--- বিজ্ঞাপন ---

কোন পথে আমেরিকার অর্থনীতি

0

কাজী আবুল মনসুর/সিরাজুর রহমান#

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির দীর্ঘ মেয়াদি এক অর্থ লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে, ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিগত দুই দশকে আফগানিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক আগ্রাসন পরিচালনা এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর রণপ্রস্তুতির পেন্টাগনের মোট আনুমানিক ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১৪ লাখ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। আর এই অর্থের আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধেক চলে গেছে আমেরিকার প্রথম সারির অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানি, অস্ত্র সরবরাহকারী কন্ট্রাক্টর বা কর্পোরেশনের পকেটে। মুলত সারা বিশ্বকে এখনো পর্যন্ত আমেরিকা নিজে নিয়ন্ত্রণ করলেও বাস্তবে আমেরিকার সরকার ও তার প্রশাসনকে গোপনে বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সুপার জায়ান্ট অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানি বা কর্পোরেশনগুলো।

আর আমেরিকার সাধারণ জনগণের ট্যাক্সের অর্থ লাগামহীন লুটপাটের পিছনে কৌশলে বড় ধরণের অবদান রেখে চলেছে মার্কিন লকহীড মার্টিন, রেইথন, নরথ্রপ গ্রুম্যান, জেনারেল ডাইনামিক্স এবং বোয়িং এর মতো দেশটির সেরা সব অস্ত্র তৈরির কোম্পানিগুলো। এদিকে আবার আফগানিস্থানের দরিদ্র সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নের নামে ৬০ লক্ষ ডলার বা ৫১ কোটি টাকা ব্যয় করে ইউরোপ থেকে বিমানে করে উড়িয়ে আনা হয়েছিল উন্নত বিরল প্রজাতির ৯টি ছাগল। এ নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার করা হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যয়বহুল এই ছাগল পালনের প্রজেক্টটি বাতিল হয়ে যায়।

সারা বিশ্বে যুদ্ধ পরিচালনা ও চীন-রাশিয়ার প্রভাব বিস্তার ঠেকানোর নামে নির্বিচারে অর্থ ব্যয় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ নিজেই কিন্তু বিশ্বের সর্বোচ্চ ঋনগ্রস্থ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মুলত 3১শে ডিসেম্বর ২০২১ সালের হিসেব অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋন এবং দেনার স্থিতির পরিমাণের প্রায় ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার এসে পৌঁছেছে। যা কিনা বাংলাদেশী টাকার হিসেবে প্রায় ২,৩৮০ লক্ষ কোটি টাকার সমান। বিগত ১০ বছরের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋন গ্রহণের হার ও প্রবণতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে গেছে। যেখানে ২০২০ সালের ঠিক একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট ঋন ও দেনার পরিমাণ ছিল ২৩.৩০ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০১৫ সালে ছিল ১৮.০০ ট্রিলিয়ন ডলার।

তবে ২০২০ সালের হিসেব অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশী দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া মোট বৈদেশিক ঋনের স্থিতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। আর এই সুবিশাল বৈদেশিক ঋনের মধ্যে একক কোন দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ ১.২৬৬ ট্রিলিয়ন ডলার ঋন প্রদান করেছে জাপান। আর আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্টের চরম বানিজ্য বিরোধ এবং কৌশলগত শত্রুতা বিরাজ করলেও এ মুহুর্তে আমেরিকাকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋন প্রদানকারী দেশ কিন্তু চীন। ২০২০ সালের জুলাই মাসের হিসেব অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রদত্ত চীনের ঋনের স্থিতির পরিমাণ ১.০৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।

তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বৈদেশিক ঋন প্রদানকারী দেশের তালিকায় জাপান এবং চীনের পাশাপাশি ব্রাজিল, হংকং, লুক্সেমবার্গ, আয়ারল্যাণ্ড, যুক্তরাজ্যসহ আরো বেশকিছু দেশের নাম রয়েছে। এক্ষেত্রে লুক্সমবার্গ ২৬৭.৮ বিলিয়ন ডলার, ব্রাজিল ২৬৭.১ বিলিয়ন ডলার, সুইটজারল্যাণ্ড ২৪৭.৪ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্য ৪৫০ বিলিয়ন ডলার, হংকং ২৬৬.৪ বিলিয়ন ডলার, ভারত ২১৬ বিলিয়ন ডলার এবং আয়ারল্যাণ্ড ৩৩০.৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋন হিসেবে মার্কিন ফেডারেল সরকারের বণ্ড, ট্রেজারি বিল এবং নোটস ক্রয় করে রেখেছে। তবে প্রদত্ত ঋনের হিসাবটি কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে।

আবার দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আর্থিক খাত থেকে মার্কিন প্রশাসনের ঋন গ্রহনের প্রবনতা ও হার আশাঙ্খাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বিগত চার দশকের মধ্যে তা সর্বোচ্চ ২১.০০ ট্রিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। আর এই বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে সারা বিশ্বে একক সর্বোচ্চ ঋনগ্রস্থ দেশ হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

অতি মাত্রায় যুদ্ধ প্রিয়তা, সুবিশাল সামরিক বাহিনী নিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী শান্তির নামে আগ্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা এবং বিশেষ করে সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ শতাধিক সামরিক ঘাঁটি এবং স্থাপনা পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতি বছর ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অর্থ নির্বিচারে ব্যয় করে যাচ্ছে দেশটি। তাছাড়া আমেরিকার অভ্যন্তরে মোট প্রায় ৫ হাজারের কাছাকাছি সামরিক ঘাঁটি ও স্থাপনা রয়েছে। সারা বিশ্বে শান্তি স্থাপন এবং রাশিয়া-চীনের নব্য প্রভাব বিস্তার রুখে দিতে চলতি ২০২২ সালে মার্কিন প্রশাসন সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ৭৭০ বিলিয়ন বরাদ্দ দিয়ে বরাবরের মতো বিশ্বের সর্বোচ্চ সামরিক খাতে ব্যয়কারী দেশের প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে। যেখানে দেশটি ২০২১ সালে বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন ব্যয় সংযুক্ত করে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে মোট ৭৫৩.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল।

আর এহেন চরম মাত্রায় অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বা ঘাটতি নিরিসনে মার্কিন প্রশাসন অত্যন্ত কৌশলে সারা বিশ্বে যুদ্ধের আবহ তৈরি করে তাঁদের অতি লাভ জনক অস্ত্রের ব্যবসা চালিয়ে যেতে ব্যস্ত। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা ও আমীর শাসিত দেশগুলোর কাছে নির্বিচারে চাঁদাবাজির পাশাপাশি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম তুলে দিচ্ছে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। যদিও এই শত বিলিয়ন ডলারের তেল ও অস্ত্র বানিজ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই পাহাড় পরিমাণ ৭ ট্রিলিয়ন বৈদেশিক ঋনের বোঝা থেকে আগামী দুই দশকেও মুক্ত করতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।

তবে এটা ঠিক যে, বিশ্বের সর্বোচ্চ ঋনগ্রস্থ দেশ হওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্পদশালী দেশ হচ্ছে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মোট কথা বর্তমানে বিশ্বের ১০০টি সর্বোচ্চ রেভিনিউ অর্জনকারী এবং সম্পদশালী কোম্পনি বা কর্পোরেশনের মধ্যে প্রায় ৫০টি একক ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দখলে রয়েছে। যেমন বিশ্বের একক কোন সর্বোচ্চ আয় অর্জনকারী রিটেইলার কোম্পানি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ওয়ালমার্টের রেভিনিউ ৫২৩.৯৬ বিলিয়ন ডলার এবং নীট মুনাফা হিসেবে ১৪.৮৮ বিলিয়ন ডলার আয় করে। আবার বিশ্বের প্রথম কোন ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ বা মার্কেট ভ্যালুর কোম্পানি হচ্ছে আমেরিকার প্রযুক্তি পন্য আইফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এ্যাপল। ২০২১ সালের শেষের দিকে এ্যাপল জায়ান্ট কর্পোরেশনের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সীমাকে স্পর্শ করে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে।

আবার প্রায় ৭০ বছর ব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা বা কারেন্সি ডলার একক কোন গ্রহনযোগ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে তার যোগ্য স্থান ধরে রেখেছে। বর্তমানে বৈদেশিক বানিজ্যের ৮০% পর্যন্ত লেনদেন করা হয়ে থাকে ডলারের বিনিময়ে। জোটভুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরো ১৯৯৯ সালে অত্মপ্রকাশ করলেও তা কখনই ডলারের বিকল্প কিছু হয়ে উঠতে পারেনি। আবার রাশিয়ার রুবেল, চীনের কারেন্সি ইউয়ান বা জাপানের ইয়েন কোনটিই আন্তর্জাতিক আদর্শ মুদ্রা হিসেবে আমেরিকার ডলারের বিকল্প কিছু হয়ে ওঠার মতো যথেষ্ঠ যোগ্যতা অর্জন করেছে কিনা সন্দেহ। তাই আপাতত দৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক দেনা এবং ঋনের পরিমাণ যতই বেশি হোক না কেন দেশটির সার্বিক অর্থনীতি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা খাত আগামী এক শতাব্দীর মধ্যে ভেঙ্গে পড়ার আদৌ কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.