--- বিজ্ঞাপন ---

পঞ্চগড়ে চা চাষের নীরব বিপ্লব

0

মো: মিজানুর রহমান, পঞ্চগড় থেকে

বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত পঞ্চগড় ইতোমধ্যে দেশের তৃতীয় চা উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল হোসেনের ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে টবে করে চা চাষ শুরু হয়। পরে এতে সফলতা আসলে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের একটি বিশেষজ্ঞ দল উত্তরাঞ্চলে সফর করে। তারা এসে মাটি পরীক্ষা করে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এলাকার মাটিতে চা চাষ সম্ভব বলে জানায়। এরপরে ২০০০ সালে তেঁতুলিয়া উপজেলার সীমান্ত এলাকায় তেতুঁলিয়া টি কোম্পানী এবং পরে কাজী এন্ড কাজীসহ বেশ কিছু কোম্পানী বাগান পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে পতিত জমিতে চা চাষ শুরু করে। তখন থেকে আস্তে আস্তে করে বাণিজ্যিকভাবে ও ক্ষুদ্র পরিসরে সমতল ভূমিতে বাড়তে থাকে চা চাষের পরিধি। পরে ২০০১ সালে উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের উন্নয়নে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের আওতায় বাংলাদেশ চা বোর্ডের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এর একটি উপকেন্দ্র পঞ্চগড়ে স্থাপিত হয়। যা পরে আঞ্চলিক কার্যালয়ে রপান্তরিত হয়। পঞ্চগড়ের মানুষ আজ থেকে ২০ বছর আগে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু এখন চা চাষে নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে চা। জেলায় চা চাষ হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের যেমন আয়ের পথ তৈরি হয়েছে তেমনি সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান। চা চাষে প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩০ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ লাভবান হচ্ছে। এই চা দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। চা বাগান দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত আসছে পর্যটক। মুগ্ধ হচ্ছে তেঁতুলিয়ার সমতল ভূমির চা বাগান দেখে। মাত্র কয়েক বছরে ভরে গেছে সবুজের সমারোহে। বর্তমানে চা পাতার দাম ও চাহিদা কৃষকদের চা চাষে আগ্রহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। জেলার বাজার দর অনুযায়ী প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা বিক্রি ১৪ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত দাম ওঠানামা করে। মার্চ মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ৯ মাস চা পাতা উত্তোলন করা যায়। বছরে ৬ থেকে ৭ বার কাঁচা চা পাতা সংগ্রহ করা যায়। এ ছাড়া ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চায়ের চারার পরিচর্যা, জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও প্রুনিং বা বর্ধিত অংশ কেটে সাফ করা হয়। যাতে করে বেশি বেশি নতুন পাতার সৃষ্টি হয়। চা চাষ কৃষকদের অন্য আবাদের তুলনায় লাভজনক হওয়ায় অনেক চাষীই অন্য ফসল চাষ ছেড়ে চা চাষে ঝুঁকছেন।

পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরুর প্রায় ৭ বছর পরে ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট এবং ২০১৪ সালে নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলায় চা চাষ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের এই ৫ জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ১০ টি ও অনিবন্ধিত ১৭ টি ( ২৫ একরের উপরে) বড় চা বাগান রয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৫১০ টি নিবন্ধিত ও ৫ হাজার ৮০০ অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়াতনের চা বাগান ( ০ থেকে ২৫ একরের কম) রয়েছে। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে মোট ১০ হাজার ১৭০ দশমিক ৫৭ একর জমিতে চায়ের চাষ হচ্ছে এবং আরো প্রায় ৪০ হাজার একর সমতল জমি চা চাষের উপযোগী রয়েছে।

এছাড়া পঞ্চগড়ে ১৭ টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা কারখানা চালু আছে। এছাড়া আরো ১৫ টি চা কারাখানাকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব কারাখানায় প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা ১৪ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত দরে কেনা হয়। গত ২০১৯ সালে উত্তরাঞ্চলে ৯৬ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। বাজার দর বেশি থাকায় যার বাজার মূল্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। যা থেকে ১৫% হারে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকার মত। এছাড়া ২০২০ সালে উত্তরাঞ্চলে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি কাঁচা উৎপাদিত হয়। যা দেশের দ্বিতীয় চা উৎপাদন এবং জাতীয় চা উৎপাদরে মোট ১২ শতাংশ। যার এক চর্তুথাংশ অর্থাৎ ২৫ লাখ কেজি উৎপাদন করে মৈত্রী টি ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড। বাজার দর কিছুটা কম থাকায় এর বাজার মূল্যে দাড়ায় ১৫৭ কোটি টাকা। যা থেকে ১৫% হারে সরকার রাজস্ব আদায় করে ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার মত।

এদিকে জেলায় ছোট ছোট শতাধিক চা প্যাকেটজাত করণ কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব কোম্পানি চট্টগ্রামের নিলাম বাজার থেকে চা কিনে এনে প্যাকটজাত করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করে। যা দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানী শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় পঞ্চগড়ের চায়ের ব্যাপক সুনাম থাকায় প্যাকেট চায়ের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। এ থেকে যেমন ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে তেমনি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে সরকার পাচ্ছে বিপুল রাজস্ব।

তেতুঁলিয়া উপজেলার চা চাষী আশরাফুল ইসলাম জানান, তেতুঁলিয়ার মাটি চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তা ছাড়া চা চাষে কোন ঝামেলা নেই। নেই তেমন কোন বাড়তি পরিশ্রমও। চা চাষ অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক। যেসব জমিতে অন্য কোনো ফসল হয় না সেসব জমিতে সহজে চায়ের চাষ করে লাভবান হওয়া যায়। অল্প বিনিয়োগে বেশি অর্থের যোগান দেয় চা শিল্প। যা অন্য কোন ফসল থেকে এত অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হয়না। এ ছাড়া চা চাষের জন্য চা বোর্ড প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করায় কৃষকেরা বেশ উপকৃত হচ্ছে।

বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী ইউনিয়নের চা চাষী রমেশ চন্দ্র রায় জানান, আমি অন্য চাষীদের চা চাষ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ৫০ শতক জমিতে চা চাষ শুরু করি। এরপরে বাড়তে বাড়তে আমার বর্তমানে ৭ একরের মত চা বাগান রয়েছে। পঞ্চগড় সহ উত্তরাঞ্চলের মানুষ চায়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। প্রতি বিঘা চা বাগান থেকে বছরে ৬-৭ বার কাঁচা চা পাতা তোলা যায় এবং বছরে খরচ বাদে ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা বাড়তি আয় হয় যা অন্য কোন ফসলে হয়না।

উপজেলার চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের চা চাষী মো মিজানুর রহমান জানান, আমরা উত্তরাঞ্চলের মানুষ দিন দিন চা চাষে বেশ ঝুঁকে পড়ছি। সমতলের চা চাষ এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। উত্তরাঞ্চলে চা চাষে যেমন সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি যদি সরকারী ভাবে একটি নিলাম বাজার স্থাপন করা হয় তাহলে আমরা চা চাষীরা চাষের ন্যায্য মূল্যে পাবো। তাহলে আমরা আরো বেশি লাভের মুখ দেখতে পারবো।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.