--- বিজ্ঞাপন ---

একজন মায়ের গল্প !!

0

কাজী ফেরদৌস

একদিন স্মৃতিচারন করে মা আমাকে বলেছিলেন একসময় আমাদের সুসময় ছিল তারপর আসল খারাপ সময় – আমার একপায়ে একটা সেন্ডেল আর এক পায়ে একটা খড়ম পড়েছিলাম।তবুও আমি কখনো কারও সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়নি। কেমন করে জানি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তবুও সম্মান ও মর্যাদার সাথে আমার জীবন পার করে দিলেন। হাজার শোকর গুজার।এত অভাবের মাঝে ও আমি কার ও কাছে হাত পাতিনি কখনো বরং চেষ্টা করেছি দাতা হতে।যথা সম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করেছি। উপদেশ হিসেবে বলেছিলেন কারও কাছ থেকে একটাকা নিলে খাতায় লিখে রাখবা এবং চাইবার আগেই ফেরত দিবা।অপরের হক কখনো বিনষ্ট করবা না।যতটুকু সম্ভব মানুষ কে দান করবা। তবে এমন করে দান করবা যেন নিজে আবার নিঃস্ব না হয়ে যাও।হাত একেবারে মুষ্টি বদ্ধ করে রাখা আল্লাহ পছন্দ করেন না।আবার একেবারে বেহিসেবী খুলে রাখা ও আল্লাহ পছন্দ করেন না। জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়।আর একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন ” চুরি করা বড় দোষ মনে যেন রয়, না বলিয়া লইলেই চুরি করা হয়। ” অন্যের কোন জিনিসের প্রতি লোভ খুবই খারাপ। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। এসব কঠিন কথা বুঝার বয়স তখনও আমার হয়নি।তবুও মরমে গেঁথে গিয়েছিল সেই শৈশবেই। বয়সকালে কথা গুলোর মর্ম উপলব্ধি করেছিলাম। এমনি একজন অসাধারণ পরিনামদর্শী মহিলা ছিলেন আমার মা।বাবা তখন অচল শয্যাশায়ী। আমরা তখন দুই বোন আর আমি। সাথে আমার বড় বৈমাত্রেয় এক ভাই ও এক বোন। সবাই কে তিনি পথের দিশা ঠিক করে দিতে পেরেছিলেন।আমার পেসকার চাচা তাঁর মেজো ছেলে কাজী রাফিক ভাইকে ও নাকি পাঠিয়ে ছিলেন আমার মায়ের কাছে। রফিক ভাই একটু ডানপিটে ছিলেন নাকি। তাই প্রবেশন করতে পাঠিয়েছিলেন।দুবছর ছিলেন। পরে সারগােদা স্কুলে চলে গিয়েছিলেন রাওয়ালপিন্ডিতে । ১৯৭৫ সালে হঠাৎ করে আমার মেজ বুবু মারা গেলেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নামীদামী ফার্নিচার ব্যবসায়ী দুলাভাই ও কপর্দকহীন হয়ে ছন্নছাড়া হয়ে গেলেন।মেজোবুবুর ছোট ছোট ছয় সাতটা বাচ্চা। সব গুলো কে মানুষ করার দায় বর্তাল আমার মায়ের উপর । তখন তাঁর বার্ধক্যের সময়।আমি সবে মাত্র চাকরি জীবন শুরু করেছি। তবুও হার মানার পাত্রী তিনি নন।কখনো এসব নিয়ে দুঃখ করতে বা হা হুতাশ করতে ও দেখিনি মা কে ।তিনি সবগুলো বাচ্চার শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্হা করলেন এবং মন্জিলে পৌঁছে দিতে পেরে ছিলেন। আমার বা আমার স্ত্রীর ভুমিকা ছিল শুধু সহযোগীর। তিনি সবসময় মনে করতেন এসব খোদার মর্জি। মা একদিন আমাকে বলেছিলেন তুমি ইচ্ছে করলেও কাউকে খাওয়াতে পারবে না যদি আল্লাহ তোমাকে সেই সুযোগ না দেয়।আসলে কথা গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের রিজিকের মালিক কখনো মানুষ হতে পারে না। মানুষ হয়তোবা একটা মাধ্যম।
মা আমার একেবারে স্বল্প শিক্ষিত ছিলেন কিন্তু একই সাথে স্বশিক্ষিত।পুরো গ্রামের লোক তাঁকেই একমাত্র শিক্ষিতা মহিলা হিসেবে মানতেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন জ্ঞান অর্জনের।তাই ধর্ম দর্শন রাজনীতির অনেক খবর রাখতেন।নিয়মিত সংবাদ পত্র পড়তেন। বই পড়তেন ।অনেক উচ্চ শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা অবাক হতেন তাঁর মননের গভীরতায়।
তিনি যেমন উদার ছিলেন তেমনই ছিলেন কঠোর। কখনো তিনি বিবেকের বিরুদ্ধে আপোষ করেন নি।এবং সবসময় তাঁর ইচ্ছাই জয়ী হয়েছে।
তিনি আজীবন একজন আশেকে রসুল ছিলেন। এবং ছিলেন আল্লাহর দয়া ও রহমতের উপর অসীম আস্হাশীল। তাই জীবনের কোন পর্যায়ে হতাশ এবং ম্লান হতে দেখিনি তাঁকে । বিশ্বাসে ছিেলন তিনি অটল এবং দৃঢ়। তিনি দশবছর অসুস্থ স্বামীর সেবা করেছেন।তাই তিনি কষ্ট টা খুব ভালো করে বুঝতেন।তাই তিনি সবসময় আল্লার দরবারে প্রার্থনা করতেন একটি কষ্টহীন মৃত্যু। এবং অন্যের গলগ্রহ হওয়াটা কে ভীষণ ভয় করতেন। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা তাই মঞ্জুর করেছিলেন।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাঁটাচলা করেছেন।তিরানব্বই বছর বয়সে একেবারে তেমন কোন কষ্ট ছাড়াই তিনি বিদায় নিয়েছিলেন বার বছর আগে পবিত্র দশই রমজান মাসে।জীবনের শেষ দিকে তাঁর ভরসাস্থল ছিল তাঁর একমাত্র পুত্রবধূ।চোখের আড়াল করতে চাইতেন না সহজে। দুএকদিন বাইরে কোথাও গেলে অস্হিরতায় ভোগতেন।কতবার যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ও বাইরে যাওয়া হয়নি মা’র অস্হিরতার কারণে।
আমি মায়ের একমাত্র সন্তান। মা’র সংশয় ছিল আমি বাঁচব কিনা কারণ ছোট বেলায় আমি নাকি খুব অসুস্থতায় ভুগতাম।বাবার কাছে লেখা তাঁর কিছু চিঠি পত্রে এধরনের আশংকার কথা আমি বহু বছর পরে জেনেছি। এর আগে মায়ের দুটি পুত্র সন্তান অকাল মৃত্যু বরণ করেছিল।প্রথম টি জন্মের ছয় মাসের মাথায় ।সবচেয়ে প্রিয়টি দশ বছর বয়সে। সেই শোক মা কখনো ভুলতে পারেন নি ।সুতরাং মায়ের দুর্ভাবনার পটভূমি বোধগম্য ।আবার একসময় আমার ভয় ছিল আমার মায়ের আগে আমি চলে যাব কিনা!তখন আমার ও সময় খুব খারাপ যাচ্ছিল।তই ভাবতাম আমি চলে গেলে মা কে দেখবে কে?এটা এক ধরনের দুশ্চিন্তা আমাকে মাঝে মাঝে তাড়া করতো।
মা চলে গেছেন বার বছর হলো।আমি এখনো দিব্যি বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার আসল কাজতো শেষ হয়ে গেছে। মা কে সসম্মানে বিদায় দিয়েছি। আমার আর কি কাজ?
জীবনে মায়ের কাছেই আমার সকল নৈতিক শিক্ষা। আমার যা কিছু ভালো সবই আমার মায়ের কাছে পাওয়া।চলতে ফিরতে মুখে মুখে মা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন যা এখনো আমার পাথেয়, আমার জীবনের চলার পথের সম্বল। তবে এটা অনস্বীকার্য মায়ের একটা গুণ আমি রপ্ত করতে পারিনি কখনো — কঠোর দৃঢ়তা ও সংকল্প।এদিকটায় আমি অনেক টা বাবার মতো ছিলাম । কিছু টা উদাসীন এবং বৈষয়িক বুদ্ধিহীন এবং অনেক টা Lavish! কথায় আছে না – বাপকা বেটা সিপাহি কা ঘোড়া! তাই হয়তো লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে অনেক টা পিছিয়ে গেছি । আকাশ ছোঁয়া ইচ্ছা ছিল কিন্তু দৃঢ ইচ্ছা শক্তি ছিল না। অবশ্য তার অন্য কারণ ও ছিল। যেসময় টা মা আমার কাছে থাকা খুব জরুরি ছিল তখন আমি মা’র কাছ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম অথচ সময়টা ছিল জীবনের উন্মেষ কাল।এটা আমরা জীবনের অপূরনীয় ক্ষতি যা আর পুরণ করা যায়নি। তবুও যেটুকু অর্জন তাও মায়ের দোয়া। অবশ্য আরও একটি কারণ থাকতে পারে। মা জীবনের জৌলুশ চাকচিক্য ঝাঁক ঝমক পছন্দ করতেন না।তিনি সুফির মতো জীবন যাপন পছন্দ করতেন। এক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ পুরুষ তাঁর প্রিয়নবীজী এবং প্রিয় শশুর ছুফী মওলানা আবদুল মজিদ যিনি গত শতকের গোড়ার দিকে একজন প্রখ্যাত মোহাদ্দেস ছিলেন । যদিও শশুর মশাই কে তিনি কখনো দেখেননি।
হয়তো আমার জীবনের সাফল্যের সীমানা টা ও তাঁর ইচ্ছার প্রতিফলন। আমি খ্যাতি প্রতিপত্তির জন্য চেষ্টা কম করিনি। তিনি অনেক বারন করেছিলেন।তিনি আমাকে সীমার মধ্যে থাকতে বলেছিলেন আমি অসীমে বিচরণ করতে চেয়েছিলাম। আমি সফল হয়নি। তাঁর বেঁধে দেওয়া সীমানা অতিক্রম আমি করতে পারিনি। আজ কেন জানি মনে হয় এই সীমাবদ্ধতার মাঝেই আমার মুক্তি।
যাঁর অপরিসীম আত্মত্যাগের কারণে অনেকের জীবনের সাফল্যের সোপান রচিত হয়েছে তারা সবাই আমার মা কে মনে রেখেছে কিনা ঠিক জানি না। কিন্তু আমিতো তাঁর নাড়িছেড়া ধন আমি ভুলতে কি পারি? চলতে ফিরতে তাই মনে পড়ে তাঁর কথা – দুঃখিনী মায়ের স্মৃতি, যিনি অনেক অভাবের মাঝে ও সাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। বিশাল মানসিক ঐশ্বর্যের মাঝে ডুবে ছিলেন। দুঃখ বেদনার গ্লানি যাঁর হৃদয় কে এতটুকু স্পর্শ করতে পারেনি। আমার মায়ের জীবনের গল্প আমার কাছে এক অসাধারণ মায়ের একজন সুফি সাধকের জীবনালেখ্য।
একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করে গেছি সারাজীবন। আমার মা কখনো আমার বাবার সম্পর্কে ভুলেও কখনো কোন অভিযোগ বা অনুযোগ করতেন না। কেউ কিছু বললেও রাগ করতেন। অথচ বাবার অদূরদর্শীতা এবং বৈষয়িক বুদ্ধি বিবেচনার অভাব ছিল মা’র দুঃখ বেদনার অন্যতম কারণ। আমাদের বাড়ির রগচটা রাগী ও মেজাজী নুর আহমদ মিস্ত্রি চাচা কে সবাই ভয় করতেন। তিনি ছিলেন খুব স্পষ্টবাদী মানুষ। তিনি আমার মা কে খুব সমীহ করতেন।সবার কাছে বড় গলায় বলতেন জান! খায়ের মিঞার বউ হলো সাক্ষাৎ বিবি রহিমা!
মা আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার মহান রব আপনাকে অবশ্যই জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ দরজা নসীব করবেন এটা আমার বিশ্বাসের অঙ্গ। কারণ আপনি সদাসর্বদা আপনার রবের প্রতি অনুগত ও কৃতজ্ঞ ছিলেন। ছিলেন একজন আশেকে রসুল।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.