারত।” ”তারা স্থানীয় মানুষজনকে সরিয়ে দেবে এবং অন্যদের সেখানে নিয়ে আসবে এবং তাদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ করে তুলবে। ফলে স্থানীয় মানুষরা তাদের দাস হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।’

‘ ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্নীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদে যান ও সেখানে  ভাষণে ইমরান খান বলেন, কাশ্মীরের জন্য ভারতকে চরম মূল্য দিতে হবে। ভারত পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরে হামলা চালানোর পরিকল্পনা  করছে। তিনি ভারতের যে কোন হুমকি মোকাবেলায় পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি। পাকিস্তান এবার তাদের স্বাধীনতা দিবস ভিন্নভাবে পালন করছে দিবসটিকে এবার কাশ্মীরের জনগণকে সমর্থন জানিয়ে কাশ্মীর সংহতি দিবস ঘোষণা করেছে। ভারত কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করছে। পাকিস্তান বলেছে তারা শুধুমাত্র স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরের লোকজনকে নৈতিক আর কূটনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে।

চীন ও পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর ভারত কার্ফু জারী করে ফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট সহ সকল যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়ায় অবরুদ্ধ  কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরী বৈঠকের আহ্বান জানায়। এ আহ্বানের প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদের ইতিহাসে ৫০ বছরের মধ্যে প্রথমবার কাশ্মীর ইস্যুটি নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় উঠল। বৈঠক শেষে বিবৃতিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে কাশ্মীরের ভারতের একক ব্যাপার নয় এটি জাতিসংঘের বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার আওতাধীন বিষয়। যদিও ভারত বার বার কাশ্মীরকে নিজ দেশের আভ্যন্তরীন বিষয় বলে আসছিল। বিবৃতিতে দু’দেশকে জাতিসংঘের চার্টার মোতাবেক কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানায়।  এর আগে জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুটারেস এক বিবৃতিতে কাশ্মীরের ভারত অংশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।…(চলবে)

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.