--- বিজ্ঞাপন ---

আকাশে বাতসে মাতম চলছে বাংলা ভাষার জন্য!

আমরি! বাংলা ভাষা- পর্ব ১

0

কাজী ফেরদৌস, অতিথি লেখক #

এখন ফেব্রুয়ারি মাস। তাই আকাশে বাতসে মাতম চলছে বাংলা ভাষার জন্য! রেডিও টেলিভিশনে চলছে কত নাটক সিনেমার ভিডিও ক্লিপ। সব তৈরি হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য। একুশ তারিখ শহীদ মিনার ভরে যাবে ফুলে ফুলে। প্রভাত ফেরি হবে। নাচ গান নাটক কত কিছু হবে! আ!মরি মরি বাংলা ভাষা! কিন্তু বাইশ তারিখ থেকে সব ভুলে আবার শুরু হবে ইংরেজির জন্য ভালোবাসা। যারা বাংলা ভাষা নিয়ে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস মেতে উঠে খোঁজ নিয়ে দেখলে দেখা যাবে তাদের বেশির ভাগ মানুষের ছেলে মেয়ে নাতি পুতি লেখা পড়া করে নামীদামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে।নয়তো ইতমধ্যেই পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে।ভাবতে পারেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে একটা বাচ্চার মাসিক টিউশন ফি চল্লিশ হাজার টাকা! একটু ভালো মানের স্কুল হলে পনের বিশ হাজার টাকা। তবে দশ হাজার টাকার নিচে কোন স্কুলে টিউশন ফি আছে কিনা সন্দেহ আছে। তবুও কষ্ট করে হলেও অনেক গার্ডিয়ান ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবেন। জাতে উঠতে হবে না?
বাংলা ক্রমে একটা অপাংতেয় শিক্ষার মাধ্যম হয়ে যাচ্ছে একশ্রেণির মানুষের উন্নাসিকতার কারণে। এখন সবাই ভাবছেন ইংরেজি ছাড়া জীবন অচল?অতএব, ইংরেজি শিখতেই হবে।
এটা অবশ্য মানতেই হবে বর্তমান পৃথিবীতে ইংরেজি জানাটা জরুরি। কিন্তু তার জন্য একেবারে বৃটিশ আমেরিকার সিলেবাসের ইংরেজি শেখা কি জরুরী?তার জন্য কি ও লেভেল এ লেভেল পরীক্ষা পাস করা জরুরি? ওসব না করে ও তো ইংরেজি শেখা যায়। এদেশে সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি সহ জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সর্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান যারা রেখেছেন বা রাখছেন তারা সবাই বাংলা মিডিয়ামে ন্যাশনাল কারিকুলামে লেখা পড়া করা ছাত্র ছাত্রী ছিলেন এবং এখনো যারা দেশে বিদেশে আলো ছড়াচ্ছেন বা দেশের ভাবমুর্তি উজ্জল করছেন তারা প্রায় সবাই বাংলা মিডিয়ামে ন্যাশনাল কারিকুলাম অনুসরন কারা ছাত্র ছাত্রী ।ইংরেজি মাধ্যমে লেখা পড়া করা কজন জ্ঞানীগুণী মানুষ এদেশে আছে বলতে পারেন? তবুও আমরা ছুটছি ইংরেজির দিকে। এই প্রবনতা এখন অনেক টা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। পাড়ায় পাড়ায় অলিতে-গলিতে গজিয়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন স্কুল।এখন এক ধরনের কিন্ডারগার্টেন সংস্কৃতির মধ্যে আমরা পুরো জাতি ডুবে যাচ্ছি। কেউ কি ভাবছেন একটা ভালো মানের বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক স্কুল গড়ে তোলার কথা? সেই প্রত্যন্ত গ্রামে ও গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডারগার্টেনে স্কুল!লক্ষ্য একটাই। শিক্ষা বানিজ্য! মানুষের মনের সস্তা আবেগ পুঁজি করে শিক্ষার নামে চলছে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বানিজ্য। কেউ আর এগিয়ে আসছেনা একটা ভালো মানের বাংলা মাধ্যমের প্রাইমারি বা মাধ্যমিক স্কুল গড়ে তোলার জন্য । ফলে হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি বেসরকারি প্রাইমারি আর মাধ্যমিক স্কুল পাড়ছেনা কুলান দিতে। ভর্তির জন্য তাই চলে প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা!সবাই নাকাল হচ্ছে ভর্তি প্রতিযোগিতায়। অভিভাবক শিক্ষার্থী সবাই নাকল হচ্ছে এই প্রতিযোগিতায়। ফলে বাড়ছে ভর্তি বানিজ্য।
দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর অবস্থা বড়ই করুন। ওখানে এখন অপারগ নাহলে কোন অবিভাবক আর তাদের সন্তানদের পড়তে চায় না।ওখানে যারা পাঠ দান করে তাদের যোগ্যতা নিয়ে ও আছে নানা ধরনের প্রশ্ন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক দলীয়করণ ও নিয়োগ বানিজ্য। নব্বুইয়ের দশকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পত্র পাওয়া যেতো। এখন সেটা দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত। তারপর ও আছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। ওটা ছাড়া আবার টাকা দিয়েও কাজ হবে না। চ্যানেল ধরতেই হবে সর্ব প্রথম। সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক চ্যানেল।
সরকারি স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম বিদেশেও একটু দুর্বল। সেখানে বেসরকারি স্কুল কলেজে লেখা পড়া করে বিত্তবান মানুষের সন্তানেরা। সাধারণ পাবলিক স্কুল গুলো তে কেয়ারিং একটু কম। কিন্তু তাই বলে একেবারে নিম্ন মানের শিক্ষা দেওয়া হয়না। কানডা এবং অস্ট্রেলিয়ার দুটো দেশের পাবলিক স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম দেখেছি। ওখানে সাধারণ মানুষের ছেলে মেয়েরা লেখা পড়া করে। অভিবাসীদের ছেলে মেয়েদের বড় অংশ টা ওখানেই লেখা পড়া করে। তবে প্রাইভেট স্কুল কলেজের মতো বিশেষ যত্ন আত্তি করা হয়না। ওখানে একটা গড়পড়তা মানের লেখা পড়া হয় যেটা একজন শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশের জন্য যথেষ্ট। অভিবাসীরা অনেকে নিজস্ব মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি অনুসরণের প্রয়োজনে কিছু নিজস্ব ভাবধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গড়ে তুলছে সেখানে। কারন হলো ওখানে বেসরকারি স্কুল কলেজ গুলো বেশির ভাগ ক্যাথলিক গীর্জার নিয়ন্ত্রণে। কানডায় দেখেছি এরকম অনেক স্কুল। ওখানে খৃষ্টান ধর্মের কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তাই অন্য ধর্মের অনুসারীরা ওখানে তাদের সন্তানদের পড়াতে অনাগ্রহী হয়ে থাকে। সরকারি স্কুলে এসবের বালাই নেই। তবে আমাদের দেশের মতো এত বৈষম্য মূলক শিক্ষা ব্যবস্হা আর কোথাও নেই বলেই আমার ধারণা। এই বৈসম্য সৃষ্টি হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। আগে ধনী-গরিবের শিক্ষার ক্ষেত্রে এত আকাশ পাতাল বৈসম্য ছিল না আমাদের শিক্ষা ব্যবস্হায়।এমকি আমরা যারা গ্রামের স্কুলে লেখা পড়া করেছি পরবর্তীতে তারাও শহরের স্কুলে এসে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হয়েছি। তখন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সেবা দুটোকেই মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখা হতো। এখন দুটোই পণ্য হয়ে গেছে। সুতরাং কড়ি খরচ করো আর ভালো মানের পণ্য খরিদ করো এটাই হয়েছে এখন রাষ্ট্র দর্শন। তাই মানুষ ছুটছে এখন ভালো মানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সন্ধানে।
বাংলা মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর জরাজীর্ণ দশা ক্রমাগত ভাবে মান নিম্ন মুখী হওয়ার কারণে আগামী দিন গুলোতে কেউ তাদের সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে পড়াতে চাইবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে। তাই ভাবছি আগামী একশো বছর পর কি হবে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার ভবিষ্যত? শুধু অতীতমুখি স্মৃতি চারন প্রভাতফেরি নাটক নাচ গান বিদগ্ধ আলোচনার মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ থাকবে আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা? নিজেদের সন্তান নাতিপুতিদের ইংরেজি মাধ্যমে লেখা পড়া করিয়ে বিদেশি সাহেব বানিয়ে শুধু ফেব্রুয়ারী মাসে কুম্ভীরাস্রু বিসর্জন করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ?উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলন বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি কতটা হয়েছে? আমরা কি চীন জাপানের মত সর্ব বিষয়ে মাতৃভাষা প্রচলন করতে পেরেছি? আমাদের সরকার এবং নীতিনির্ধারক মহল এবং শিক্ষক সমাজ কে একবার ভেবে দেখার অনুরোধ করবো।
অনেক বিত্তশালী মানুষের ছোট ছেলে মেয়েরা এখন বাসায় ইংরেজি ভাষায় কথা বলে দেখে আমি অবাক হয়েছি!স্কুলে ইংরেজি বলছে এখন তারা বাসায় ও ইংরেজি বলছে। তাই ভাবছি আামদের আগামী প্রজন্ম কি বাংলায় মা বলে ডাকবে নাকি ইংরেজি Mummy বলে ডাকবে? আর বাবা কে Daddy বা সংক্ষিপ্ত আকারে Dad বলে ডাকবে?
আমার বড় নাতি জন্মের পর চার বছর বাংলাদেশে ছিল। তাই সে মাকে মা আর বাবা কে বাবা সম্বোধন করে। নাতনীটার জন্ম কানাডায়। কিন্তু সে বড়জন কে অনুসরণ না করে ইংলিশ কালচারে ঢুকে গেল কেমন করে আমার মাথায় আসে না। সে Mummy Daddy তে অব্যস্হ হয়ে গেছে। অথচ সে এখনো স্কুলে ও যায়নি। শুধু মাত্র টিভি অনুষ্ঠান দেখেই ইংরেজ বনে যাচ্ছে। তবুও তারা চেষ্টা করে বাংলায় কথা বলতে যদিও সেটা বিকৃত ভাবে।এটা সকল প্রবাসীর ছেলে মেয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এছাড়া তাদের কোন উপায় ও নেই। খুব কষ্ট হয় যখন ভাবি তারা বাংলা গান শুনবে না তারা রবীন্দ্র সংগীত বা নজরুল সংগীত শুনবে না বা বুঝবে না।জানতে পারবে না জারী সারি ভাটিয়ালি গান কি? তারা জানবে কি আমাদের ভাষা সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে? তারা কি জানবে আমাদের ভষা আন্দোলন বা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস?
একদিন হয়তো তারাও রুটস বই এর লেখক আলেক্সহ্যালির মতো পূর্ব পুরুষ কিন্টেকুন্টে কে খুঁজতে বাংলাদেশে আসবে আর বিস্ফারিত নয়নে বলবে wow! what a beautiful country!

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.