--- বিজ্ঞাপন ---

টালমাটাল নেপালের রাজনীতি, চীনের ওলি গেল আসার পথে ভারতপন্থী দেউবা

0

কাজী আবুল মনসুর

চীন আর ভারত কোন দিকে যাবে নেপাল। আর এ টানাপোড়েনে টালমাটাল এখন নেপালের রাজনীতি। চীনের সমর্থক বলে খ্যাত ওলি সরকারকে হঠিয়ে ভারত পন্থি বলে খ্যাত শেরবাহাদুর দেউবা এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে। চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতার  কারনে ওলি সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তাই চীন আর ভারতের দু’নৌকায় পা দিতে গিয়ে করোনা মোকাবেলায়ও ব্যর্থ হয় ওলি সরকার। ভারতের পর করোনার ছোবল এখন ছোট্ট দেশ নেপালে। প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে যেমন সাড়া পাওয়ার কথা নেপাল তা পাচ্ছে না। নেপালের বর্তমান অবস্থার জন্য ওলি সরকারকে দায়ি করা হচ্ছে। ফলে ঘটতে চলেছে রাজনৈতিক পালাবদল।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন, নেপালের বর্তমান সকংকটের মুল কারণ রাজনৈতিক। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং মাওবাদী কম্যুনিস্ট নেতা পুষ্প মকমল দাহালের নেতৃত্বাধীন কম্যুনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী কেন্দ্র) রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে ওলি সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় ওলি। মাওবাদীদের অভিযোগ ওলি সংবিধান লঙ্ঘন করেছে এবং তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে। এর আগে গত বছর কে পি ওলি দেশের প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিয়ে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা আবার বহাল করা হয়। এরকম অবস্থায়, মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল এবং নেপালি কংগ্রেস পার্টির নেতা শের বাহাদুর দেওবা যৌথভাবে ওলি সরকারের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং ওলি সরকারের পতন ঘটায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন, ওলির আমলে নেপালের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বেইজিংয়ের প্রভাব বেড়েছে অনেকাংশে। আর ভারত-চীনের মাঝে পড়ে টালমাটাল হয়েছে কাঠমান্ডুর রাজনীতি। গত বছর জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন-ভারতের উত্তেজনার মাঝে ভারতের সাথে নেপালের পুরানো সীমান্ত সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

এসময় চীন-ভারত সীমান্তের কাছাকাছি নেপালের কালাপানি এলাকায় ভারত সৈন্য সমাবেশ ঘটায় এবং নেপালদের ভূমি ব্যবহার করে রাস্তা নির্মান করে তা চালু করে দেয় নেপালের অনুমতি ছাড়াই। আর এ নিয়ে নেপালের সাথে ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা প্রকাশ্য রূপ নেয়। ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ দেখা দেয় নেপালে। এ অবস্থায় নেপাল সরকার কালাপানি অঞ্চলকে দেশের মানচিত্রে সুস্পষ্ট করে নতুন মানচিত্র ছাপে নেপাল সরকার। ওলির নেতৃত্বাধীন নেপালি পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট তা অনুমোদন করে।

এর আগে ২০১৫ সালে চীন-ভারত বাণিজ্য চুক্তিতে কালাপানি অঞ্চলের লিপুলেখ গিরিপথকে নেপাল-ভারত-চীনের ত্রিসঙ্গম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে নেপালের সাথে কোনও পরামর্শ করা হয়নি বলে নেপাল তাদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী ওলি ঘোষণা করেন কালাপানি অঞ্চলে ভারত কর্তৃক দখল করা নেপালি ভূমি পুনরুদ্ধার করা হবে। ওলির এমন ঘোষণা ভারত যে ভালোভাবে নেয়নি সেটা নয়া দিল্লী জানিয়ে দিয়েছে। তবে বিষয়টি এখন আর নেপাল-ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখানে চীনের স্বার্থ জড়িয়ে পড়ায় তা ত্রিমুখী সমস্যায় রূপ নিয়েছে।

এ অবস্থায় চীন না ভারত- কোন প্রতিবেশীর কী ধরনের বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক বা সীমান্ত প্রভাব কতটা নেপালকে উদ্বুদ্ধ বা উত্তেজিত করবে তার ওপর নির্ভর করছে দেশটির আগামীদিনের আভ্যন্তরীণ শান্তি ও অগ্রগতি।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে দেউবা
এদিকে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি সংসদের আস্থাভোটে পরাজিত হওয়ার পরে নতুন সরকার গড়ার দাবি পেশের জন্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভাণ্ডারী। তার পরেই নেপালে রাজনৈতিক তৎপরতা জোরদার হয়েছে। বুধবার রাত পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে অন্য কয়েকটি দলের সমর্থনে নেপালি কংগ্রেস নেতা শেরবাহাদুর দেউবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া প্রায় নিশ্চিত।

তবে অতীতে রাষ্ট্রপতি ভাণ্ডারীকে যে ভাবে ওলির পাশে দেখা গিয়েছে, তাতে সদ্যপ্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে সরকার গড়তে ডাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কোনও কোনও পর্যবেক্ষক। কারণ, সংখ্যালঘু হয়ে পড়লেও একক দল হিসেবে খাতায় কলমে তাঁর সমর্থক সাংসদের সংখ্যা এখনও সর্বাধিক। সে ক্ষেত্রে শপথ নেওয়ার এক মাসের মধ্যে ওলিকে গরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হবে। তবে নেপালের নবীন সংবিধানের যে ৭৬(২) ধারায় রাষ্ট্রপতি সরকার গড়ার নোটিস জারি করেছেন, তাতে দলের চেয়ে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কোনও সাংসদ নিজের সমর্থনে বিভিন্ন দলের যথেষ্ট সংখ্যক সদস্যের স্বাক্ষর সংবলিত দাবিপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করতে পারলে তবেই তা গ্রহণযোগ্য হবে।

ভারতের অভিযোগ, চিনপন্থী হিসেবে পরিচিত ওলি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। আবার নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভাবে ঘনিষ্ঠ। ওলি সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে যেমন পায়ে পা দিয়ে বিবাদ করেছেন, একের পর এক ভিত্তিহীন মন্তব্য করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছেন। আবার দলে ওলি যখনই আস্থার সঙ্কটে পড়েছেন, কূটনৈতিক প্রথা ভেঙে তাঁর সমর্থনে মাঠে নেমেছে চিন। এই পরিস্থিতিতে দেউবার সরকার কাঠমান্ডুতে ক্ষমতায় এলে অবশ্যই স্বস্তি পাবে দিল্লি।

নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ওলির পাশ থেকে সরে গিয়েছেন তাঁরই দলের পুষ্পকমল দাহাল এবং মাধব নেপালের নেতৃত্বাধীন সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। এই অংশ সরকার গড়তে নেপালি কংগ্রেস নেতা দেউবাকে সমর্থন করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া তরাইয়ের মদেশীয়দের ‘জনতা সমাজবাদী পার্টি-নেপাল’ দলের একটা অংশ দেউবাকে সমর্থন জানিয়েছে। সব মিলিয়ে নেপালি কংগ্রেসের সরকার পর্যাপ্ত গরিষ্ঠতা পাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তার পরেও কোনও কারণে সংখ্যা কম পড়লে অন্য একটি বিকল্পের কথাও ভেবে রাখা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কিছু ওলি-বিরোধী সদস্য ইস্তফা দিয়ে দেবেন। তা হলে মোট সাংসদের সংখ্যা কমে যাবে এবং দেউবা সহজেই গরিষ্ঠ অংশের সমর্থন পাবেন। নেপালি কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ওলির দলের প্রাক্তন নেত্রী রাষ্ট্রপতি ভাণ্ডারীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকাতেই তাঁদের আটঘাট বেঁধে এগোতে হচ্ছে, যাতে ওলি আর কোনও সুবিধা না-পেতে পারেন।
সোমবার (১০ মে) পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে হেরেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি। বিরোধী শিবিরের নেপালি কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওয়িস্ট সেন্টার)- দু’টি দলই প্রধানমন্ত্রী ওলির ওপর অনাস্থা এনেছে। এমনকি ওলির নিজের দল কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (ইউনিফাইড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) আইনপ্রণেতারাও ভোটদানে বিরত ছিলেন। নেপালের জনতা সমাজবাদী দলের আইনপ্রণেতাদের একাংশ ওলির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন।

দেশটিরে ২৭১ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে জয় পেতে প্রধানমন্ত্রী ওলির প্রয়োজন ছিল ১৩৬ ভোট। কিন্তু ওলির পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৯৩ জন; বিপক্ষে ভোট পড়েছে ১২৪টি আর ১৫ জন আইনপ্রণেতা ভোটদানে বিরত থাকেন। এ অবস্থায় শিগগিরই দেশটির প্রেসিডেন্ট নতুন সরকার গঠনের জন্য অন্য দলকে আহ্বান জানিয়েছেন।

২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নেপালে সরকার গঠন করেছিলেন ওলি। নতুন সংবিধান গ্রহণের পর দেশটিতে তিনিই প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (মাওয়িস্ট সেন্টার) আইনপ্রণেতাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন ওলি। এর মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল ওলির জোটের।
 করোনা সংকটে কাহিল নেপাল

নেপালে এ দফার রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে করোনা সংকটকে। ভারতের মতো মারাত্মক পরিস্থিতির শিকার নেপাল। ভয়াবহভাবে সংক্রমিত ভারত থেকে হাজার হাজার নেপালি পরিযায়ী শ্রমিক দেশে ফেরার পর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে নেপালে সংক্রমণের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে সংক্রমণের হার এখন ৪৭ শতাংশ যা বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ কাতারে

সোমবার (১০ মে) নেপালে একদিনে ৮,৭৭৭ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ সনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা চার লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। হাসপাতালে আইসিইউ এবং অক্সিজেন অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে। দেশটির স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা ভেঙে পড়েছে। ওদিকে হিমালয়ের বেস ক্যাম্প থেকে সম্প্রতি করোনাক্রান্ত ৩০ জন পর্বতারোহীকে উদ্ধারের পর এভারেস্ট চূড়ায় নেপালের সাথে পার্থক্য রেখা তৈরি করে দিয়েছে ওপারের দেশ চীন।

স্বাস্থ্যখাতে এমন বিপর্যয়কর অবস্থার জন্য দায়ী করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ওলির নেতৃত্বাধীন সরকারকে। বিরোধীদের অভিযোগ স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক দুর্নীতি এবং সময়মত করোনা ভ্যাক্সিন সংগ্রহ করতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কে পি ওলির সরকার। সূত্রঃ পার্স টুডে, আনন্দবাজার

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.