--- বিজ্ঞাপন ---

কোন পথে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা

0

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি বর্তমানে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশেই তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যতটা সম্ভব আধুনিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর করে গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে তারা বিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই অনেকটা পুরনো মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেড়িয়ে এসে শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই বাস্তবে প্রয়োগ যোগ্য একটি একমুখী, আধুনিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বান্ধব শিক্ষা কারিকুলাম প্রনয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের উদীমান ও উন্নয়নশীলজ দেশগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাদের মোট জিডিপির ১০% থেকে ১৫% পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিকায়নে ব্যয় করে যাচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারও শিক্ষা খাত উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ দিয়েছেন ৭১,৯৫৩ কোটি টাকা। যা কিনা শতকরার হিসেবে মোট বাজেটের ১১.৯২%। আবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত মোট ব্যয়ের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৬,৩১৪ কোটি টাকা। এটি শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত মোট অর্থের ৩৬.৫৭%। অন্যদিকে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৬,৪৮৬ কোটি টাকা। যা কিনা মোট শিক্ষা বাজেটের ৫০.৭১%।
উন্নয়নশীল বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীকে আরো উৎসাহী করে গড়ে তোলার স্বার্থে একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত একটি বৈষম্য মুক্ত, একমুখী এবং আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। আবার তারা শ্রেণিকক্ষে পাঠ্য পুস্তক ও শিক্ষা উপকরণের সর্বোচ্চ ব্যাবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন আধুনিক কলা কৌশল ও পদ্ধতি নির্ভর একটি কার্যকর ব্যবহারিক বা প্যাক্টিক্যাল বিষয় বা ক্লাস নির্ভর শিক্ষা কারিকুলাম প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে। আর বাস্তব জীবন ভিত্তিক ব্যবহারিক (প্যাক্টিক্যাল) বিষয়গুলো একেবারেই বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক এবং ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগ, শিক্ষার্থীর শতভাগ অংশগ্রহণ, তথ্য সংগ্রহ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
তবে অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্য যে, এক বিংশ শতাব্দীর আধুনিক যুগে এসেও আমরা কিন্তু আজো প্রাথমিক স্তর থেকে একেবারে উচ্চ শিক্ষাস্তর পর্যন্ত একটি একমুখী, বাস্তব জীবন ভিত্তিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের দেশের শিক্ষাস্তরের সকল ক্ষেত্রেই আজো সেই লেকচার ও মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর হয়ে পড়ে রয়েছে। তবে বর্তমানে আমাদের সম্মানিত সরকার ও শিক্ষাবিদদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষাস্তরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি শিক্ষা কারিকুলাম প্রনয়ন করা হচ্ছে।
আবার বিজ্ঞান শিক্ষাকে সহজ এবং আনন্দজনক করে বাস্তবায়ন ও উপস্থাপন না করতে পারার জন্য দেশের শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশের মনে বিজ্ঞান ও গণিত ভীতি কাজ করে এবং অনেকেই এটিকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান শিক্ষায় ব্যাবহারিক (প্যাক্টিক্যাল) ক্লাস ও পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হলেও তার বাস্তবায়ন কিন্তু আমাদের দেশে এটি অনেকটাই কাগজে কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। যেখানে কিনা সিঙ্গাপুর বা ইসরাইলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন শিক্ষার্থী যদি তাত্ত্বিক বিষয়ে খুব ভালো করে এবং ব্যবহারিক ক্লাসগুলোতে নিয়মিত কিংবা সক্রিয় অংশগ্রহন না করে সেক্ষেত্রে চূড়ান্ত মূল্যায়নে সেই শিক্ষার্থীর সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না।
এখানে লক্ষ্য করার মতো একটি বিষয় যে, আমাদের দেশে আজো কিন্তু ৭০% পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত জ্ঞান দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন না করেই পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫.০০ স্কোর অর্জন করে এবং এই শিক্ষাগত ঘাটতি বা দূর্বলতা নিয়েই সরাসরি উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করছে। আবার উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রটাই কিন্তু যথেষ্ঠ জটিল এবং স্বেচ্ছাচারিতায় পরপূর্ণ বলা চলে। বর্তমানে বিষয়টি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার্থী এক দিকে নিজে পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিচ্ছে। আবার সেই পরীক্ষার্থীর ছয় থেকে আটটি ব্যাবহারিক বা প্রাক্টিক্যাল খাতা অন্য কেউ হাজার টাকার বিনিময়ে এঁকে এবং লিখে দিচ্ছেন। এদিকে সেই ব্যাবহারিক খাতার উপর ভিত্তি করে এবং লোক দেখানো কিম্বা অনেকটা দায় সারা গোছের মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীকে দেয়া হচ্ছে ৯০% থেকে ৯৫% কিংবা মুখ চেনা দেখে দেয়া হচ্ছে শতভাগ ফুল মার্কস। অথচ তারা আদৌ জানে না তাঁদের ব্যাবহারিক খাতায় কি লেখা রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী কিন্তু বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের ব্যবহারিক সংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান, দক্ষতা দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন না করেই পরীক্ষায় জিপিএ-৫.০০ নম্বর পেয়ে যাচ্ছে অনায়েসেই। আবার এখান থেকে তারা উঠে আসছে একেবারেই উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ ফল বিপর্যয় এবং অপারগতা কিন্তু দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার অবব্যস্থাপনা ও বেহাল দশাই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। তাই এসব কথিত ভালো ফলাফল অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের এই পরীক্ষায় নিজের যোগ্যতা সঠিকভাবে প্রমাণ করতে না পারাটাও কিন্তু আমাদের দেশের চলামান বিপর্যস্থ শিক্ষার করুণ চিত্রটি ফুটে উঠেছে বলে আমি মনে করি। তবে দেশের বড় বড় শহর অঞ্চলে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের আধুনিক ল্যাব বা ফ্যাসালিটিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে কাঙ্খিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বিশেষ করে দেশের গ্রামীন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার চর্চা ও মান একেবারেই তলানীতে এসে ঠেকেছে।
আমাদের দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে ভোকেশনাল শাখায় ইলেক্ট্রনিক্স, কম্পিউটার এবং অটোমোবাইলস এর মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ট্রেডে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করে। অথচ এই জাতীয় বেশির ভাগ কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভালো মানের ট্রেড সংশ্লিষ্ঠ ল্যাব তো দূরের কথা হাতে কলমে কাজ করার মতো উপযুক্ত কোন ক্ষেত্রই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আবার কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ভালো মানের কম্পিউটার ও অন্যান্য ল্যাব থাকলেও তার ব্যবহার ও শিক্ষার্থীর শতভাগ অংশগ্রহণ কোন এক অজানা কারণে নিশ্চিত করাটা সম্ভব হচ্ছে না। আবার তারা যে নিকটবর্তী কোন ফ্যাসালিটিতে কিংবা অটোমোবাইলস গ্যারেজে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে বাস্তব জ্ঞান লাভ করছে বিষয়টি তাও কিন্তু নয়। আসলে আমাদের দেশের কারিগরি শিক্ষা পদ্ধিতিও কিন্তু ভয়ানকভাবে মুখস্ত বিদ্যার উপর নির্ভর করে টিকে আছে। এখানে বাস্তব জীবন নির্ভর কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাটি হাতে কলমে না হয়ে বরং কাগজে কলমের সুতোয় বাধা পড়ে রয়েছে এখনো।
বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তর থেকে একেবারেই উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিক্ষার মূল ভিত্তি কিন্তু মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা। অর্থ্যাৎ আমাদের দেশের যে শিক্ষার্থী যত বেশি মুখস্ত করতে পারে, তাকে তত বেশী মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে বাস্তব জীবন ভিত্তিক শিক্ষা অর্জন এবং জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির যথাযথ প্রয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় যোগ্যতা ভিত্তিক বা সৃজনশীল ধারা যেভাবে প্রয়োগ এবং বস্তবায়ব করা হচ্ছে তাতে করে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আরোও ভয়ঙ্কর মাত্রায় অদক্ষ হয়ে পড়ছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের আনুমানিক ৪৫% পর্যন্ত শিক্ষকেরা নিজেই সৃজনশীল ভিত্তিক শিক্ষা সম্পর্কে নুন্যতম ধারনা রাখেন না। তাছাড়া সৃজনশীল নামে যে অবাস্তব শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তা আদৌ সৃজনশীল কিনা তা আমাদের দেশের শিক্ষাবিদদের ভেবে দেখা উচিত। বিশেষ করে একমুখী বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় এর প্রয়োগ এবং যথাযথ ব্যবহারে শতভাগ নিশ্চিত করতে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রনয়নের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে আমাদের সম্মানিত সরকারের পাশাপাশি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসার বিকল্প কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.