--- বিজ্ঞাপন ---

ব্যাপক বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানে ৮ লাখ ৪৭ হাজার কোটি রুপির বাজেট পেশ

সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ১,৩৭০ বিলিয়ন রুপী

0

২০২১ সালের ১১ই জুন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন ইসলামাবাদে সংসদে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার মধ্যেই ২০২১-২২ নতুন অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের ইমরান সরকারের দৃষ্টিতে এই নতুন ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটটি হতে যাচ্ছে দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের একটি আদর্শ বাজেট। ২০২১-২২ অর্থবছরের পাকিস্তানের ঘোষিত ফেডারেল বাজেটের আকার হচ্ছে ৮ লক্ষ ৪৭ হাজার ৮০০ কোটি পাকিস্তানী রুপি বা ৮,৪৭৮ বিলিয়ন রুপির সমপরিমাণ অর্থ। তাছাড়া নতুন অর্থ বছরে পাকিস্তানের বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয় ৪.৮ শতাংশ। আর প্রতি ডলারের বিপরীতে ১৫৭.১২৭ রুপি হিসেবে পাকিস্তানের সার্বিক বাজেটের আকার হয় ৫৩.৯৬ বিলিয়ন ডলার মাত্র।
তবে বাজেটের দিনের সংসদ অধিবেশন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জন্য বেশি সূখকর হয়নি।  পাক দৈনিক ডন জানায়, এ দিন রাজস্ব ও অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী হাম্মাদ আযহারের বাজেট বক্তৃতার মাঝখানে বিরোধী সংসদ সদস্যরা উঠে ঘোষিত বাজেটের প্রতিবাদ জানান। বাজেট বক্তৃতার মধ্যভাগে বিরোধী সংসদ সদস্যরা স্পিকারের ডায়াসের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষুদ্ধ সংসদ সদস্যরা এ সময় স্পিকারের সামনে বাজেটের কাগজপত্র ছুঁড়ে মারেন।

বিরোধী নেতাদের নিবৃত করতে সরকারী দলের সদস্যরা এগিয়ে এলে পরিস্থিতি আরও বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগের (নওয়াজ) সংসদ সদস্য মুর্তাজা জাবেদ আব্বাস এবং তেহরিকে ইনসাফের শাহেদ খটকের মধ্যে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। এ সময় ‘গো ইমরান গো’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা সংসদ। ‘গো নিয়াজি গো’সহ বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় বিরোধীদের। উত্তেজিত বিরোধী সংসদ সদস্যরা একসময় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দিকেও তেড়ে গিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। পাল্টাপাল্টি স্লোগান ও হট্টগোলের মধ্য দিয়েই বাজেট বক্তৃতা পেশ করেন রাজস্ব ও অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী হাম্মাদ আযহার।

পাকিস্তানের ইমরান সরকার তাদের নতুন অর্থ বছরের বাজেটকে অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের বাজেট বলে প্রচার করলেও তাতে দেখা যায় পাকিস্তানের বাজেটের একটি বড় অংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে দেশটির সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে এবং বৈদেশিক ঋণ ও দেনার আসল ও সুদ বাদদ পরিশোধে। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাকিস্তানের সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১,৩৭০ বিলিয়ন রুপী বা ৮.৭২ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে পাকিস্তান তার মোট বাজেটের ১৬.১৬% অর্থ ব্যয় করতে যাচ্ছে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে। যদিও দেশটি বিগত ২০২০-২১ অর্থ বছরে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ১,৩২৬ বিলিয়ন রুপীর সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছিল দেশটি। এদিকে ৪৮,০০০ কোটি রুপীর বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সরকারের সিভিলিয়ান এবং রিটায়ার্ড সামরিক সদস্যের পেনশন ভাতা বাবদ ব্যয় করার করার লক্ষ্যে।

তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে পাকিস্তানের বর্তমান ইমরান সরকার তাদের জাতীয় বাজেটের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে যাচ্ছে দেশটির পাহাড় সমান অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক ঋনের আসল ও সুদ বাবদ অর্থ পরিশোধ করার জন্য। ২০২১ সালের ৩১শে মার্চের হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋন এবং দেনার স্থিতির পরিমাণ ১১৬.৩০৯ বিলিয়ন ডলার বা ১৮ লক্ষ ২৭ হাজার ৫০০ কোটি রুপীর সমপরমাণ অর্থ। আর নতুন বাজেটে পাকিস্তানের ইমরান সরকার মোট ৩,০৬০ বিলিয়ন রুপী কিংবা ১৯.৪৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রেখেছে শুধুমাত্র দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋন ও দেনা পরিশোধ করার জন্য। সে হিসেবে পাকিস্তান মোট বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ বাবদ ৩৬.০৯% ব্যয় হয়ে যাবে শুধুমাত্র ঋনের আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ করতে। এতে করে দেশটির সার্বিক উন্নয়ন, দরিদ্র বিমোচন এবং উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্বকভাবে বাধাগ্রস্থ হয়ে যেতে পারে।

পাকিস্তানের ইমরান সরকার ভবিষ্যতে আপকালীন দূর্যোগ এবং বিশেষ করে করোনা (কভিড-১৯) মহামারি মোকাবেলায় ১০,০০০ কোটি রুপীর এক বিশেষ ফান্ড বরাদ্দ রেখেছে। তাছাড়া দেশের বাজারে পন্যের উর্দ্ধমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা হ্রাস এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকী হিসেবে ৬৮,২০০ কোটি রুপি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে নতুন বাজেটে।

এদিকে পাকিস্তান সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরে ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৃহৎ আকারের জাতীয় বাজেট পেশ করলেও বাজেটে অর্থ প্রাপ্তি উৎস এবং খাতগুলো অনেকটাই অবাস্তব ঋন নির্ভর করে প্রনয়ন করা হয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন দেশটির প্রথম সারির অর্থনীতিবিদেরা। সরকারের অর্থ প্রাপ্তির উৎস হিসেবে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সরাসরি ৬৮,১০০ কোটি রুপী ব্যাংক ঋন, প্রভিশনাল সাপ্লাই ৫৭,০০০ কোটি রুপী, নীট রেভিনিউ প্রাপ্তি বাবদ ৪,৪৯,৭০০ কোটি রুপী এবং নন-ব্যাংকিং খাত থেকে প্রাপ্তি ১,২৪,১০০ কোটি রুপী এবং বেসরকারি খাত থেকে ২৫,২০০ কোটি রুপী দেখনো হয়েছে। তবে আবারো বৈদেশিক ঋন এবং অনুদান প্রাপ্তি হিসেবে দেখনো হয়েছে ১,২৪,৬০০ কোটি রুপীর সমপরিমাণ অর্থ।

২০২০ সালের শুরু থেকেই সারা বিশ্বে করোনা (কভিড-১৯) মহামারি আকার ধারণ করায় বিশ্ব মহামন্দার কবলে পাকিস্তানের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং রপ্তানি খাত মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরের জুলাই/২০ থেকে মে/২১ পর্যন্ত মোট ১১ মাসে পাকিস্তান ২৭.২৭৫ বিলিয়ন ডলারের পন্য বিদেশে রপ্তানি করে এবং ঠিক একই সময়ে পাকিস্তান ১১ মাসে মোট ৪৯.৮৩৯ বিলিয়ন ডলারের পন্য বিদেশ থেকে আমদানি করে। যা বিগত বছরের তুলনায় এই আমদানি ব্যয় ২২% বেশি ছিল। তাছাড়া ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রথম ৬ মাসে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রবাসী কর্মীরা ১৪.২০৩ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ রেমিট্যান্স বাবদ দেশে পাঠায়। যা এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে হাল ধরে রেখেছে। তবে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১২ মাসে ২৪.১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বাদদ পাকিস্তানে এসেছিল এবং ২০১৯ সালে তা ছিল ২২.২ বিলিয়ন ডলার।

তবে গত মাসে ইমরান সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রবল সমালোচনা করে পাকিস্তানের প্রথম সারির অর্থনীতিবিদ ড. কায়সার বাঙ্গালী বলেন, পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনীতি এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটির অর্থনীতি বর্তমানে উৎপাদনশীলতার পরিবর্তে বৈদেশিক ঋণ নির্ভর অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যা দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নকে মারাত্বকভাবে বাধাগ্রস্থ করছে। তিনি আরো বলেন, এই মুহূর্তে পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনীতি ভেন্টিলেটরের ওপর বেঁচে রয়েছে। দেশটির জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে নিম্নহার এবং আর্থিক অনিশ্চয়তাই পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা। এদিকে পাকিস্তানের জাতীয় বাজেটের বেশিরভাগ অংশই ব্যয় হয়ে যায় বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋনের আসল ও সুদ পরিশোধ এবং প্রতিরক্ষা খাতে। যা পাকিস্তানের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা খাত এবং দারিদ্র বিমোচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে ইমরান সরকার।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.