--- বিজ্ঞাপন ---

ফিলিস্তিনবাসীর রক্ত ঝরছে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আরববিশ্ব

0

ফিলিস্তিনিদের বাচাঁর একটি জায়গা হলো গাজাঁ। আর এই গাজাঁ দখলের জন্য বছরের পর বছর ধরে মরিয়া ইসরাইল। একের পর এক হামলা করে ফিলিস্তিনিদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার মিশনে নেমেছে ইসরাইল। এই মিশন সফল করতে আন্তর্জাতিকভাবে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে ফিলিস্তিনকে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল বলে বুঝানো হচ্ছে। ইসরাইলের তল্পিবাহক বাহক রাষ্ট্রগুলো নানাভাবে ইসরাইলকে সহযোগিতা করলেও ফিলিস্তিন মুসলিমদের রক্ষার জন্য আরব দেশগুলো কখনও এক হতে পারে নি। বরং আরব দেশগুলোর মধ্যে অনেক রাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষে কাজ করছে এটাই এখন বাস্তবতা।

২০০৮ এর ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ এর জানুয়ারী মাস পর্যন্ত গাজাঁর উপর ইসরাইলের হামলা ছিল। এ হামলার নাম ছিল ‘অপারেশন কাষ্ট লিড’। তিন বছর গাজাঁর মানুষ শান্তিতে ছিল। কিন্ত ২০১২ সালের নবেম্বরে আবারও হামলা। ৮ দিনের এ হামলার নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন পিলার অব ডিফেন্স’। এর পর শুরু ২০১৪ সালের ভয়াবহ হামলা। নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’। মনে হচ্ছে সেই  ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’ এখনও চলছে।

মূলত ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’ হলো ইসরাইলের গাজাঁ ধংসের অভিযানের নাম। এ নাম দিয়ে মাসব্যাপি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় ২০১৪ সালে। থেমে থেমে চলে এই অপারেশনের কাজ। একের পর এক হামলা। ইসরাইলীদের ভাষায়, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘হামাস’ কে শেষ করার জন্য তাদের এই অভিযান। চিরতরে হামাসকে নির্মূল করাই তাদর লক্ষ্য। ইসরাইল তাদর মিত্র সাম্রাজ্যবাদি শক্তিদের একথা বুঝিয়ে হামলার পর হামলার অব্যাহত রেখেছে। নীরব দর্শকের মতোন চেয়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে সব দেশ কথা বলার কথা তারাও নীরব। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও উন্নত রাষ্ট্রগুলো তো বটে, অবাক করার মতো বিষয় হলো আরব রাষ্ট্রগুলোরও সমর্থন নাকি ইসরাইলের পক্ষে! যদিও লোক দেখানো কিছু দায়িত্ব তারা পালন করে।
৬,২২০ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। বছরের পর বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে তারা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। পাশেই রয়েছে ২২ হাজার বর্গকিলোমিটারের ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। ভুখন্ড দখল বেদখল জনিত সমস্যা নতুন কিছু নয়। ইসরাইল কোনভাবেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মেনে নিতে পারছে না। বছরের পর বছর ধরে চলছে ইসরাইলের থাবা। ফিলিস্তিনদের গাজাঁ পরিপূর্ণভাবে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রনে নেবার জন্য গত ৫০ বছরে ডজনখানেক বড় ধরনের লড়াই হয়েছে। ইসরাইলের শক্তি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো। প্রথম প্রথম আরব রাষ্ট্রগুলো পাশে ছিল ফিলিস্তিনিদের। কিন্ত একসময় তারা চুপ মেরে যায়। তার অন্যতম কারন হলো ‘হামাস’ । হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে ইসরাইল-আমেরিকাসহ আরব রাষ্ট্রগুলোও! ফলে হামাসকে ধংস করতে হবে যে কোন মূল্যে। তাই বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সমর্থন নিয়ে গাজাঁ ধংসের কাজে নেমে পড়ে ইসরাইল। চলছে বিরতিহীন ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’। আসলে কি হামাস ধংসই তাদের লক্ষ্য। নাকি গাজাঁ দখল? এ প্রশ্ন এখন ঘুরে ফিরে আসছে। নির্বিচারে বোমা হামলা করে গাজাঁকে ফিলিস্তিনবাসী শূন্য করার মিশন চলছে। হামাস ধংসের নামে গাজাঁর নিয়ন্ত্রন নেয়াই ইসরাইলের প্রধান লক্ষ্য।
ইহুদী-মুসলিম দ্বন্দ্ব বহু বছরের পুরানো। কি করে এক জায়গায় দু’জাতি এলো তা নিয়ে রহস্যের বেড়াজাল তো রয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, ইসরাইল উড়ে এসে জুড়ে বসে যায়। তাদের পেছনের শক্তিরাই আরব বিশ্বে এমন একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঢুকিয়ে দিলো। ১৯৪৭ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিন আরব বিশ্বের এ অঞ্চলের মানুষগুলো শুনতে পেলো, যুগ যুগ ধরে বাস করা ফিলিস্তিন জাতি উচ্ছেদ হবে। কারন জাতিসংঘের ব্যবস্থা মতে, ভাগাভাগি হয়ে গেছে মাটি। তেলআবিব থেকে হাইফা নেবে ইহুদিরা। এখানে ছিল বৃটিশদের আর ফিলিস্তিতিদের রাজত্ব। অপরদিকে ওয়েষ্টব্যাংক, গাজাঁ, গালিলি হবে ফিলিস্তিনিদের। মাঝখানে জেরুজালেম থাকবে আর্ন্তজাতিক শাসকদের হাতে। ১৯৪৮ সালের ১৪মে বৃটিশরা পাততাড়ি গুটায়। ঘোষিত হয় নতুন দেশ ‘ইসরাইল’। আর ইসরাইলের জম্মের সাথে সাথে জ্বলে উঠে লড়াই। হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে অস্ত্র। শুরু হয়ে মাতৃভুমি রক্ষার সংগ্রাম। কিন্ত যুদ্ধে আর জেতা হয় না। ইসরাইল নামক দানবটি দখল করতে শুরু করে একের পর এক ভুখন্ড। আরব বিশ্বও থেমে থাকে না। জর্ডান, মিশর, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, সৌদিআরব, ফিলিস্তিন সবাই এক সাথে ভুমি দখলের প্রতিযোগিতায় নামে। যারা ফিলিস্তিনিদের লোক বলে পরিচিত সেই জর্ডান নিয়ে গেল ওয়েষ্ট ব্যাংক, মিশর নিয়ে নিল গাজাঁ।’ এভাবে চলছিল ইতিহাস। ৪৮ এ আরব-ইসরাইল লড়াইয়ের পর বিভিন্ন দেশের কোণে কোণে গড়ে উঠছিল ফিলিস্তিনিদের বসতি। নীরবে গড়ে উঠে বিভিন্ন শিবির। সে সব শিবির থেকেই আক্রমন শানিত হতে থাকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে।

১৯৬৪ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের এর নেতৃত্বে তৈরি হয় আরব লীগ। আর এই আরব লীগের ছাতার তলায় জন্ম নেয় ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)’। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল হানা দেয় মিশরের উপর। কিন্ত জর্ডান-মিশর মিলেও ইসরাইলকে পরাজিত করতে পারেনি। মূলত জর্ডান-মিশরের পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে পিএলও নিজেদের অল্পসংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে আরব লীগের ছাতা থেকে বেরিয়ে আসে। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকে পিএলও। ইয়াসির আরাফাতের উত্তানকে স্বাভাবিকভাবে নেয় নি অনেক আরব দেশ। ১৯৭০ সালে ফিলিস্তিনি গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমন চালায় জর্ডান। ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ক্রেকডাউন’ নামে জর্ডানের আক্রমনে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। জর্ডানের এ কাজে খুশি হয় ইসরাইল। ফিলিস্তিনিরা এতদিন মনে করেছিল, ইসরাইল বুঝি তাদের একমাত্র শক্র। কিন্ত জর্ডানও তাদের ছাড় দেবার পাত্র নয়। জর্ডানের পর ইসরাইল আর বসে থাকে না। ১৯৮২ সালে লেবানন আক্রমন করে বুঝিয়ে দিল তারা ওঁত পেতে আছে সব সময়। ইসরাইলের পেছনে আমেরিকানদের সমর্থন প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে। আরাফাতকে ধরার জন্য ইসরাইল যখন মরিয়া তখন আলজেরিয়ায় বসে ১৯৮৮ সালে ‘ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং জেরুজালেম তার রাজধানী’ বলে ঘোষণা দেয় পিএলও। ১৯৮৯ সালে আরাফাতই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সেই থেকে ফিলিস্তিনিদের যাত্রা শুরু। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনিদের পাশে এসে দাড়ালো। ১৯৯৩ সালে আমেরিকা, ইসরাইল ও নরওয়ের সাথে পিএলও’র বৈঠকে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো ফিলিস্তিনিদের বড় একটি অংশ। ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আরাফাতের ‘অসলো চুক্তি’ মেনে নেয়া তার জন্য কাল হয়ে দাড়ালো। ইসরাইলের কাছে এ রকম আত্মসমর্পন মেনে নিতে পারেনি গেরিলাদের বড় অংশ। ১৯৯৪ সালে জন্ম নিল ‘হরকাত আল মুকাওয়াম্মাহ আল ইসলামিয়া (হামাস)’। তারা শপথ নিল, ইসরাইলকে জঙ্গি পথেই ক্রমে ক্রমে মারা হবে। আত্মঘাতি হওয়ার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের কাছে নাম লেখাতে থাকলো হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। আর ইসরাইলে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো মানববোমার ভীতি। হামাসের জন্মের পরও দীর্ঘদিন আরাফাতের কারনে বড় ধরনের যুদ্ধ ইসরাইল করেনি। আরাফাতের মৃত্যুও পর ‘হামাস’এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ভীতি বাড়ে ইসরাইলেও। ২০০৮, ২০০৯, ২০১২ সালে ইসরাইল গাজাঁয় হামলা চালায়। ২০১৪ সালে এসে বড় ধরনের হামলা শুরু করে। সেই হামলা মাঝে মাঝে বন্ধ থাকলেও একসময় পুরোদমে শুরু হয়। ২০১৪ সালের পর এবার ২০২১ সালে এসে আবারও ইসরাইল পুরানো রূপে ফিরে আসে। একের পর এক হামলা চলছে। ফিলিস্তিনবাসীর রক্ত ঝরছে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আরববিশ্ব।
ইসরাইল গাজাঁর বিপুল ভুখন্ড দখল করে আছে। ওয়েস্ট ব্যাংক, গাজাঁ, পূর্ব জেরুজালেম, গোলান হাইটসে ইসরাইলের নুন্যতম অধিকার নেই। গাজাঁ দীর্ঘসময় ধরে ইসরাইলী সেনাবাহিনী দ্বারা অধিকৃত ছিল। স্বাধীন ফিলিস্তিন হবার পর তাদের ভুখন্ড ছেড়ে দিতে হবে। কিন্ত ইসরাইল যে কোন মূল্যে গাজাঁ দখলে রাখতে মরিয়া। তারা চাইছে গাজাঁ ফিলিস্তিন শূন্য করে পুরোটা দখল করা। তাই ২০১৪ সালে ১৫০০ বিমান নিয়ে গাজাঁ দখলে মরিয়া হয়ে উঠে ইসরাইল। গাজাঁয় ইসরাইলের মৃত্যুর হোলিখেলা থেমে নেই। নিহত আহতদের সামাল দিতে পারছে না গাজার হাসপাতালগুলো। লাশের সারি বাড়ছে। কোল্ড স্টোরেজে যেখানে খাদ্য দ্রব্য রাখার কথা সেখানে এখন লাশের স্তুপ। কতটুকুন জায়গা গাজাঁ। গত কয়েক বছরে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ বাড়ী ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। আবার শুরু হয়েছে পালানো।

জাতিসংঘের রির্পোট অনুযায়ী, ২০১৪ সালের হামলায় মারা যাওয়াদের ২৯ শতাংশ শিশু। স্কুলে আশ্রয় নিয়েও রক্ষা পায় নি অনেক নিরীহ মানুষ। সে সময় পিএলও ইতিমধ্যে হামাসকে অস্ত্র বিরতিতে রাজী করায়।   তখন গাজাঁর সরকারী রির্পোটে বলা হয়, ইসরাইলী হামলায় ৫০০০ বাড়ী সম্পূর্ণ ধংস হয়ে গেছে। ভেঙ্গে গেছে ২৬ হাজার বাড়ী। ৪৯টি ত্রান শিবিরে ৬০ হাজারেরও বেশি শরনার্থী। ৮১ হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে দিন কাটিয়েছে।
ইসরাইল যে গাজাঁয় যুদ্ধাপরাধ করে চলেছে তা বিশ্বের পরাশক্তিরা দেখেও দেখছে না। অনেকে ইসরাইলকে যুদ্ধ থামাতে বললেও ইসরাইল পাত্তা দিচ্ছে না। ফলে লাশের সারি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শিবির ইসরাইলকে আড়াল করতে তৎপর। মুখে ইসরাইলের নিন্দা করলেও প্রকৃতপক্ষে ইহুদীদের সম্প্রসারন নীতির সমর্থক তারা। এ কারনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো বাইডেনও বিবৃতি দেন ‘ইসরাইলেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে’ তখন বিশ্ব বিবেকের কি বলার আছে। ইসরাইলের আত্মপ্রকাশের ৭১ বছর পরও ভুমি দখলের আগ্রাসন থেকে তারা পিছপা হচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদের শেষপরিনতি কি হয় এটাই এখন দেখার বিষয়।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.