--- বিজ্ঞাপন ---

ইন্দোনেশিয়ার সাবমেরিনটি আসলে কি রকম ছিল

0

ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর একটি ডিজেল ইলেক্ট্রিক চালিত এ্যাটাক সাবমেরিন কেআরআই নাঙ্গালা ৪০২ বালি দ্বীপের কাছাকাছি সাগরের ৮৫০ মিটার গভীরে ডুবে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সাবমেরিনে থাকা ৫৩ জন অফিসার এবং ক্রুর সকলেই অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। আসলে এতগুলো নিরীহ মানুষের অকাল মৃত্যু কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। গতকাল শনিবার ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর চিফ অব স্টাফ অ্যাডমিরাল ইউদো মারগোনো নিউজ মিডিয়ায় জানান যে, বালি দ্বীপের কাছাকাছি সাগরে সাবমেরিনের কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে এবং সাগরের বুকে তেল ভেসে থাকতে দেখা গেছে। তবে এখনো সাবমেরিনে থাকা নাবিকের মৃতদের উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।

ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর কাছে মোট পাঁচটি ডুবোজাহাজ রয়েছে। যার অন্যতম ছিল এই ‘নাঙ্গালা ৪০২’। এই দুর্ঘটনার নেপথ্যের কারণ নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় নৌ-বাহিনী। নিখোঁজ হওয়ার পর ইন্দোনেশিয়ার পাশাপাশি ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার পাঠানো কমপক্ষে ১২টি হেলিকপ্টার এবং জাহাজ মিলে ডুবোজাহাজটির খোঁজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই উদ্ধারকারী দলের একাংশের দাবি, আধুনিকীকরণের অভাবই এই ঘটনার জন্য দায়ী।

আসলে রুটিন মাফিক টর্পেডো মহড়ায় অংশ নিতে গিয়ে গত বুধবার নিখোঁজ হয় ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর কেআরআই নাঙ্গালা-৪০২ এ্যাটাক সাবমেরিনটি। সাবমেরিনটিতে ৭২ ঘণ্টা চলার মতো অক্সিজেন ছিল। তবে সাগরে ৮৫০ মিটার গভীরে তীব্র চাপে সাবমেরিনটি ধ্বংস হয়ে যায় বলে আশঙ্ক্ষা করা হচ্ছে। যেখানে সাবমেরিনটিকে সর্বোচ্চ ৫০০ মিটার পানির গভীরের চাপ সহ্য করার উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছিল।

জার্মানীর টাইপ ২০৯ সাবমেরিনের ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা কেআরআই নাঙ্গালা (৪০২) ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর দুটি কাকড়া শ্রেণির ডিজেল ইলেক্ট্রিক সাবমেরিনের ডুবোজাহাজের মধ্যে একটি ছিল। ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী ১৯৭৭ সালের সালে এটি অর্ডার করলেও এটি লাউঞ্চ করা হয় ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে এবং একাধিক বার সী ট্রায়াল শেষে ১৯৮১ সালের ২১শে অক্টোবর চূড়ান্তভাবে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীতে কমিশনিং লাভ করে। সে হিসেবে কেআরআই নাঙ্গালা (৪০২) এ্যাটাক সাবমেরিনটি ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীতে প্রায় ৪০ বছর সার্ভিসে ছিল। এটিকে প্রথমে ১৯৮৯ সালে এবং সর্বশেষ ২০১২ সালে বড় ধরণের মেরামত বা মেজর আপগ্রেডিং করা হয় এবং বেশকিছু নতুন প্রযুক্তি ও ওয়েপন্স সিস্টেম ইনস্টল করে এর সার্ভিস লাইফ টাইম বৃদ্ধি করে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী ব্যবহার করতে থাকে।

১,৩৯৫ টনের কাকড়া ক্লাসের এ্যাটাক সাবমেরিনটি তৈরি করে জার্মানীর বিখ্যাত হাওয়াল্ডসওয়ার্ক-ডয়চে ওয়ার্ফ্ট কর্পোরেশন। ১৯৮১ সালে সার্ভিসে আসার পর থেকে কেআরআই নাঙ্গালা এ্যাটাক সাবমেরিনটি ভারত মহাসাগর, পূর্ব তিমুর, ও নুনুকান রিজেন্সিতে সফলভাবে বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং নেভাল অপারেশনে অংশ নেয়। তাছাড়া সাবমেরিনটি বিগত চল্লিশ বছরে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর পক্ষে বিভিন্ন ধরণের নৌ মহড়ায় অংশ নেয়। যার মধ্যে সহযোগিতা ভাসমান প্রস্তুতি এবং প্রশিক্ষণ, যৌথ সামুদ্রিক অপারেশন অনুশীলন, এবং ইউএসএস ওকলাহোমা এর সাথে যৌথভাবে পাসিং অনুশীলন অন্যতম।

চলতি ২০২১ সালের ২১শে এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর কমাণ্ড সেন্টারের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সাবমেরিনটি বালি দ্বীপের কাছাকাছি সাগরের বুকে লাইভ টর্পেডো ড্রিল পরিচালনা করেছিল এবং নিখোঁজ হওয়ার আগে একটি সরাসরি টর্পেডো নিক্ষেপ করেছিল সাগরে। এই ঘটনার পর পরই ইন্দোনেশিয়ার এবং অন্যান্য দেশের একাধিক রেসকিউ জাহাজ সাবমেরিনটির সন্ধানে পাঠানো হয়। তবে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর নিজস্ব কোন সাবমেরিন রেসকিউ ভ্যাসেল না থাকায় বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায় উদ্ধার অভিযান। যদিও কমপক্ষে ৬টি যুদ্ধ জাহাজ, একটি হেলিকপ্টার ও ৪০০ লোক সাবমেরিন উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়।

কেআরআই নাঙ্গালা এ্যাটাক সাবমেরিন ১৯৮১ সালে সার্ভিসে আসায় এটি এ পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ বছর সার্ভিস দিয়েছে। অথচ এর সার্ভিস লাইফ টাইম আরো অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কারণ সাধারণত ডিজেল চালিত একটি এ্যাটাক সাবমেরিনের আদর্শ সার্ভিস লাইফ টাইম ধরা হয় ২৫-২৮ বছর এবং ১ থেকে ২ বার মেজর আপগ্রেডিং বা পূর্ণঃ মেরামত করে এর সার্ভিস লাইফ টাইম সর্বোচ্চ মোট ৩০-৩৬ বছর পর্যন্ত বর্ধিত করা যেতে পারে। তবে এই সময়ের পর সাবমেরিনটি গভীর সমুদ্রে দীর্ঘ মেয়াদে অপারেশনে ব্যবহার করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া বড় ধরণের প্রাণহানী এড়াতে এটিকে তার এক্সটেনশন সার্ভিস লাইফ শেষে একেবারে ডিকমিশনিং বা নেভাল ফ্লীট থেকে অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

যেভাবে সন্ধান মেলে

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুরের পাঠানো বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজের ‘স্ক্যান’ পদ্ধতির মাধ্যমে বালি উপকূলের অদূরে সমুদ্রের প্রায় ৮৫০ মিটার (২৮০০ ফিট) গভীরে নজরে এসেছে সেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত ডুবোজাহাজটির ধ্বংসাবশেষ। দেখা গিয়েছে, তিন ভাগে ভাগ হয়ে সমুদ্রতলে ছড়িয়ে রয়েছে অংশগুলি। যে জায়গা থেকে গত বুধবার নৌ-মহড়া শুরু করেছিল প্রায় চুয়াল্লিশ বছরের পুরনো ওই ডুবোজাহাজটি, সমুদ্রের নীচে তার প্রায় ১,৫০০ মিটার (ইয়ার্ড) দক্ষিণে সেটির সন্ধান মিলেছে বলে জানান নৌ-আধিকারিকেরা। কাঠামো, অগ্রভাগ এবং মূল অংশ— তিনটেই আলাদা হয়ে গিয়েছে বলে এ দিন জানিয়েছেন নৌবাহিনীর প্রধান উডো মার্গোনো। মূল অংশেও একাধিক চিড় ধরা পড়েছে। শনিবারই ডুবোজাহাজটির তলিয়ে যাওয়া সম্পর্কিত একাধিক চিহ্ন ও ধ্বংসাবশেষ নজরে আসায় সেটির নাবিকদের জীবিত উদ্ধারের আশা প্রায় শেষ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ধ্বংসাবশেষের পুরোটা খুঁজে বার করতে অব্যাহত ছিল তল্লাশি।

রবিবার ভোরের দিকে সমুদ্রের ৮০০মিটারেরও (২৬০০ ফিট) বেশ খানিকটা নীচ থেকে সিগন্যাল পেতে শুরু করেন উদ্ধারকারীরা। যে সূত্র ধরেই আরও গভীরে এগোয় তল্লাশি অভিযান। শেষমেশ সিঙ্গাপুরের পাঠানো ডুবোজাহাজ উদ্ধারে পারদর্শী বিশেষ জাহাজ ‘এমভি সুইফ্ট রেসকিউ’-এর’ মাধ্যমে সমুদ্রের প্রায় ৮৫০ মিটার (২৮০০ ফিট) গভীর থেকে তুলে আনা হয় ডুবোজাহাজটির ধ্বংস-চিত্র। এ দিনই উদ্ধার হয়েছে ডুবোজাহাজটির একটি নোঙ্গর ও নাবিকদের ব্যবহারের একাধিক ‘লাইফ জ্যাকেট’।

তবে এক্ষেত্রে ঝুঁকি এড়াতে সর্বোচ্চভাবে নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ সাবমেরিন হিসেবে নেভাল বেসের একেবারেই কাছাকাছি অগভীর সাগর এলাকায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিশ্বের অনেক নৌবাহিনী ব্যবহার করে থাকে। তাই আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী তার সাবমেরিন বহরে ৪০ বছরের অতি পুরনো কেআরআই নাঙ্গালা এ্যাটাক সাবমেরিনকে সার্ভিসে রাখাটা মোটেও ঠিক হয়নি বলে বিশেষজ্ঞদের মত। তাছাড়া নিজস্ব সাবমেরিন রেসকিউ ভ্যাসেল না থাকাটাও একটি প্রশ্নবিদ্ধ ইস্যু হয়ে থেকে যাচ্ছে। তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই ইন্দো্নেশিয়ার সরকার এবং তার নৌবাহিনী এক্ষেত্রে তাদের জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা কোনভাবেই এঁরাতে পারে না।

এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য নাবিকদের পরিবারের প্রতি বিশেষ সমবেদনা জানিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো।

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.