--- বিজ্ঞাপন ---

অস্ত্র কেনার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়

0

কাজী আবুল মনসুর / সিরাজুর রহমান

পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনছে আরব দেশগুলো। এক একটি দেশ এখন পরিনত হয়েছে অস্ত্রের গুদামে। মনে হচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলো এখন অস্ত্র বানাচ্ছে আরবদেশগুলোর জন্যই। বিশ্বের অস্ত্র বাজারের অন্যতম এখন মধ্যপ্রাচ্য। জার্মান গণমাধ্যম দয়েৎসেভেলের মতে, ২০১৬ থেকে ২০২০-র মধ্যে বিশ্বে মোট যত অস্ত্র বিক্রি হয়েছে, তার ৩৭ শতাংশ করেছে অ্যামেরিকা। মোট ৯৬টি দেশকে অস্ত্র বিক্রি করেছে তারা। আর তাদের অস্ত্রের সব চেয়ে বড় ক্রেতা হলো মধ্যপ্রাচ্য। অ্যামেরিকার অর্ধেক অস্ত্রই যায় সেখানে। আর মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কেনে সৌদি আরব। বস্তুত, তারাই বিশ্বের সব চেয়ে বড় অস্ত্রের ক্রেতা। বিশ্বে অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে এক নম্বরে আমেরিকা, দুইয়ে রাশিয়া, তিনে ফ্রান্স।

২০১৬ থেকে ২০২০-র মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র কেনার পরিমাণ তার আগের দশ বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। আর সৌদি আরব এখন বিশ্বের সব চেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা। তাদের অস্ত্র কেনার পরিমাণ ৬১ শতাংশ বেড়েছে। ইয়েমেনে ২০১৪ সাল থেকে হুতি বিদ্রোহীদের দমনে হামলা চালিয়ে আসছে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। জোটে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, কুয়েত, জর্ডান ও বাহরাইন। ছয় বছরের যুদ্ধে দুই লাখ ৩৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অন্যদিকে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে দু’টি বিবদমান পক্ষকে মদত দিয়ে আসছিল কাতার, তুরস্ক এবং আরব আমিরাত ও মিশর।কাতারের অস্ত্র কেনার পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্প্রতি অ্যামেরিকার কাছ থেকে ৫০টি এফ ৩৫ জেট কেনার জন্য চুক্তি করেছে। তারা ১৮টি সশস্ত্র ড্রোনও কিনছে। দুই হাজার ৩০০ কোটি ডলার দিয়ে এই অস্ত্র কিনছে আমিরাত। অস্ত্র বিক্রিতে পিছিয়ে নেই জার্মানও। ২০২০ সালে অন্তত ৫টি দেশে ১৯৫ কোটি ডলারের (১৬১ ইউরো) অস্ত্র রফতানির অনুমোদন দিয়েছে চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র দিয়েছে মিসরকে। ক্রেতা আরব দেশগুলো এসব অস্ত্র প্রধানত ইয়েমেন আর লিবিয়ায় প্রাণঘাতী যুদ্ধে ব্যবহার করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে হাজারো রকমের বেফাস এবং বিতর্কিত মন্তব্য করে বিশ্ববাসীর হাসির খোরাক জুগিয়েছিলেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় ২০২০ সালের শুরুর দিকে ট্রাম্প তার এক বিতর্কিত এবং হাস্যকর টুইটে বলেন যে, ‘ নিজ বাড়ির ভাড়াটিয়ার চেয়ে আরব দেশগুলোর কাছে অর্থ আদায় করা সহজ’। আর এ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিম্বা পশ্চিমা বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশগুলো বাদশা আমীর শসিত আরব দেশগুলোকে কোন দৃষ্টিতে দেখে তা সহজেই অনুমান করা যায়। আর এটা অনেকের কাছে হাস্যকর বা অবান্তর উক্তি বলে মনে হলেও ট্রাম্প কিন্তু অনেকটা নিজের অজান্তেই এক কথায় নির্বোধ এবং ঘুমন্ত আরব দেশগুলোর স্থূলবুদ্ধি এবং চরম অযোগ্যতা বিশ্বের সামনেই তুলে ধরেছিলেন। যদিও  ট্রাম্পের এহেন অপমানজনক টুইট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর কোন সরকারই প্রতিবাদ করার কিংবা তাদের মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা করার সাহস দেখাতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
বৈশ্বিক পর্যায়ের সামরিক গবেষণামুলক প্রতিষ্ঠান এবং থিংক ট্যাংকগুলো দেয়া প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বর্তমানে করোনা (কভিড-১৯) মহামারির পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক মহামন্দার মধ্যেও ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে আনুমানিক ১২০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বাণিজ্য হয়। যার আবার একটি বড় গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো। আরব দেশগুলোর এই নজিরবিহীন অস্ত্র আমদানির প্রবনতা এবং নির্বিচারে অর্থ ব্যয় করা দেখে হতবাক হয়ে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশ্লেষকেরা।

মোট কথা বর্তমানে বিশ্ব অস্ত্র রপ্তানির ৪০ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত সরাসরি চলে যাচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরান, কাতার, কুয়েত, ওমান, এবং মিশরসহ অন্যান্য আরব দেশগুলোতে। এখানে মুলত ইসরাইল, তুর্কী এবং ইরান ভীতিকে বিভিন্ন ভাবে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে আনুমানিক দুই থেকে তিনগুণ বেশি দামে আরব দেশগুলোর হাতে নির্বিচারে তুলে দেয়া হচ্ছে। উচ্চ প্রযুক্তির প্রাণঘাতী যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জামই বেশি। ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া আরব বসন্তের ভয়াবহ প্রভাব তো আছে। পাশাপাশি সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া এবং ইয়েমেনে লেগে আছে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীল যুদ্ধ। এ পরিস্থিতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা এবং আমির শাসিত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সর্ম্পকে চরম সন্দেহ ও অবিশ্বাস বিরাজ বাড়ছে। তাছাড়া বৈশ্বিক সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার পাশাপাশি বিশেষ করে আঞ্চলিক শক্তিধর দেশ সৌদি আরব, তুরস্ক এবং ইরানের মধ্যপ্রাচ্যে চরম মাত্রায় প্রভাব বিস্তারে লিপ্ত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য আরব দেশগুলোর মাঝে অস্ত্র সংগ্রহের ভয়ানক প্রবণতা এবং তার সাথে তাদের মাঝে বাড়ছে অশুভ অস্ত্র প্রতিযোগিতা। একে অপরের প্রতি যুদ্ধাংদেহী মনোভাবও নজরে পড়ার মতো। আর এই সুযোগেই সারা বিশ্বব্যাপী অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশ এবং কর্পোরেশনগুলো মধ্যপ্রাচ্যে শত বিলিয়ন ডলারের অতি লাভজনক যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম সরবরাহে নিজেদের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ আরব দেশেই অভিজ্ঞ পাইলট বা দক্ষ প্রযুক্তিবিদ না থাকলেও, তবু দুই থেকে তিনগুণ বেশী দামে নির্বিচারে কেনা হচ্ছে যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ এবং প্রাণঘাতী সামরিক সাজ সরঞ্জাম বা যুদ্ধাস্ত্র। আর হতাশাজনক হলেও সত্য যে, এই প্রানঘাতি যুদ্ধাস্ত্রের একটি বড় অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। আর এতে করে হাজারো নিরীহ মানুষের মৃত্যু এবং মানবতা মারাত্বকভাবে ধ্বংস হলেও কিন্তু থেমে নেই অস্ত্র বানিজ্য আর প্রভাব বিস্তারের অশুভ প্রতিযোগিতা।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক সক্ষমতা আগে বিশ্বে কখনোই ছিল না। অথচ আমির শাসিত এই দেশটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চমকে যাওয়ার মতো অর্থ ব্যয় করে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে অস্ত্র কিনতে। ২০২০ সালের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতার একেবারে শেষের দিকে কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে ২৩ বিলিয়ন ডলার চুক্তিমূল্যে আরব আমিরাতের কাছে ৫০টি এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটার এবং ১৮টি এর কাছাকাছি কমব্যাট ড্রোন বিক্রয়ের নতুন অনুমোদন দিয়ে যান। আর ২০২১ সালে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাইডেন প্রশাসন সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে এই ৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রয় চুক্তিটি শেষ পর্যন্ত বহাল রাখে। যদিও মনে করা হয় মার্কিন এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটার পাওয়ার গোপন শর্তে ২০২০ সালেই ইসরাইলের সাথে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাহরাইন। তাছাড়া নতুন কূটনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ইসরাইলের কাছ থেকে ব্যাপক আকারের সামরিক সাজ সরঞ্জাম, অস্ত্র এবং ড্রোন কিনতে যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। যার মূল টার্গেট মধ্যপ্রাচ্যের ইরান এবং তুরস্ককের প্রভাব প্রতিহত করা। আর আরব আমিরাতের পথ অনুসরণ করে একই ভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র সজ্জিত হতে নির্বিচারে অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছে বাহরান, কাতার, কুয়েত, ওমান, মিশরসহ অন্যান্য আরব দেশগুলো।
আবার মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ কাতার কিন্তু সৌদি আরবের চরম বৈরীতা এবং সামরিক হুমকীর মুখে এক রকম বাধ্য হয়েই প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের সাথে ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নজিরবিহীনভাবে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অধিক যুদ্ধবিমান, ট্যাংক এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম আমদানি বা ক্রয়ের জন্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। কাতারের আল থানী সরকার ইতোমধ্যেই তাদের বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৯৬টি নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এবং পরিবহণ বিমান কিনতে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে ২৫.০০বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্নকরেছে। যদিও কাতার বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে একেবারে নতুন ৯৬টি অত্যধুনিক যুদ্ধবিমান অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে যদিও পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা খুবই আশ্চর্য হয়েছেন। তবে এতে করে কিন্তু চুড়ান্তভাবে লাভবান হচ্ছে মার্কিন এবং ইউরোপের সরকার বা ডিফেন্স ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব এবং জায়ান্ট কর্পোরেশনগুলো।

স্টকহোম ইন্টারন্যশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, বিশ্বের বড় ১০টি সমরাস্ত্র প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠানের তিনটিই বর্তমানে চীনের। বিশ্বে শীর্ষ অস্ত্র প্রস্তুতকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই চীনের অবস্থান। তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়ার নাম। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যন্ত দখল করে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো লকহিড মার্টিন, বোয়িং, নরথ্রোপ গ্রুম্যান এবং রেথিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। আর এসব প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাণঘাতি অস্ত্র রফতানি করে পুরো বিশ্বকে ঠেলে দিচ্ছে এক অনিশ্চয়তার দিকে। #

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.