--- বিজ্ঞাপন ---

চীনের নেতৃত্বে শুল্ক মুক্ত ‘আরসিইপি’ বানিজ্য জোট, কোন পথে বাংলাদেশ

0

সিরাজুর রহমান

২০২০ সালের ১৫ই নভেম্বরে সিঙ্গাপুরে গঠিত হয় বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বানিজ্য জোট রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনোমিক পার্টারশীপ বা (আরসিইপি)। বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাইরে রেখে এশিয়া প্যাসিফিক মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশ নিয়ে গঠিত হয় এই আরসিইপি মুক্ত বানিজ্য জোট। যার মূল নেতৃত্বে রয়েছে বিশ্বের উদয়মান অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার রেড জায়ান্ট চায়না।
চীনের নিজস্ব উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টায় গঠিত এসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (এএসইএএন) এর অন্তভুক্ত ১০টি দেশ এবং তার পাশাপাশি জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে এই নতুন সুবিশাল এক বৈশ্বিক মুক্ত বানিজ্য জোট গঠন করা হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে সিঙ্গাপুরে ভার্চুয়াল মিটিং এ এসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (এএসইএএন) শীর্ষক সম্মেলনের সাইড লাইনে এই নতুন রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনোমিক পার্টারশীপ বা (আরসিইপি) জোট গঠনের চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। যার মূল আয়োজক ছিল ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী।
২০১৯ সালে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনোমিক পার্টারশীপ বা (আরসিইপি) বৈশ্বিক মুক্ত বাণিজ্য জোট চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়ে যায়। তবে সবাইকে অবাক করে চুক্তি বাতিল করে এই মুক্ত বানিজ্য জোট থেকে বেরিয়ে যায় বিশ্বের আরেক উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভারত। গঠিত এই নতুন অর্থনৈতিক জোটে ভারতের অংশগ্রহণের কথা থাকলেও চীনের সাথে চরম মাত্রায় বৈরিতা, সীমান্ত উত্তেজনা, ভারতের মাটিতে চীনা পন্যের বয়কট এবং সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার প্রবল আশঙ্কায় ভারতের মোদি সরকার আপাতত এই নতুন মুক্ত বানিজ্য জোটে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পারে বলে মনে করা হয়। তবে ভবিষ্যতে এই জোটে ভারতের অংশগ্রহণের সুযোগের পথ খোলা থাকছে।
রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনোমিক পার্টারশীপ বা (আরসিইপি) বৈশ্বিক মুক্ত বাণিজ্য জোটভুক্ত ১৫টি দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২২০ কোটি এবং তাদের সম্মিলিত অর্থনৈতিক বা জিডিপির আকার প্রায় ২৭.০০ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। যা কিনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক জোট কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা- ম্যাক্সিকো এই তিন দেশের সমন্বয়ে গঠিত মুক্ত বানিজ্য এলাকা অপেক্ষা অনেক বড় শুল্ক মুক্ত বানিজ্য জোট হতে যাচ্ছে। আর রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) নামে নতুন এই জোটের অর্থনীতির আকার হবে বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ।
২০২০ সাল হতে চলমান করোনা মহামারির ভয়ঙ্কর প্রভাবের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ‘আরসিইপি’ বাণিজ্য চুক্তি সহায়তা করতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। মুলত চুক্তিভুক্ত ১৫টি দেশ নিজেদের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক কমিয়ে, পন্য সরবরাহ ব্যবস্থার সুশৃঙ্খল উন্নতি করে নতুন ই-কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কাজ করবে এই জোট। আর চুক্তি অনুযায়ী আগামী বিশ বছরের মধ্যে ‘আরসিইপি’ মুক্ত বানিজ্য ভুক্ত ১৫টি দেশ নিজেদের মধ্যে অধিকাংশ আমদানি শুল্ক শুন্যে নামিয়ে আনতে কাজ করে যাবে। তাছাড়া টেলিযোগাযোগ, মেধাস্বত্ত্ব, ব্যাংক, বীমার মতো আর্থিক সেবা এবং ই-কমার্সসহ পেশাদারী সেবার মতো বিষয়গুলো থাকছে এই নতুন বৃহত্তম মুক্ত বানিজ্য জোট ‘আরসিইপি’ চুক্তিতে।
তবে এই নতুন মুক্ত বানিজ্য চুক্তিতে সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারণ করা হচ্ছে তা হলো ‘রুলস অব অরিজিন’। অর্থাৎ কোন দেশে থেকে পণ্য আসছে তার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারিত হবে এই চুক্তিতে। আর রুলস অব অরিজিনের সংজ্ঞায় পরিবর্তনের প্রভাব হতে যাচ্ছে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এবং বিশাল।
২০১২ সালে কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত এসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (এএসইএএন) শীর্ষক সম্মেলনে ‘আরসিইপি’ মুক্ত বানিজ্য জোট গঠন নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয়। তারপর বিগত আট বছরে ধরে চীনের প্রবল উৎসাহ এবং উদ্যোগে এখন এই নতুন মুক্ত বানিজ্য জোট বাস্তবে পরিণত হতে যাচ্ছে। তবে যাই হোক না কেন, মুক্ত বাণিজ্যের এই চুক্তিকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের নিজস্ব সুদূরপ্রসারী বানিজ্যিক প্রভাব বিস্তারের পথে একটি বড় ধরণের বিজয় বা সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
২০১৬ সালে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে টিপিপি নামে যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করেছিল তৎকালীন মার্কিন বারাক ওবামা সরকার। তবে পরবর্তীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে টিপিপি চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলে এই বানিজ্য জোট গঠন একেবারেই বাতিল হয়ে যায়। আর সেই শুন্যতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চীনের শি জিং পিং সরকার কার্যত এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে নতুন এই ‘আরসিইপি’ মুক্ত বানিজ্য জোট গঠন করে নিজের প্রভাব বিস্তার ও নিজস্ব শক্তিশালী বানিজ্যিক অংশীদার নিশ্চিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বলেই প্রতিয়মান হয়।
তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, চলমান করোনা মহামারির বিরুপ প্রভাবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ‘এএসইএএন’ জোটভুক্ত দেশগুলো যে ভয়াবহ মাত্রায় অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চীনের নেতৃত্বে এই নতুন ‘আরসিইপি’ মুক্ত বানিজ্য জোট গঠনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করার ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং সাম্প্রতিক সময়ে ঘোষণা করেছেন, চীন আগামী ১০ বছরে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো থেকে ২২.০০ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করবে।
বর্তমানে চীনের অভ্যন্তরীণ বার্ষিক পোশাক বানিজ্য বা বাজারের মূল্য প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তাছাড়া আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে চীনের অর্থনিতির আকার বা জিডিপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকিয়ে ৩০.০০ ট্রিলিয়ন ডলারের সীমাকে স্পর্শ করতে পারে। এদিকে দক্ষিণ চীন সাগর এবং বেশকিছু বিতর্কিত দ্বীপের মালিকানা নিয়ে চীনের সাথে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে অনেক দেশের চরম বৈরিতা এবং সামরিক উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও চীনের এই সুবিশাল বাজারে বাধাহীনভাবে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ার জন্য এশিয়ার বহু দেশ প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন প্রতি নিয়ত বিভিন্ন দেশের পন্যের উপর বাড়িত শুল্ক আরোপ করা এবং অন্য দেশের পন্য আমদানির উপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণে অধিকাংশ দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে এক রকম বাধ্য হয়ে চীনের সাথে নতুন শুক্ত মুক্ত বানিজ্য জোট গঠনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
তাছাড়া চলতি ২০২০ সালের করোনা মহামারির বিরূপ প্রভাবে দেশগুলোর সাম্প্রতিক নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা সংকুচিত হয়ে আসায় যে কোন ভাবেই হোক চীনের বাজারে প্রবেশ এবং শুল্ক মুক্ত বানিজ্যের সুযোগ তৈরিতে দেশগুলো কাছে আপাতত বিকল্প কোন পথ খোলা রয়েছে বলে মনে হয় না। এদিকে এই সুযোগে চীন তার সুদূরপ্রসারী বানিজ্যিক প্রভাব বিস্তারের পথ নিশ্চিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তবে যাই হোক না কেন অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন বাংলাদেশের অবশ্যই এই ধরণের বিশাল আকারের শুল্ক মুক্ত বানিজ্যিক জোটে প্রবেশ করার চেষ্টা করা উচিত। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই চীনের বাজারে প্রায় ৫ হাজার পন্যের শুল্ক মুক্ত প্রবেশের সুবিধা লাভ করেছে। যার সুফল হয়ত আগামী ২০২১ সালের মধ্যেই পেতে শুরু করবে বাংলাদেশ।
এদিকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুভাবাপন্ন এবং ভালো সম্পর্ক বজায় থাকলেও বানিজ্য ঘাটতি মোকাবেলায় ভারত কিন্তু বাংলাদেশকে তার বাজারে অবাধ শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দিতে মোটেও রাজি নয়। বরং বর্তমানে ভারত বাংলাদেশে ৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পন্য ও সেবা রপ্তানি করে গেলেও তার বিপরীতে বাংলাদেশ মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পন্য রপ্তানি করার সুযোগ পায়। আবার চীন বাংলাদেশে প্রতি বছর আনুমানিক ১৩ বিলিয়ন ডলারের পন্য, শিল্প কাঁচামাল, মুলধনী সাজ সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি রপ্তানি করলেও তার বিপরীতে বাংলাদেশ চীনের বাজারে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে পন্য রপ্তানি করে থাকে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.