--- বিজ্ঞাপন ---

ইরান কেন আকাশ পথে শক্তি বাড়াচ্ছে না

0

ইরান বর্তমানে তার নিজস্ব প্রযুক্তির শতাধিক কমব্যাট ও নন কমব্যাট ড্রোন সার্ভিসে আনার পাশাপাশি হেসা শায়েখ, হেসা সিক্কা, আজরাশায়েশ ইত্যাদি অদ্ভুদ বা বিদঘুটে নামের সেই ষাটের দশকের মার্কিন এফ-৪ কিংবা এফ-৫ এর ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে প্রায় ৩৬টি হালকা যুদ্ধবিমান তৈরি করলেও প্রতি বছর গড়ে ১০টি করে যুদ্ধবিমান বা এরিয়াল সিস্টেম ধ্বংস হয়ে আজ ইরানের বিমান বাহিনীর প্রকৃত আকার ও সক্ষমতা যথেষ্ঠ ভাবে কমে এসেছে। বর্তমানে ইরানের বিমান বাহিনীতে সক্রিয় রয়েছে আনুমানিক ৩০টি মিগ-২৯, ২৪টি এফ-১৪ টমক্যাট, ৪৭টি এফ-৪ (ফ্যান্টম-২), ২৫টি এফ-৫, মিরেজ এফ-১ ৩০টি, এসইউ-২২ ২০টি, এসইউ-২৪ ৩০টি, চাইনিজ এফ-৭ ২৪টি, এসিউ-২৫ ৬টি। তাছাড়া নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি হেসা আজরাশায়েখ ৬টি, হেসা কাউসার ৭টি, হেসা শায়েখ ৯টি। সামরিক পরিবহণ বিমান রয়েছে প্রায় ১০০টি এবং জেট ট্রেইনার রয়েছে ১৪০টি। হেলিকপ্টার বহরের মধ্যে রয়েছে বোয়িং চিনুক সিএইচ-৪৭ প্রায় ৪০টি, বেল-২১৪ রয়েছে ৭০টি, বেল-২১২ আছে প্রায় ৫০টি এবং বেল-২০৬ রয়েছে ৬টি। তাছাড়া ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ২১টি এমআই- ১৭১ এবং ৩টি এমআই-১৭বি-৫ সামরিক পরিবহণ হেলিকপ্টার সরবরাহ করেছিল ইরানের মিত্রদেশ রাশিয়া।

ইরানের সাথে রাশিয়া এবং চীনের গভীর দীর্ঘ মেয়াদী সামরিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক বিদ্যামান থাকা সত্ত্বেও তারা যে কেন অতি পুরনো ষাটের দশকের মার্কিন এফ-৪ কিংবা এফ-৫ এর আদলে নিজস্ব  হেসা শায়েখ বা হেসা কাউসারের মতো নিম্ন মানের লাইট জেট ফাইটার তৈরির পিছনে পরে রয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়। অথচ মার্কিন এফ-৪/৫ এর প্রডাকশন লাইন প্রায় চার দশক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। আর এহেন কিছু নিম্ন মানের অতি পুরনো জাঙ্ক জেট প্রকাশ্যে এনে ইরান কার্যত নিজেকে বিশ্বের সামনে হাস্যকর পাত্রে পরিণত করে যাচ্ছে এবং তা কোন ভাবেই ইসরাইল, সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল আকারের এয়ার ফ্লীটকে এককভাবে কিম্বা যৌথভবে প্রতিহত করার মতো কোন শক্ত অবস্থানে রয়েছে বলে মনে হয় না।

যেখানে রাশিয়া এবং চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে স্বল্প পরিসরে হলেও রাশিয়ান প্রযুক্তির এসইউ-৩০ এডভান্স জেট ফাইটার নিজ দেশেই ম্যানুফ্যাকচারিং বা এসেম্বলি করার অনেক সুযোগ ছিল। আর সেটা সম্ভব না হলেও বিগত দুই দশকে রাশিয়া থেকে সরাসরি ১০০টি পর্যন্ত এসইউ-৩০ এবং চীন থেকে ৩৬টি জে-১০বি/সি সিরজের যুদ্ধবিমান ক্রয়ের যথেষ্ঠ সুযোগ থাকলেও তা কোন এক অদৃশ্য কারণে করা হয়নি। আবার মার্কিন জটিল অবরোধের মুখে চীন থেকে আশির দশকের এফ-৭ ব্যাতিত আজ অবধি কোন ধরণের নতুন জেট ফাইটার আমদানি করতে পারেনি ইরান।

মধ্যপ্রচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ ইরানের বিমান বাহিনীতে এ মুহুর্তে প্রায় ৭৪৬টি বা তার কাছাকাছি বিশাল আকারের জেট ফাইটার, হেলিকপ্টার, সামরিক পরিবহণ বিমান, জেট ট্রেইনার বিমান রয়েছে। তবে ইরানের বিমান বাহিনীর এরিয়্যাল সিস্টেমের ক্যাপাবিলিটির ৭০% পর্যন্ত কিন্তু ষাট ও সত্তর এবং কিছু সংখ্যক আশির দশকের এয়ার ফ্লীট দিয়ে পরিপূর্ণ। যা এক বিংশ শতাব্দীতে এসে ইরানের প্রধান শত্রুভাবাপন্ন দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের বিবেচনায় একেবারেই দূর্বল কিংবা নিম্ন মানের বলা চলে। যদিও আশির দশকেই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পূর্ববর্তী রেজা শাহ পাহেলভী সরকারের আমলে ইরানীয়ান এয়ার ফোর্সের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয় এবং তৎকালীন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মাঝে ডিফেন্স এয়ার ফ্লীট ও আকাশ সক্ষমতার বিচারে ইরানকে প্রথম স্থানীয় কোন দেশ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

বিশেষ করে ১৯৮০ সালের পুর্ববর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে ইরানের সাবেক রেজাশাহ পাহেলভী সরকারের সাথে উচ্চ মাত্রায় সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় থাকায় ১৯৭০-৭৮ সময়ের মধ্যে ইরান প্রায় চার শতাধিক বা তার বেশি সংখ্যক এফ-১৪ টমক্যাট, এফ-৪ (ফ্যান্টম-২), এফ-৫ সিরিজের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এবং ব্যাপক পরিমাণে অত্যাধুনিক চিনুক হেলিকপ্টারসহ ও সামরিক পরিবহণ বিমান ক্রয়ের সুযোগ পেয়েছিল। আর যার চূড়ান্ত সুফল কিন্তু ইরানের বিমান বাহিনী এখনো পর্যন্ত কিন্তু ভোগ করে যাচ্ছে।

তবে বর্তমান সময়ে এসে ইরানের আল খোমেনী সরকার এবং তার সামরিক বাহিনী নিজেকে এভিয়েশন টেকনোলজিতে যতই উচ্চ সক্ষমতা এবং শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রচার করুক না কেন, বাস্তবে ইরানের বিমান বাহিনীর এয়ার ফ্লীটের পরিমাণ, প্রযুক্তিগত মান এবং সক্ষমতা দুটোই কিন্তু যথেষ্ঠ করুণ বা প্রশ্নের সম্মুখীন থেকেই যাচ্ছে। সোজা কথা, বর্তমানে ইরানের হাতে থাকা ষাট ও সত্তরের দশকের অতি পুরনো লাইট ফাইটার জেট দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল কিম্বা সৌদি আরবকে যৌথভাবে বা এককভাবে আকাশ পথে কার্যকরভাবে ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আদৌ মোকবেলা করতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।

যদিও ১৯৯১ সালের দিকে মধ্যপ্রাচ্যে গলফ ওয়ার চলাকালীন মুহুর্তে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের বিমান বাহিনীর প্রায় অর্ধ শতাধিক মিগ-২৯, এসইউ-২৫, এসইউ-২২, মিগ-২৩ ইত্যাদি জেট ফাইটার এন্ড গ্রাউণ্ড এট্যাক বিমান ইরানে পলায়ন করলে ইরানের সরকার সবগুলো যুদ্ধবিমান বাজেয়াপ্ত করে পরবর্তীতে নিজ এয়ার ফ্লীটে অন্তভুক্ত করে নেয়। যদিও পরবর্তী সময়ে ইরান সমর্থিত সরকার ইরাকে ক্ষমতায় আসায় কিছু সংখ্যক বিমান ফেরত দেওয়া হয়।

তবে যাই হোক না কেন, নিজস্ব প্রযুক্তির কমব্যাট এন্ড নন-কমব্যাট ড্রোন (ইউএভি) এরিয়াল সিস্টম ইঞ্জিনিয়ারিং এণ্ড ডেভলমেন্টে ইরান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে। তারা ইতোমধ্যেই বেশ কিছু সিরিজের কমব্যাট ড্রোন সার্ভিসে এনেছে এবং ইয়েমেনের হুথী বিদ্রোহীদের মাধ্যমে সৌদি আরবের সামরিক ঘাঁটিতে লাগতার কমব্যাট ড্রোন এ্যাটাক করে বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে।

অথচ এদিকে কিনা প্রতি বছর গড়ে প্রায় দশটি বা তার কাছাকাছি যুদ্ধবিমান কিম্বা হেলিকপ্টার ক্রাস কিম্বা ধ্বংস হয়ে আজ ইরান বিমান বাহিনীর আকার ও সক্ষমতা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে এসেছে। ইরান সরকার এ বাস্তব সত্যটি যতটা সম্ভব বিশ্বের চোখে আড়াল করার চেষ্টা করে গেলেও তার শত্রু দেশ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল ইরানের এহেন দূর্বলতাকে মাথায় রেখে ইরানের সামরিক আগ্রাসনের নতুন করে ছক কষতে শুরু করে দিয়েছে।

ইরান ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের দিকে তার নিজস্ব প্রযুক্তির স্টিলথ টেকনোলজি বেসড কাহার-৩১৩ এর ডেমো বিশ্বের সামনে এনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। বিশেষত এই কাহার-৩১৩ এর ডিজাইন এবং ককপিট মেনেজমেন্ট ও পাশাপাশি পাইলট বসার আসন দেখে এটি যে এক রকম ইরানের বাচ্চা সুলভ প্রোপাগাণ্ডা বা অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয় তা অনেকটা বিশ্বের সামনে পরিস্কার হয়ে যায়। অবশ্য এর পর ইরান ২০১৭ সালেও তার নিজস্ব প্রযুক্তির কাহার-৩১৩ প্রকাশ্যে আনে। তবে এবার ইউটিউব ভিডিওতে দেখা যায় এটা রানওয়েতে একাই ছুটে যাচ্ছে। তবে মনে করা হয় ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তির কাহার-৩১৩ এখনো পর্যন্ত গবেষণা এবং উন্নয়ন পর্যায়ে রয়ে গেছে।

যদিও মনে করা হয়, শত অবরোধ এবং মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাঝেও এ মুহুর্তে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ৮০% পর্যন্ত স্বল্প এবং মধ্যম পাল্লার ব্যালেস্টিক এন্ড ক্রুজ  ক্ষেপণাস্ত্র এবং নিজস্ব প্রযুক্তির এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়েছে। আর কিছুদিন আগে ইরানের নিজস্ব খোরদার-৩ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দিয়ে মার্কিন বিমান বাহিনীর ২০৩ মিলিয়ন ডলারের একটি স্টিলথ গ্লোবাল হক ড্রোন শুট ডাউন করলে তা সারা বিশ্বে ব্যাপক হইচই ফেলে দেয়। এটাকে ইরানের একটি বড় ধরণের অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হলেও সার্বিকভাবে ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল এন্ড এয়ার ফ্লীটকে মোকাবেলায় মোটেও যথেষ্ঠ নয়।

আবার সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের বিমানবন্দর, সামরিক ঘাঁটি এবং বিশেষ করে আরামকোর অয়েল ফ্যাসালিটি তিন স্তরের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে হুথী বিদ্রোহীদের মাধম্যে বেশ ছোট আকারের সুসাইড ড্রোন এবং ব্যাপক মাত্রায় ক্রুজ মিসাইল হামলার সৌদি আরবে বড় ধরণের ক্ষতি সাধিত হয়। এতে এক লাফে সৌদির তেল উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে এবং ইরানের সাথে সৌদি আরব ও মার্কিন জোটের যুদ্ধের আকাঙ্খা বা প্রবল ইচ্ছা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে বলেই প্রতিয়মান হয়।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.