--- বিজ্ঞাপন ---

ফিনল্যান্ড দখল করতে ব্যর্থ হয়েছিল রাশিয়া

অসম এক যুদ্ধের ইতিহাস

0

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর দিকে সারা ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধের দাবানল ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ১৯৩৯ সালের ৩০শে নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন এক রকম হঠাৎ করেই পার্শ্ববর্তী এক শান্তিপ্রিয় এবং অপেক্ষাকৃত দূর্বল দেশ ফিনল্যান্ড দখলের উদ্দেশ্য সামরিক আগ্রাসন চালায়। আর ফিনল্যাণ্ড দখলের এই ভয়ঙ্কর সামরিক আগ্রাসনে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিন সরকার ফিনল্যাণ্ডের সীমান্তে হাজার হাজার সামরিক যান, ট্যাংক এবং আর্টিলারীসহ প্রায় ৪,৬৫,০০০ স্থলসেনা এবং প্রায় ১,০০০ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে বসে। যার বিপরীতে ফিনিস সামরিক বাহিনীর ছিল ৩২টি ট্যাংক এবং ১১৪ যুদ্ধবিমান। তবে ফিনিশ-সোভিয়েত এই অসম যুদ্ধের শুরুতে সোভিয়েত বাহিনী স্থল এবং আকাশ পথে ব্যাপক হামলা চালিয়ে ফিনল্যাণ্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের একটি বড় অংশ দখল করে নেয়। তবে সোভিয়েত বাহিনীর সামরিক আগ্রাসনের মুখে নজিরবিহীনভাবে ফিনিশীয়রা খুব দ্রুত শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং বরফ বেষ্ঠিত স্ক্যানিভিয়ার দেশ ফিনল্যাণ্ডের সীমান্তের একাধিক রণাঙ্গনে সোভিয়েত বাহিনী বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়।
আসলে যুদ্ধের শুরু থেকেই ফিনল্যাণ্ড রণাঙ্গনে ৬৫ হাজার নিয়মিত ফিনিশ সেনার পাশাপাশি দেশটির অদক্ষ বেসামরিক ২ লক্ষের কাছাকাছি স্বেচ্ছাসেবক ফিনিশদের সমন্বয়ে গঠিত মিলিশিয়া বাহিনীর এক নজিরবিহীন প্রতিরোধ গড়ে তুলে। যার জন্য সমাজতন্ত্রী স্টালিন বাহিনী কিন্তু মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তারা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ফিনল্যাণ্ড দখলের ছক কষলেও বাস্তবে তা সভিয়েত বাহিনীর জন্য এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। মুলত ইউরোপের পুরো স্ক্যানিভিয়া অঞ্চল দখলের স্বপ্ন নিয়ে ফিনল্যাণ্ডে সামরিক আগ্রাসন চালাতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অবিশ্বাস্যভাবে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। স্বল্প সময়ের এক ভয়ানক যুদ্ধে সোভিয়েত স্টালিন বাহিনীর প্রায় ১,৬৭,৯৭৬ জন সেনা নিহত কিংবা নিখোঁজ হয় এবং আহত হয় আরো ২,০৭,৫৩৮ সেনা ও অফিসার। পাশাপাশি ধ্বংস হয় ৩ হাজার ট্যাংক ও আর্টিলারী সিস্টেম এবং পাশাপাশি ৫ শতাধিক যুদ্ধবিমান। যদিও ফিনল্যাণ্ডের পক্ষের ২৫ হাজার সেনা মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রায় ৪৪ হাজার সেনা আহত হন। আর ফিনিশীয় সেনা বহরে থাকা ৩০টি ট্যাংক ও ৬০টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়। তাছাড়া ফিনল্যাণ্ডের সেনারা সোভিয়েত বাহিনীর প্রায় ১১ শত ট্যাংক ও সামরিক যান দখল করেছিল।
ফিনিশ সেনাদের সাথে দেশপ্রেমিক সাধারণ ফিনিশীয়দের যুদ্ধে যোগ দেয়ার ফলে ফিনল্যাণ্ডের রনাঙ্গন সোভিয়েত হানাদার বাহিনীর জন্য এক মরণকুপে পরিণত হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ফিনিশদের কাছে সভিয়েত স্টালিন সেনাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো তেমন কোন ভারী অস্ত্র ছিল না। ছিল না কোন ট্যাংক বহর এবং শক্তিশালী আর্টিলারী ইউনিট। তবে ফিনিশীয়দের নিজস্ব কোন ভারি অস্ত্র না থাকালেও তাদের অস্ত্রের মূল যোগানদাতা বা উৎস ছিল সভিয়েত বাহিনী নিজেই। অর্থ্যাৎ বিভিন্ন রণাঙ্গনে ফিনিশীয় সেনারা সভিয়েত বাহিনীকে পরাজিত করে কিম্বা তাদের ব্যবহৃত সামরিক যান, ট্যাংক, আর্টিলারী এবং যুদ্ধাস্ত্র দখল করে বা হস্তগত করে সেই অস্ত্রই আবার সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল ব্যবহার করেছিল এক নজির সৃষ্টি করে।
তাছাড়া ফিনিশ সেনারা কাচের বোতলে পেট্রোল ভরে তাতে আগুন লাগিয়ে রাশিয়ান সেনাদের গাড়িতে এবং ক্যাম্পে হামলা করে আগুন লাগিয়ে ব্যাপক আকারের ক্ষতি সাধণ করে সভিয়েত বাহিনীর। এতে অসংখ্য সেনা অফিসার আগুনে পুড়ে নিহত কিম্বা আহত হয়। আবার আকাশ পথে হাজারো যুদ্ধবিমানের সহায়তায় ব্যাপক বিমান হামলা করলেও এই বিমান হামলায় সভিয়েত বাহিনী কার্যত হাজার হাজার সাধারণ বেসামরিক এবং নিরীহ মানুষ হত্যা ব্যাতিত উল্লেখযোগ্য তেমন কোন সফলতা লাভ করতে পারেনি। তাছাড় ফিনল্যাণ্ডের মাইনাস – ৪৩ ডিগ্রী হীমশিতল ঠাণ্ডা সভিয়েত বাহিনীর পরাজয়ের আরো একটি কারণ হতে পারে।
অন্যদিকে সোভিয়েত সেনাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েই স্টালিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ যায় হাজার হাজার সাধারণ ফিনিশীয়রা। এই অসম যুদ্ধে প্রায় সব রণাঙ্গনে সোভিয়েত হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে ফিনিশীয়রা তাদের সুদক্ষ স্কী বাহিনী এবং স্নো-হাইড স্নাইপারদের ব্যাপকভাবে কাজে লাগায়। আর এই ফিনিশীয় স্কী বাহিনী এবং স্নাইপার ইউনিট সভিয়েত স্টালিন বাহিনীর জন্য এক সাক্ষাৎ ‘মৃত্যুদূত’ বা ভয়ানক আতঙ্কের অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দেয়। কার্যত সোভিয়েত-ফিনিশীয় যুদ্ধ ছিল সম্মুখ যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি স্নাইপাই ইউনিট ব্যবহারের প্রথম কোন সফল উদাহরণ।
আবার স্নাইপার সেনা ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা স্লাইপার ছিলেন ফিনল্যান্ডের ‘সিমো হায়া’ নামে এক সাধারণ কৃষক। যিনি উচ্চতায় ছিলেন মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। ‘সিমো হায়া’ আসলে ফিনল্যান্ডের নিয়মিত সামরিক বাহিনীর সেনাবাহিনীর কোন সদস্য ছিলেন না। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক আগ্রাসন থেকে নিজ দেশকে রক্ষায় ফিনিশীয় সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন একজন অতি সাধারণ স্বেচ্ছাসেবক মুক্তিসেনা হিসেবে। ‘সিমো হায়া’ তার সাধারণ অতি মানের স্নাইপার দিয়ে প্রায় ৬০০ সভিয়েত সেনা সদস্যকে কনফার্ম কিলিং করেন। আবার কোন কোন হিসেব মতে এ সংখ্যা প্রায় ১ হাজারের কাছাকাছি। এখানে আরেকটি আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, সিমো হায়া যে সাধারণ মানের স্নাইপার রাইফেলটি ব্যবহার করেন তাতে কোন ধরণের ল্যেন্স লাগানো ছিল না। তিনি একেবারে চোখের আন্দাজে শত শত সোভিয়েত সেনা হত্যা করে স্টালিন সেনা শিবিরে চরম ত্রাসের সৃষ্টি করেন। অবশ্য যুদ্ধের শেষের দিকে তিনি সোভিয়েত সেনার গুলিতে মারাত্বকভাবে আহত হন।
তবে যাই হোক না কেন, যুদ্ধের কঠিন বাস্তবতা এবং ভয়াবহ বিপর্যয় উপলব্ধি করে সোভিয়েত প্রধান জোসেফ স্টালিন ফিনল্যান্ড দখলের চিন্তা বাদ দিয়ে সভিয়েত বাহিনীকে মস্কো ফিরে আসার চুড়ান্ত নির্দেশ প্রদান করেন। অবশেষে ১৯৪০ সালের ১৩ই মার্চ এক শান্তি চুক্তির আওতায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে (ইউএসএসআর) ফিনল্যাণ্ডের ১১% ভূমি ছাড় প্রদানের মাধ্যমে এক অসম যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.