--- বিজ্ঞাপন ---

জাহাজভাঙ্গা শিল্পে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ

0

বিশেষ প্রতিনিধি
জাহাজভাঙ্গা শিল্পে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে বিশ্বের পুরানো জাহাজ ভাঙ্গার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে থাকলেও করোনা মহামারি এবং নতুন বাজেটে ভ্যাট এবং এটিভি (অগ্রিম ভ্যাট) আরোপের ধাক্কায় এ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সংশ্লিষ্টরা জানায়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪২ টি জাহাজ ভেঙ্গে শীর্ষে উঠে এসেছে ভারত। বাংলাদেশ ৯৮ টি জাহাজ ভেঙ্গে দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসেছে। তৃতীয় স্থানে তুরস্ক ও পাকিস্তান রয়েছে চতুর্থ স্থানে। বেলজিয়াম ভিত্তিক ‘এনজিও শিপব্রেকিং প্লাটফর্ম’ সূত্র এ তথ্য দেয়। ২০১৯ সালে ২৩৬টি, ২০১৮ সালে ২২১টি, ২০১৭ সালে ২১৪টি, ২০১৬ সালে ২৫০টি জাহাজ ভেঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানটি ধরে রেখেছিল। গত বছরের হিসেবে বাংলাদেশে বিশ্বের ৪৮ দশমিক ২০ শতাতংশ জাহাজ ভাঙ্গা হয়েছে।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে প্রায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প। বিশ্বে প্রতি বছর যেসব জাহাজ পরিত্যক্ত বা স্ক্র্যাপ ঘোষনা করা হয় বাংলাদেশি ক্রেতারা এগুলো নিলামে কিনে নেয়। কেনার পর এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বন্দরে আসে। বন্দর থেকে নিয়ে আসা হয় সীতাকুন্ডের জাহাজভাঙ্গা ইয়ার্ডে। বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠা এ অঞ্চলে জাহাজগুলো ভাঙ্গা হয়। এখানে হাজার হাজার শ্রমিক জাহাজ ভাঙ্গার কাজ করেন। জাহাজভাঙ্গার জন্য জাহাজগুলোতে শুধু লোহার যন্ত্র না এর ভেতরে থাকা ইস্পাত, ইঞ্জিন, বয়লার, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ, আসবাব পত্র, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক জিনিষপত্রও রয়েছে। তবে বেশিরভাগই লোহা। যেগুলো কেটে স্ক্র্যাপ আকারে বিক্রি হয়। নিয়ে যায় সারা বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন স্টিল ও অটো রি-রোলিং কোম্পানির মালিকরা।
এমনিতেই জাহাজভাঙ্গা শিল্পের করুন অবস্থা। তার উপর করোনা মহামারির কারনে এ শিল্পে গতি থমকে গেছে। এ অঞ্চলে প্রায় ১৫০টি ইয়ার্ড ছিল। ক্রমশ কমতে কমতে তা নেমে এসেছে ২০ থেকে ২৫টিতে। এর মধ্যে পরিবেশ সম্মত জাহাজভাঙ্গা ইয়ার্ড ৩ থেকে ৪টি। বাকিগুলো চলছে ঢিমেতালে। জাহাজভাঙ্গা শিল্পের প্রযুক্তিগত উন্নত না হওয়ার কারনে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের কাছে জাহাজ বিক্রিও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন এনজিও সংস্থার চাপে সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ। কারন পরিবেশ সম্মত ইয়ার্ড না হলে জাহাজ বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আসছে সামনে। আগামী ২০২৩ সাল থেকে পরিবেশ সম্মত ইয়ার্ড ছাড়া অন্য কারও কাছে জাহাজ বিক্রি করবে না উদ্যোক্তরা। পূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন জাহাজ বিক্রি হতো উম্মুক্ত পদ্ধতিতে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে টেন্ডারের মাধ্যমে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কমে আসছে। বাজার দখল করছে ভারত। জাহাজভাঙ্গার জন্য পরিবেশ সম্মত ইয়ার্ড করতে খরচ লাগবে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা। এ বিপুল পরিমান টাকা খরচ করে এখানে ইয়ার্ড করা অনেকের পক্ষে সম্ভব না। ফলে এ শিল্পটির অগ্রযাত্রা থমকে যাবার পথে।
২০২০ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর নয় মাসে জাহাজ ভাঙ্গা তালিকার শীর্ষে উঠেছে ভারত। অথচ ভারত ছিল বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে। এ বছর ১৪২টি জাহাজ ভেঙ্গে ভারত শীর্ষে উঠে এসেছে। ভারতে রয়েছে পরিবেশ সম্মত ইয়ার্ড। ফলে এখানে শ্রমিকের মৃত্যু বাংলাদেশের তুলনায় নগন্য। বাংলাদেশের ইয়ার্ডগুলোতে ম্যানুয়াল হওয়ার কারনে শ্রমিকের মৃত্যুর হার ছিল বেশি। এ নিয়ে বিশ্বে হৈচৈ হলে আন্তর্জাতিক চাপে বাংলাদেশে পরিবেশ সম্মত ইয়ার্ড না হলে ব্যবসায়ীরা টেন্ডারে অংশগ্রহন নিষিদ্ধ হতে চলেছে। করোনা এবং নানামূখি চাপের কারনে এ বছর বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মাত্র ৯৮টি জাহাজ ভাঙ্গতে পেরেছ। নেমে এসেছে প্রথম থেকে দ্বিতীয়স্থানে। তৃতীয় স্থানে উঠেছে তুরস্ক, আর চতুর্থস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। গত বছর বাংলাদেশ ২৩৬টি জাহাজ ভেঙ্গেছিল।২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বিশ্বে জাহাজ ভাঙ্গার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থানে ছিল। কিন্ত বর্তমানে ভারতের সাথে ব্যাপক ব্যবধান বলে দিচ্ছে এ শিল্পে বাংলাদেশ ছিটকে পড়তে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, বর্তমানে করোনার কারনে জাহাজভাঙ্গা শিল্পে মন্দা যাচ্ছে এটা ঠিক। তবে আমরা এ অবস্থা কাটিয়ে উঠবো। তিনি বলেন, পরিবেশ সম্মতভাবে জাহাজ ভাঙ্গার জন্য অনেকগুলো ইয়ার্ডে কাজ চলছে। আগামি ২০২৩ সালের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০টি পরিবেশ সম্মত ইয়ার্ড প্রস্তত হয়ে যাবে। আবু তাহের বলেন, ভারত এ বছর শীর্ষে থাকার পেছনে অন্যতম কারন হচ্ছে তারা বড় এবং ছোট সব জাহাজ কাটে। আমাদের এখানে বড় জাহাজের পরিমান বেশি। গত বছর এখানে জাহাজের সংখ্যা এবং ওজনের দিক থেকেও শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। এ শিল্প নিয়ে সরকারকে আরও নজর দিতে হবে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।’
সুত্র জানায়, জাহাজভাঙ্গা শিল্প ভারতের চেয়ে পিছিয়ে পড়ার পেছনে অন্যতম একটি কারন হচ্ছে নতুন বাজেটে ভ্যাট এবং এটিভি (অগ্রিম ভ্যাট) আরোপ। এ শিল্পের সাথে জড়িতরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জাহাজ কিনতে এখন প্রতি টনে ভ্যাট দিতে হচ্ছে তিন হাজার টাকা। নতুন আরোপিত এ ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার না হলে এ শিল্পের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতে এডভ্যান্স ট্রেড ভ্যাট ফেরত দেয়ার কথা থাকলেও ভ্যাট অফিস থেকে সেই টাকাও ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, গত ২০১৯ সালে বিশ্বে ৬৭৪টি সমুদ্রগামী পুরোনো জাহাজ বিক্রি হয়। পুরানো এ জাহাজগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কিনেছেন ২৩৬টি। গত বছর বিশ্বে যত জাহাজ বিক্রি হয়, তার ৬৫ শতাংশই কিনেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের কারখানা মালিকেরা।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.