--- বিজ্ঞাপন ---

বিদায় কিংবদন্তী

0

কাজী ফেরদৌস, কানাডা থেকে

অবশেষে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি কিং অব ট্রাজেডি নামে খ্যাত উপমহাদেশের কিংবদন্তী অভিনেতা ইউসুফ খান ওরফে দিলীপ কুমার। ১৯৫৭ সালে তাঁর ইনসানিয়াত ছবির মধ্যে দিয়ে তাঁর সাথে প্রথম পরিচয়।তখন খুব ছোট ছিলাম। মাত্র তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। মেজ বুবুর সাথে চট্টগ্রামের উজালা সিনেমায় ছবিটি দেখে ছিলাম । দিলীপ কুমার এর সাথে ছিলেন আরেক কিংবদন্তী অভিনেতা দেব আনন্দ। ছবির মর্ম বুঝার বয়স তখনও হয়নি। শুধু চেহারা টা মনে ছিল। আর কিছু দৃশ্য। তবে পরবর্তী ছবি দেখি সম্ভবত ১৯৬২ সালে মেহবুব খান পরিচালিত আন ছবিটি। দারুণ উপভোগ করেছিলাম সেই রোমান্টিক ছবি টি।দিলমে চুপাকে পেয়ার কা তুফান লে চলে…অথবা মোহাব্বত চুমে জিনকে হাত… বহু দিন স্মৃতির মনি কোটায় সংরক্ষিত ছিল রোমান্টিক আবেগে। পরবর্তী তে একে একে দিদার, দাগ, আন্দাজ এবং মোগলে আজম সর্বশেষ বিরাশি সালের ছবি শক্তি। সাথে নুতন প্রজন্মের অমিতাভ বচ্চন। দুই প্রজন্মের দুই কিংবদন্তী একসাথে দারুণ উপভোগ করেছিলাম। এরপর আরো দু’একটা ছবি দেখেছিলাম। তবে তেমন ভালো লাগে নি।

তাঁর মৃত্যু তে অমিতাভ বচ্চন মন্তব্য করেছেন – ভারতীয় চলচ্চিত্রের মূল্যায়ন করতে হলে ইতিহাস কে দুই পর্বে ভাগ করতে হবে দিলীপ কুমার পূর্ববর্তী সময় ও দিলীপ কুমার  পরবর্তী সময়। আসলে এর চেয়ে মূল্যবান মন্তব্য আর কি হতে পারে?  বস্তুত  উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দুই পর্বের সংযোগ ছিলেন দিলীপ কুমার। তাঁর আগের যুগ ছিল রূপকথার যুগ পৌরাণিক যুগ।মূলতঃ তাঁর হাত ধরেই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের আধুনিক যুগের শুরু হয়। সোশ্যাল ড্রামার ছবি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। সাথে ছিলেন রাজ কাপুর দেব আনন্দ। এই ত্রিরত্নের হাত ধরেই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের আধুনিক যুগের শুরু হয় বলেই আমার ধারণা। তবে দিলীপ কুমার কেই মাইলফলক ধরতে হবে। বহুদিন আগে আমি দিলীপ কুমার সম্পর্কে এক মহিলার মন্তব্য পড়েছিলাম এক সিনে ম্যাগাজিনে।তিনি বলেছিলেন আমার যৌবন দলিতমথিত করা নায়ক ছিলেন দিলীপ কুমার। এমনকি রান্নাঘরে রান্না করতে করতে আমি যে কতবার দিলীপ কুমার কে নিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম তার কোন হিসাব নেই। আসলে এটাই ছিল দিলীপ যুগের তথা আমাদের প্রজন্মের বাস্তবতা।দিলীপ কুমার মধু বালা, নার্গিস রাজ কাপুর দেব আনন্দ ওয়হিদা রহমান বাংলার উত্তম সুচিত্রা মালাসিনহা বিশ্বজিৎ কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলি।উর্দু ছবির জেবা ওয়াহিদ মুরাদ, মোহাম্মদ আলী, শবনম নাদিম,ঢাকার রাজ্জাক কবরী ববিতা, শাবানা কাউকে কি ভুলা যায়?

আমাদের প্রজন্মের চলচ্চিত্র দর্শকদের সুযোগ হয়েছিল দিলীপ কুমার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের ছবি দেখার। আমরা শ্যাম সুরাইয়া, নাসিম বানু রঞ্জন মহীপাল যুগ দেখেছি। দেখেছি দিল্লাগি, চাঁদনী রাত পরচাই, দেখেছি আলাউদ্দীনের জাদুর চেরাগ।আবার রাজ কাপুরের বরসাত,দিলীপ কুমার এর মোগলে আজম আন দিদার, দেব আনন্দ এর ট্যসক্সি ড্রাইভার, শোলবা সাল সহ অনেক সাড়াজাগানো ছবি। দেখেছি পরবর্তী প্রজন্মের ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্না, অমিতাভ শশী কাপুর এবং আমীর খান সালমান খান সহ নুতন প্রজন্মের অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীর। তবে আমাদের প্রজন্মের সাথে পরবর্তী প্রজন্মের দৃষ্টি ভঙ্গিতে বিস্তর ফারাক আছে। আমাদের সময়ের অনেক ভালো লাগার ছবি এই প্রজন্মের দর্শকদের ভালো লাগার তেমন সুযোগ নেই। কারণ রুচি দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবোধ নিয়ত পরিবর্তন শীল। তবুও কিছু অভিনেতা অভিনেত্রী কালজয়ী হিসেবে টিকে থাকে যুগ যুগ। গ্রেটা গার্বো, মারলন ব্রান্ডো সোফিয়া লরেন রা যুগ যুগ বেঁচে থাকবে কিংবদন্তী হিসেবে। তেমনই করে বেঁচে থাকবে কিংবদন্তীর দিলীপ, রাজকাপুর দেবানন্দ উত্তম সুচিত্রা সহ অনেক সাড়াজাগানো নায়ক নায়িকা।

ভারতের চলচ্চিত্র জগতে বিতর্ক আছে কে শতাব্দীর শ্রেষ্ট?  দিলীপ কুমার নাকি অমিতাভ বচ্চন নাকি শাহরুখ খান?  অমিতাভ বচ্চন নিজেই স্হানটি দিলীপ কুমার কে ছেড়ে দিয়েছেন বহু আগেই। শাহরুখ খান যত বড়ো নায়ক হোন না কেন আমার দৃষ্টিতে দিলীপ কুমার এর ধারে কাছেও ঘেসতে পারবে না।সুতরাং দিলীপ কুমারই ভারত শুধু নয় সমগ্র উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তী অভিনেতা।

তবে ট্রাজেডি কিং এর জীবনে ও একটা ট্রাজেডি আছে। অভিনয় জগতের শুরুতেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আরেক কিংবদন্তী মধুবালার সাথে। কিন্তু মধু বালার পিতার সাথে এক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে সেই প্রেম ব্যর্থ হয়ে যায়। পরে বেয়াল্লিশ বছর বয়সে একুশ বছর বয়সী লাস্যময়ী বলিউড হার্টথ্রব সায়রা বানুকে বিয়ে করেন সম্ভবত ১৯৬২ সালে। সায়ারা বানুর মা একসময়ের ভারতীয় চলচ্চিত্রের নামীদামী অভিনেত্রী নাসিম বানুর অনুরোধে দিলীপ কুমার সায়রা কে বিয়ে করেছিলেন বলে তখন জেনেছিলাম।বয়সের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়েছিল মনে হয়।তবে দিলীপ কুমার চিরদিন ট্রাজেডির নায়কই রয়ে গেলেন। ১৯৬৯ সালে ক্যান্সারে মধুবালা মারা গেলে ঢাকার ইংরেজি দৈনিক অবজারভার পত্রিকা হেডিং করেছিল – আয়েগা আয়েগা আয়েগা  আয়েগা ….. লেকিন ওয় নেহি আয়া….।বস্তুত দিলীপ মধুবালার জীবনের ট্রাজেডির প্রতি ইংঙ্গিত পূর্ণ ছিল এই হেডলাইন। এই বিচ্ছেদ বেদনার বোঝা বইয়েই আসলে কেটেছিল দিলীপ মধুবালার যাপিত জীবন। হিন্দি সিনেমার দুই কিংবদন্তী আজ পরপারে। তাঁদের অপূর্ণ প্রেম কাহিনি অনাগত কালের চলচ্চিত্র অনুরাগীদের হৃদয় আলোড়িত করবে বহুযুগ।

১৯৭৪ সালে আমার এক সহকর্মী আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গিয়ে লতামঙ্গেসকর এর আলবার্ট হলের অনুষ্ঠানের অডিও ক্যাসেট টি শুনিয়ে ছিলেন। লতা মঙ্গেসকর কে মঞ্চে উপস্থাপন করে ছিলেন স্বয়ং দিলীপ কুমার। তাঁর অসাধারণ কাব্যিক উপস্থাপনা আলবার্ট হলের দর্শক শুধু নয় দুরের শ্রোতাদের ও মন্ত্র মুগ্ধ করে ছিল। উর্দু ভাষায় তাঁর উপস্থাপনা ছিল যেন এক অসাধারণ কাব্যিক কথামালা। জীবনে বহুবার সেই ক্যাসেট আমি শুনেছি আর মুগ্ধ হয়েছিলাম দিলীপ কুমার এর কাব্যিক উপস্থাপনা ও বাকপটুতায়।মনে হয়েছিল তিনি অভিনেতা না হয়ে টিভি উপস্থাপক ও সঞ্চালক হলেও মনে হয় জগৎ বিখ্যাত হতে পারতেন।

চলচ্চিত্রের বিষয় বস্তু ভাষা এখন অনেক বদলে গেছে টেকনিক্যাল উৎকর্ষতা এখন এতদূর এগিয়েছে যে পুরনো দিনের ছবি গুলো এখন আর তেমন আকর্ষণ করে না।কিছু দিন ধরে ইউটিউবে পুরনো অনেক ছবি দেখেছি কিন্তু কনসেনট্রেশান ধরে রাখতে পারিনি। ফলে ফরওয়ার্ড ব্যাকওয়ার্ড করে তিন ঘন্টার ছবি এক ঘন্টায় শেষ করেছি।আসলে যুগের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা চেতনা ও পরিবর্তন হয়।এখন দিদার, দাগ ইনসানিয়াত মোগলে আজম বলুন অথবা ধর্মেন্দ্র রসজেস খান্না বলুন জেবা ওয়াহিদ মুরাদ বলুন সবই অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়।এখন বাস্তব ধর্মী জীবন ঘনিষ্ঠ অনেক ছবি তৈরি হয় কোলকাতা বম্বে হলিউড সহ অনেক দেশে সুতরাং আগের দিনের ফর্মুলা মার্কা ছবি আর তেমন আকর্ষণ করে না বিশেষ করে আমাকে।অনেকে  নুতন প্রজন্মের ছবির ব্যাপারে কিছুটা নাক সিট কায়। তবে আমি পরিবর্তনের ধারার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পছন্দ করি।আমার কাছে নানা পাটেেকার এর সুত্রধর বা প্রহর, আমির খানের লগন, তারে জামিন পর থ্রি ইডিয়টস, পিিকু এরফাান খানের স্লামডগ মিলোনিয়ার, আয়ুস্মান খুরানার আর্টিকেল ফিফটিন বা আন্ধা ধুন বা টিভি সিরিজ দিল্লি ক্রাইমস এখন অনেক প্রাসঙ্গিক ও উপভোগ্য মনে হয়।সৌমিত্রের সাম্প্রতিক ছবি পস্তুু রীতিমতো হৃদয় গ্রাহী। তবুও পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনের একটা আলাদা ফ্লেভার আছে।

আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর আগের আমি আর আজকের আমি এক মানুষ নই কিছুতেই।সুতরাং কিশোর বয়সী আমি এবং যৌবনের আমির কাছে নস্টালজিক স্মৃতির মূল্য নিতান্ত কম নয়।সেখানে দিলীপ কুমার মধু বালা, উত্তম সুচিত্রা ধর্মেন্দ্র, হেমামালিনি অমিতাভ বচ্চন রেখার অনেক মূল্য আছে যেটা কখনো ম্লান হবে না। ম্লান হবে না কখনো ট্রাজেডি কিং দিলীপ কুমার।

দিলীপ কুমার চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রেখে গেছেন পেছনে হাজার কোটি টাকার সম্পদ।কি কাজে আসবে?  একমাত্র স্ত্রী সায়রা ছাড়া কেউ নেই। হয়তো একদিন এই সহায় সম্পত্তি নিয়ে শুরু হবে ঝগড়া ফাসাদ আইনি লড়াই। কি অর্থ আছে এ-সব সহায় সম্পত্তির? The paths of glory ultimately leads to the grave.

মহানায়কের পারলৌকিক জীবন শান্তিময় হোক এই শুভকামনা রইল।

অটোয়া, কানাডা  # ৯/৭/২০২১

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.