--- বিজ্ঞাপন ---

চীন ও উত্তর কোরিয়াকে ঠেকাতে প্রতিরক্ষা খাতে জাপানের বিশাল বাজেট

0

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে রেড জায়ান্ট চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার ও সামরিক উপস্থিতিকে প্রতিহত করতে জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা’র সরকার গত ২১শে ডিসেম্বর ২০২০ ইং তারিখে রেকর্ড পরিমাণ ৫.৩৪ ট্রিলিয়ন ইয়েন বা ৫১.৭০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাজেট পেশ করে। যা কিনা চলতি ২০২০ সালের সামরিক বাজেট থেকে ১.১০% বেশি। যেখানে ২০২০-২১ অর্থ বছরে সালে জাপানের সামরিক বাজেট ছিল ৫০.৩ বিলিয়ন ডলার। আর বর্তমানে সুগা সরকারের পেশকৃত নতুন বাজেট পার্লামেন্টে অনুমোদন পেলে আগামী ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে তা কার্যকর হবে।

আসলে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন ও উত্তর কোরিয়ার সামরিক হুমকী মোকাবেলায় জাপান তার সেলফ ডিফেন্স ফোর্সকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য উন্নত এফ-৩৫বি/সি স্টিলথ জেট ফাইটার, দূরপাল্লার অ্যান্টি-শিপ মিসাইল এবং মিনি এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ তহবিল গঠন করতে টানা নবম বারের মতো সামরিক ও প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি অনুমোদন করেছে। তবে পার্লামেন্টের জাপানের সুগা সরকারী দলের নিজস্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ২০২১-২২ অর্থ বছরের ৫১.৭০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাজেটটি পাশ হওয়া এক রকম সুনিশ্চিত বলা চলে।

এদিকে দক্ষিণ চীন সাগর এবং এশিয়া কিংবা ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন ও উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসী সামরিক হুমকী এবং উত্তেজনার মুখে অত্র অঞ্চলের জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া মতো দেশগুলোর কাছ থেকে বিগত এক দশকে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক অস্ত্র সরবরাহের নতুন অর্ডার পেয়েছে মার্কিন জায়ান্ট ডিফেন্স কর্পোরেশনগুলো। আর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিনীদের এভাবে অস্ত্র ব্যাবসার বড় ধরণের সুযোগ করে দিচ্ছে চীন ও উত্তর কোরিয়ার অহেতুক সামরিক পেশি শক্তি প্রদর্শন ও লাফালাফি। পরোক্ষভাবে হলেও এটা মার্কিন প্রসাশনের জন্য একটি বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে বললেও মোটেও ভূল কিছু হবে না। কারণ জাপানের এই বিপুল পরিমাণ সামরিক বাজেটের একটি বড় অংশ চলে যাবে সরাসরি মার্কিনী ডিফেন্স জায়ান্ট কর্পোরেশনের পকেটে। জাপান ইতোমধ্যেই মার্কিন লকহীড মার্টিন কর্পোরেশনের কাছ থেকে ১৪২টি এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটার ও এডভান্স এন্টিশীপ মিসাইল পর্যায়ক্রমে ক্রয় করার বিষয়টি নিশ্চিত করার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে ‘শান্তিপ্রিয়’ দেশের খোলস থেকে বের হয়ে আরেক নব্য ভয়ঙ্কর সামরিক দানব হয়ে আত্মপ্রকাশ যে করবে না তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।

তবে প্রকাশ থাকে যে, দক্ষিণ চীন সাগরের একক মালিকানা দাবি এবং পূর্ব চীন সাগরের বেশকিছু দ্বীপ নিয়ে চীনের সাথে জাপানের চরম পর্যায়ের মতানৈক্য এবং বৈরি সম্পর্ক বিরাজ করায় চীন অতি দ্রুত এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে চীনের অহেতুক সামরিক হুংকার এবং এক গুয়েমী নীতির কারণে উত্তর কোরিয়া ব্যাতিত সমগ্র এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অধিকাংশ দেশই আজ চিনের প্রতি চরম বিরক্ত এবং আস্থাহীন। তাছাড়া এ অঞ্চলে বিশ্বের এক নম্বর সামরিক পরাশক্তি এবং অতি মাত্রায় যুদ্ধপ্রিয় মার্কিন বাহিনীর সপ্তম নৌ বহরের চলামান শক্ত উপস্থিতি এবং উস্কানিমূলক সামরিক কার্যকলাপ ভবিষ্যতে চীনের জন্য মোটেও ভালো কিছু হবে এমনটি আশা করাও কিন্তু হাস্যকর।

তাই চীনকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে মার্কিন প্রশাসন বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানার সাথে নতুন সামরিক জোট গঠনের পাশাপাশি দেশগুলোকে অতি উচ্চ মাত্রায় সামরিক সহযোগিতা এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর ঠিক এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে জেগে উঠছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেক ‘ঘুমন্ত দানব’ জাপান। যে কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সমগ্র এশিয়ায় প্রায় ৪ কোটি নিরীহ মানুষের গণহত্যা বা মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী। যাই হোক, সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে আরেক ঘুমন্ত সামরিক দানব জাপানের নব্য উত্থান এবং প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মুখে আগামী দুই দশকের মধ্যে চীন আবার ভয়াবহ রকমের জাপানী প্রতিরোধ বা আগ্রাসনের মুখে পড়তে পারে বলে আশাঙ্খা প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষ করে জাপানের জাতীয়তাবাদী সরকার খুব দ্রুত গতিতে জাপানিজ সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জাপান বিগত এক দশকে তাদের সামরিক বাজেট দ্বিগুণ করেছে। তাছাড় নিজস্ব প্রযুক্তির ডিফেন্স সিস্টেম এণ্ড ইকুইপমেন্ট তৈরিতে জাপান এখনই বিশ্বের অনেক দেশকে ছাপিয়ে গেছে অনেকটাই নিরবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক লকহীড মার্টিন কর্পোরেশনের কাছ থেকে জাপানের নতুন করে ১০০টি পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ লাইটনিং স্টিলথ জেট ফাইটার ক্রয়ের বিষয়টি ভবিষ্যতে চীনের জন্য এক অশুভ সংকেত বলা চলে। আর এই নতুন করে জাপানের মোট ১৪২টি এফ-৩৫ ক্রয় সংক্রান্ত বিলে অনেক আগেই অনুমোদন দিয়ে রেখেছিল মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন। আসলে জাপানিজ সেলফ ডিফেন্স এয়ার ফোর্স এবং নেভাল ইউনিট আগামী এক দশকে মোট ১৪২টি সুপার এডভান্স এফ-৩৪ এ/বি সিরিজের যুদ্ধ বিমান সার্ভিসে রাখতে ব্যাপক ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া নিরব ঘাতক খ্যাত জাপানের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি ‘সুরিউ’ ক্লাস স্টিলথ সাবমেরিন চীনের নেভাল ফোর্সের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং চ্যালেঞ্জিং হয়ে দেখা দিলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে বলে মনে হয় না।

তাছাড়া ভবিষ্যতে ১০০টি এফ-৩৫বি সিরিজের সর্ট টেক অফ ভার্টিকেল লিফটিং জেট ফাইটার বহনের জন্য মেরিটাইম সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের বেশ কিছু বড় আকারের যুদ্ধ জাহাজকে অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক উচ্চ প্রযুক্তির সমন্বয়ে হাইলী মডিফাইড করে মাঝারী আকারের এয়ার ক্র্যাফট ক্যারিয়ারে রূপান্তরের কাজ বেশ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে দেশটি। তবে বিশ্বের অন্যতম সামরিক সুপার পাওয়ার রেড জায়ান্ট চায়না এফ-৩৫বি স্টিলথ জেট ফাইটার বহনকারী ক্যারিয়ার তৈরিতে জাপানকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছে। আর জাপানের এহেন ক্যারিয়ার তৈরির পদক্ষেপেকে ” জাপানকে আগ্রাসী সামরিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করার জন্য দেশকে চালিত করবে” বলে আশাঙ্খা প্রকাশ করেছে চীনের শী জিং পিং সরকার।

বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর চীন বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৫০টি হেভি ডেস্ট্রয়ার ব্যবহার করলেও জাপানের সেলফ ডিফেন্স নেভাল ইউনিটে অত্যন্ত শক্তিশালী ২৯টি ডেস্ট্রয়ার, ১৯টি সাবমেরিন, ১০টি ফ্রিগেটসহ অসংখ্য রণতরী ও হাজারের কাছাকাছি যুদ্ধবিমান এক্টিভ রয়েছে। তবে সংখ্যার বিচারে জাপানের ডিফেন্স হার্ডওয়্যার সিস্টেম যথেষ্ট কম মনে হলেও প্রযুক্তিগত মান ও সক্ষমতার দিকে দিয়ে চীন অপেক্ষা জাপান কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই।

এ মুহুর্তে জাপানের হাতে কোন নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মনিউক্লিয়ার ওয়েপন্স বা অপ্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র না থাকলেও জাপান কিন্তু ঠিকই অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক সারা দেশ জুড়ে অসংখ্য উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট তৈরি সম্পন্ন করে রেখেছে। যদিও জাপানিজ সরকারের ভাষ্যমতে, জাপানের শতভাগ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে এ মুহুর্তে জাপানের হাতে যে বিপুল পরিমাণ ক্রয়কৃত প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম মজুদ রয়েছে এবং যে পর্যায়ের অত্যাধুনিক নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট হাতে রয়েছে তা ব্যবহার করে ভবিষ্যতে চীনের সাথে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শতাধিক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড তৈরি করতে সক্ষম বলে আশাঙ্খা করা হয়। তাছাড়া জাপান তার নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে অদূর ভবিষ্যতে চীনের সামরিক উত্থান এবং আগ্রাসন ঠেকানোর অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন প্রশাসনের ছত্রছায়ায় অত্যন্ত গোপনে লাগামহীনভাবে অতি ভয়ঙ্কর নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরি যে শুরু করে দিবে না তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।

আর আগামী এক দশকের মধ্যেই মার্কিন ছত্রছায়ায় এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বা উস্কানিতে বিশ্ব সমাজ খুব সম্ভবত আরেক ভয়ঙ্কর ‘সামরিক দানব’ হিসেবে বর্তমানে শান্তিপ্রিয় জাপানকে হয়ত নতুন করে দেখতে যাচ্ছে। যা কিনা ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবেই চীনের জন্য বড় ধরণের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। তার পাশাপাশি গোটা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে দীর্ঘ মেয়াদী শান্তি বা স্থিতিবস্থা মারাত্বকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে বলে আশাঙ্খা করা হয়।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.