--- বিজ্ঞাপন ---

বৈদেশিক ঋনের ভারে কাহিল পাকিস্তানের অর্থনীতি

0

একটি দেশের জন্য অনিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক ঋন ও দেনা কতটা বিপদজনক হতে পারে তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান। ঋন করতে করতে দেশটির জাতীয় অর্থনীতি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা খাত একেবারে ধ্বংসের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের দেয়া তথ্য মতে, ২০২১ সালের জুনের শেষে পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋন এবং দেনার স্থিতির পরিমাণ ১১৬.৩০৯ বিলিয়ন ডলারে এসে পৌঁছেছে। যেখানে ২০২০ সালের একই সময়ে দেশটির বৈদেশিক ঋনের পরিমাণ ছিল ১১৩ বিলিয়ন ডলার।

২০০৮ সাল থেকে পাকিস্তান এ পর্যন্ত তাদের বৈদেশিক ঋন এবং দেনার বোঝা অবিশ্বাস্যভাবে ১৫০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। যেখানে দেশটির ২০০৮ সালে বৈদেশিক ঋনের পরিমাণ ছিল ৪৫.৪ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া ২০২১-২২ অর্থ বছরে পাকিস্তানের ইমরান সরকার নতুন করে আরও ১৬.০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি বৈদেশিক ঋন প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যা তারা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফএ সহ বেশকিছু দেশের কাছ থেকে নিতে পারবে বলে আশাবাদী।

এদিকে পাকিস্তানের ইমরান সরকার ২০২১-২২ অর্থ বছরের নতুন বাজেটে মোট ৩,০৬০ বিলিয়ন রুপী কিংবা ১৯.৪৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রেখেছে শুধুমাত্র দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋন ও দেনা পরিশোধ করার জন্য। সে হিসেবে তাদের মোট বাজেটের একটি বড় অংশ বা ৩৬.০৯% পর্যন্ত সরাসরি ব্যয় হয়ে যাবে শুধুমাত্র ঋনের আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ করতে। এতে করে দেশটির সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার উপর মারাত্বক চাপ পড়তে বাধ্য। এতে করে দেশটির শিল্পায়ন, দরিদ্র বিমোচন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নমুলক কর্মকাণ্ড চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে।

এদিকে পাকিস্তান নতুন করে ২০২১-২২ অর্থ বছরে যে বৈদেশিক ঋন নিবে তার ৬০% পর্যন্ত সরাসরি ব্যয় করতে হবে আগে থেকে অন্য দেশ এবং সংস্থা থেকে নেয়া বৈদেশিক ঋনের আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ করতে। তার মানে পাকিস্তান বর্তমানে অন্য দেশে থেকে নেয়া পূর্বের ঋনের কিস্তি এবং এর সুদ বাবদ পরিশোধ করতে নতুন করতে আরেক দেশ বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা থেকে নির্বিচারে এবং কঠিন শর্তের মুখে ঋন নিতে বাধ্য হচ্ছে। যা বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক ঋন ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি সতর্ক বার্তা দেখা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান তার চীর বৈরী ভারতের সাথে সামরিক শক্তিতে পাল্লা দিতে গিয়ে আধুনিক ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ক্রয় এবং তার পাশাপাশি অপরিকল্পিত একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পসহ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পে নির্বিচারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের কারণে বর্তমানে পাকিস্তানের পাহাড় সমান বৈদেশিক ঋন ও দেনার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋন ও দেনার পরিমাণ হচ্ছে আনুমানিক ১ লক্ষ ৪৫ হাজার পাকিস্তানী রুপীর কাছাকাছি।

এদিকে তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের ইমরান সরকারের কৌশলগত সম্পর্ক ও সখ্যতা অতি মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকটা রুষ্ট হয়ে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রশাসন পাকিস্তানকে দেয়া তাদের ঋন, অর্থিক অনুদান এবং সহায়তা অনেকটা বন্ধ বা সংকুচিত করে দেয়। অন্য দিকে সৌদি এবং আমিরশাহী প্রশাসন পাকিস্তানকে তাদের আগের দেয়া ঋন পরিশোধে প্রবল চাপ দিতে থাকে। যা পাকিস্তানের জন্য খুবিই বিপদের কারণ হয়ে দেখা দেয় এবং এই বিপদ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাকিস্তান শেষমেশ তার পরীক্ষিত বন্ধু চীন এবং আইএমএফ এর কাছে হাত পাততে বাদ্ধ হয়। সেই সুযোগে অতি সাম্প্রতিক সময়ে চীন কিন্তু পাকিস্তানের অন্যতম বৈদেশিক ঋন প্রদানকারী এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর ও স্থাপনা দীর্ঘ মেয়াদে নিজ নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এগুলোর প্রধান ব্যবহারকারী বা সুবিধাভোগী হতে যাচ্ছে চীন নিজেই। চীন ইতোমধ্যেই সুবিশাল ৬২ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

২০২০-২১ অর্থ বছরে পাকিস্তান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী বৈদেশিক ঋন নিয়েছে। যেখানে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে পাকিস্তান মোট ১০.৫০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে মোট ৮.৪০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋন নিয়েছিল।

স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২১ সালের ১৮ই জুলাই এর হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১.১১৭ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ১৮.২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। তবে এই রিজার্ভের ৬০% কিনা আবার বৈদেশিক ঋন ও আর্থিক সহায়তার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আর দেশটির বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋন ও দেনার বিবেচনায় ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ কিন্তু মোটেও যথেষ্ঠ নয়।

২০২০ সাল থেকে চলা করোনা মহামারির মধ্যেও পাকিস্তান তার জাতীয় রপ্তানি বৃদ্ধির ধারা কিছুটা হলেও অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে পাকিস্তানের মোট পন্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৫.৩ বিলিয়ন ডলার এবং তা গত বছরের তুলনায় ১৮% বেশি। এদিকে চলতি ২০২১ সালের জুন মাসে পন্য রপ্তানি করেছে ২.৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও দেশটি ঠিক একই সময়ে বিদেশ থেকে পন্য আমদানি করেছে ৪২.৩ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে ২০২০-২১ (এপ্রিল-মার্চ) অর্থ বছরে ভারতের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৯০.১৮ বিলিয়ন ডলার এবং যা আফের অর্থ বছর অপেক্ষা ৭.৪% কম ছিল। যেখনে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ভারতের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩১৩.৩৬ বিলিয়ন ডলার। তবে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলতি ২০২১ সালের ১৬ই জুলাই এর স্থিতি অনুযায়ী ৬১২.৭৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যা কিনা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দেয়া তথ্য অনুযায়ী দেশটির বৈদেশিক ঋন ও দেনার স্থিতির পরিমাণ চলতি ২০২১ সালের ৩১শে মার্চ এর হিসেব অনুযায়ী ৫৭০ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০শে জুনে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋন ও দেনার স্থিতির পরিমাণ ছিল ৪৪.১০৫ বিলিয়ন ডলার। যা টাকার হিসেবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে) দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৮৯৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আবার ২০২০-২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৩৮.৭৬ এবং লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪১ বিলিয়ন ডলার। যদিও ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বাংলাদেশের পন্য রপ্তানির পরিমাণ ৩৩.৬৭ বিলিয়ন ডলার এবং মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৪৭.১৬৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২১ সালের ২৯শে জুন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৬.০৮ বিলিয়ন ডলারের সীমাকে স্পর্শ করে।

তবে প্রকাশ থাকে যে, বিশ্বের একক কোন দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে চীনের কাছে। ২০২১ সালের জুন মাসের হিসেব অনুযায়ী চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.২১৪ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৩,২১৪ বিলিয়ন ডলার। তবে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিশ্বের সর্বোচ্চ হলেও চীনের বৈদেশিক ঋনের পরিমাণও কিন্তু মোটেও কম নয়। মে ২০২০ এর হিসেব অনুযায়ী চীনের মোট বৈদেশিক ঋন ও দেনার স্থিতির পরিমাণ ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলার বা ২,৪০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.