--- বিজ্ঞাপন ---

রাশিয়ার অত্যাধুনিক জেট ফাইটার এসইউ-৩৫

0

রাশিয়ার আরটি নিউজ এজেন্সির দেয়া তথ্যমতে, গত ৩১শে জুলাই শনিবার রাশিয়ার বিমান বাহিনীর একটি হাইলী এডভান্স এন্ড ম্যানুভারেবল এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সিরিজের জেট ফাইটার ক্রাস করেছে। মুলত রুটিন মাফিক প্রশিক্ষণ উড্ডয়ন চলাকালে রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় খাবোরোভস্ক অঞ্চলের নিকট উখোতস্ক সাগরের বুকে একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে বিধ্বস্ত হয় যুদ্ধবিমানটি। তবে বিধ্বস্ত হওয়ার পূর্বেই বিমানে থাকা পাইলট নিজেকে ইজেক্ট করতে সক্ষম হন। এই তথ্যটি নিশ্চিত করেছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাছাড়া দূর্ঘটনা কবলিত এলাকায় তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান চালিয়ে পাইলটকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে মূল ঘাঁটিতে ফিরিয়ে এনেছে রশিয়ার বিমান বাহিনীর উদ্ধারকারী দল।

বর্তমানে তিনি সুস্থ্য এবং নিরাপদ আছেন। তবে রাশিয়ার সুখোই কর্পোরেশনের তৈরি এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সিরিজের মাল্টিরোল এণ্ড এয়ার সুপিউরিটি জেট ফাইটারকে বিশ্বের সেরা ৫টি যুদ্ধবিমানের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি প্রথম আকাশে উড্ডয়ন করে ১৯শে ফেব্রুয়ারী ২০০৮ সালে এবং রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে প্রথম সার্ভিসে আসে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। এ ফাইটার বিমান বিধ্বস্তের পর রাশিয়া বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক তদন্ত চালাচ্ছে। কারন বিশ্বরাজারে ফাইটার এ বিমানের প্রচু ক্রেতা রয়েছে। একই সাথেেএটি আরও যুগোপযোগি করারও কাজ চলছে।

এটিকে মুলত সভিয়েত ইউনিয়ন আমলের এসইউ-২৭এম সিরিজরর স্টেট অব দ্যা আর্ট যুদ্ধবিমানের ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে আরো শক্তিশালী ২টি সার্টান এএল-৪১এফ১এস আফটার টার্বোফ্যান ইঞ্জিন, অত্যাধুনিক রাডার ও এভিয়নিক্স সিস্টেম সংযোজন করে ডিজাইন করে রাশিয়ার সুখোই ব্যুরো এবং এটি Komsomolsk-on-Amur Aircraft প্লান্টে উৎপাদন করা হয়।

চীন ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ার কাছ থেকে ২.০০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ২৪টি সুপার এডভান্স এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই জেট ফাইটার ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করেছিল। সে হিসেবে প্রতিটি এসইউ-৩৫এস ফ্যালাংকার-ই জেট ফাইটারের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৮৬.০০ মিলিয়ন ডলার বা তার কাছাকাছি। তবে চুক্তি মোতাবেক রাশিয়ান সুখই কর্পোরেশন ২০১৮ সালের মধ্যে ২৪টি এসইউ-৩৫এস ফ্যালাংকার-ই জেট ফাইটার চীনের কাছে সরবরাহ করবে। সুখই কর্পোরেশন তাদের নিজস্ব সামরিক পরিবহণ বিমানে করে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ব্যাচে ৪টি এসইউ-৩৫এস সরবরাহ করে এবং সাম্প্রতিকতম সময়ে চাইনিজ পিপলস লিবারেশন এয়ার ফোর্স দ্বিতীয় ব্যাচে নতুন ১০টি এসইউ-৩৫ ফ্ল্যাংকার-ই জেট ফাইটার হাতে পেয়েছে। চুক্তি মোতাবেক অবশিষ্ট্য ১০টি এসইউ-৩৫এস ফ্যালাংকার-ই জেট ফাইটার ২০১৮ সালের মধ্যে চলে আসবে। মজার বিষয় হচ্ছে, রাশিয়া বিমানের যে কোন অংশ এবং এর যন্ত্রাংশ কপি বা ক্লোন করার উপর কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করে চুক্তি সম্পন্ন করে। যাতে চীন ভবিষ্যতে এর ক্লোন কপি তৈরির সুযোগ না পায়। তাছাড়া, ভয়ঙ্কর আক্রমন ক্ষমতা সম্পন্ন সুপার ম্যানুভারিটির এসইউ-৩৫এস ফ্যালাংকার-ই জেট ফাইটার ক্রয়ের মাধ্যমে চীন আন্তজার্তিক বাজার বা অন্য কোন দেশ থেকে ভবিষ্যতে আর কোন যুদ্ধবিমান ক্রয় বা আমদানি করা হবে না এ মর্মে চুড়ান্ত ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।মুলত সুপার এডভান্স এন্ড হাইলী ম্যানুভারেবল এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই বর্তমান সময়ের একটি অত্যাধুনিক এবং উচ্চ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ৪++ জেনারেশনের মাল্টিরোল আক্রমনাত্বক জেট ফাইটার, যা এসইউ-২৭ মেইন ফ্রেম এর উপর নির্ভর করে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে। এসইউ-৩৫ ফ্ল্যাংকার-ই এর প্রথম সফল পরীক্ষামুলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করা হয় ১৯৮৮ সালে কিন্তু তৎকালীন সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার ফলস্রুতিতে ও চরম তহবিল সংকটের মুখে রাশিয়া ১৯৯১ সালে এসইউ-৩৫ ফ্ল্যাংকার-ই এর প্রজেক্ট বাতিল করতে বাধ্য হয়। তবে রাশিয়ার সুখই ডিজাইন ব্যুরো আবার ১৯৯৫ সালে স্বল্প পরিসরে এসইউ-৩৫ ফ্ল্যাংকার-ই প্রডাকশন লাইন শুরু করতে সক্ষম হলেও নতুন করে উচ্চ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এসইউ-৩৫ এর আপগ্রেডেড ও আধুনিক ভার্সন এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই উৎপাদন শুরু করে ২০০৬ সালে এবং এর প্রথম সফল উড্ডয়ন পরীক্ষা সম্পন্ন করে ২০০৮ সালে। প্রথম ব্যবহারকারী হিসেবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার বিমান বাহিনীকে ৬০টি সুপার এডভান্স এসইউ-৩৫ ফ্ল্যাংকার-ই সরবরাহ করা হয়েছে এবং ২০২২ সালের মধ্যে এরুপ আরো ১২০টি জেট ফাইটার সংযুক্ত করা হতে পারে। তাছাড়া, রাশিয়া কৌশলগত সম্পর্কের অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সুদান বিমান বাহিনীর কাছে আনুমানিক ৪টি এসইউ-৩৫ ফ্ল্যাংকার-ই সরবরাহ করে এবং ইন্দোনেশিয়ার সরকার তাদের বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে রাশিয়ার সুখই কর্পোরেশনের ১১টি এসইউ-৩৫ ফ্ল্যাংকার-ই মাল্টিরোল জেট ফাইটার ক্রয়ের চুড়ান্ত চুক্তি সম্পন্ন করেছে বলে জানা যায়।।

৪++ জেনারেশনের এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সুপার ম্যানুভারেবল মাল্টিরোল কে আকাশ পথে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর আক্রমন ক্ষমতা সম্পন্ন এবং ডগ ফাইটে বিশেষ উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। এছাড়া সিঙ্গেল সিটের এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সিরিজের হাই ম্যানুভারেবল জেট ফাইটারের সর্বোচ্চ টেক অফ ওয়েট ৩৪৫০০ কেজি। এছাড়া যে কোন প্রতিকূল আবহাওয়া ও পরিবেশে এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সর্বোচ্চ ১৮০০০ মিটার উচ্চতায় উড্ডয়ন করতে সক্ষম। আবার, এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই এর সর্বোচ্চ গতিসীমা ২.২৫ ম্যাক ও কমব্যাট অপারেশন রেঞ্জ ৩৬০০ কিলোমিটার।

এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সিরিজের মাল্টিরোল জেট ফাইটারের পাওয়ার জেনারেশন হিসেবে ২টি অত্যন্ত শক্তিশালী ১১৭এস/এএল-৪১এফ১এস থ্রাস্ট ভেক্টোরিং আফটার টার্বোফ্যান ইঞ্জিন এবং পাশাপাশি উড্ডয়নরত অবস্থায় রি-ফুয়েলিং প্রোব সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে। এডভান্স এভিয়োনিক এবং ইলেকট্রনিক্স সিস্টেম সমৃদ্ধ এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সিরিজের জেট ফাইটারে উচ্চ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ নতুন প্রজন্মের প্যাসিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড এ্যারি (পিইএসএ) রাডার সিস্টেম ব্যাবহার করা হয়েছে, যা এটিকে একাধারে যুগৎপত ভাবে ৩ মিটার থেকে ২৫০ মাইলের মধ্যে ৩০টি টার্গেট ট্রাকিং করা ও বিশেষ করে স্টিলথ টেকনোলজি বেসড এফ-২২ বা এফ-৩৫ জেট ফাইটারের বিরুদ্ধে কার্যকর সক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি যুগৎপত আকাশ থেকে আকাশ ও আকাশ থেকে ভূমির একাধিক টার্গেটে মিসাইল ফায়ার করার সক্ষমতা প্রদান করেছে। এছাড়া, এতে ইলেকট্রনিক ওয়ারফার সুইট এবং মাল্টি ফাংশন এলইডি মনিটর সুবিধাসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সিরিজের প্রতিটি জেট ফাইটারের প্রযুক্তি ভেদে মূল্য ৮০-১০০ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি হতে পারে।

সুপার এডভান্এস সইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই ১২টি হার্ড পয়েন্টে সর্বোচ্চ ৮০০০ কেজি পর্যন্ত ক্ষেপনাস্ত্র, গাইডেড এন্ড আনগাইডেড বম্বস বহন করতে সক্ষম। এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই লং রেঞ্জে ১২০ মাইল দুরুত্বে কে-৭৭এম রাডার গাইডেড মিসাইল (ন্যাটো রিপোটেড কোড নেম এএ-১২ এড্যার) ব্যাবহার করে, সর্ট রেঞ্জ আক্রমনে আর-৭৪ (এএ-১১ আর্চার) মিসাইল যার পাল্লা ২৫ মাইল এবং মিডিয়াম রেঞ্জে আর-৩৭ (এএ-১৩ এ্যারো) মিসাইল ব্যাবহার করতে পারে। তাছাড়া আকাশ পথে কার্যকর ডগ ফাইটিং এর উপযোগী করে ইন্টান্যাল ইউপন্স হিসেবে ১৫০ রাউন্ডের ৩০ মিলিমিটার স্মুথবোর ক্যানন সংযুক্ত করা হয়েছে।

সুপার এডভান্স এন্ড ম্যানুভারেবল এসইউ-৩৫ ফ্ল্যাংকার-ই সিরিজের মাল্টিরোল জেট ফাইটার ভয়ঙ্কর আক্রমনাত্বক ও আকাশে কার্যকর ডগ ফাইটের জন্য বিশেষ ভাবে ডিজাইন করা হলেও এর বড় সমস্যা হচ্ছে এটির জটিল রিপিয়ার এন্ড ম্যানটেন্যান্স সিস্টেম এবং অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল অপারেটিং কস্ট। এর অর্থ এসইউ-৩৫ ফ্ল্যাংকার-ই এর প্রতি ঘন্টা উড্ডয়ন খরচ আনুমানিক ১৮০০০ – ২৪০০০ ডলার এবং পরবর্তী অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করাটাও বেশ সময় সাপেক্ষ যা ১৯ থেকে ২৬ ঘন্টা পর্যন্ত লাগতে পারে বলে মনে করা হয়। তাছাড়া ইউরোপ আমেরিকার মতো বিমান উৎপাদনকারী কর্পোরেশনগুলোর মতো রাশিষার বিমান কর্পোরেশন বিক্রয় পরবর্তী সারা বছরব্যাপী অতি মুনাফা লাভের আশায় অত্যন্ত চাতুরতারসাথে অপারেটিং এন্ড ম্যানট্যেনেন্স কস্ট যথা সম্ভব জটিল ও বৃদ্ধি করে বিশেষভাবে ডিজাইন ও উৎপাদন করে থাকতে পারে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রেতা হিসেবে চীনের বিমান বাহিনী ২৪টি এবং মিশরের বিমান বাহিনী ১৭টি (মোট ২৪টি অর্ডারকৃত) এসইউ-৩৫এস সিরিজের এডভান্স মাল্টিরোল এণ্ড এয়ার সুপিউরিটি জেট ফাইটার অপারেট করে। তাছাড়া রাশিয়ার বিমান বাহিনী ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৮টি এই জাতীয় এডভান্স জেট ফাইটার অপারেট করছে এবং ২০২০ সালের আগস্ট মাসে আরো নতুন করে মোট ৩০টি এসইউ-৩৫এস জেট ফাইটার ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এ নিয়ে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে রাশিয়ার বিমান বাহিনি মোট ১২৮টি এসইউ-৩৫এস সিরিজের হাইলী ম্যানুভারেবল জেট ফাইটার ব্যবহার করবে।

এদিকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্সের একটি এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সিরিজের জেট ফাইটার নিয়মিত উড্ডয়ন চলাকালে তাইওয়ানের কাছাকাছি সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। বেশকিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাইওয়ানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মিসাইলের আঘাতে যুদ্ধবিমানটি ধ্বংস হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়লে তাইওয়ানের সরকারের তরফে এর সত্যতা সরাসরি অস্বীকার করা হয়।

ওয়েপন্স, ট্রেনিং এণ্ড মেইটেনেন্স প্যাকেজ ভেদে প্রতিটি এসইউ-৩৫এস ফ্ল্যাংকার-ই সিরিজের মাল্টিরোল এণ্ড এয়ার সুপিউরিটি জেট ফাইটারের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ৮৫ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৩০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বা তারও বেশি মূল্য পারে। অন্যদিকে এই জেট ফাইটারের পার আওয়ার অপারেটিং এণ্ড ফ্লাইট কস্ট কিন্তু মোটেও কম নয়। এর পার আওয়ার অপারেটিং এণ্ড ফ্লাইট কস্ট ২০ থেকে ২৪ হাজার ডলারের কাছাকাছি হতে পারে। তাছাড়া এর রিপিয়ার এণ্ড মেইন্টেনেন্স ব্যবস্থাপনা বেশ জটিল এবং সময় সাপেক্ষ একটি বিষয়। যা কিনা উন্নয়নশীল এবং স্বল্প আয়ের দেশের বিমান বাহিনীর জন্য মোটেও সুবিধাজনক এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.