--- বিজ্ঞাপন ---

নাজিমুদ্দিনের কল্লা চাই, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা কর নয়তো নাজিম গদি ছাড়!

আ মরি বাংলা ভাষা! পর্ব - ৩

0

কাজী ফেরদৌস, অতিথি লেখক #

১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সে যে একবার উচ্চারণ করে ছিলেন Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan এর বিরুদ্ধে নো নো প্রতিবাদ শুনে তিনি জীবনের বাকি সময় এনিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেছিলেন বলে শুনা যায় নি।আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন পর্যন্ত তেমন আর রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে উত্তেজনা ও দেখা যায় নি।ইতিমধ্যে জিন্নাহ মৃত্যু বরণ করেন মাত্র পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরের মাথায়। জিন্নাহর মৃত্যুর পর ক্ষমতা নিয়ে শুরু হয় কামড়াকামড়ি। জিন্নাহর লাশটি নাকি করাচি বিমান বন্দরে পরে ছিল অযত্নে অবহেলায়। তখন লিয়াকত আলী খান ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি জিন্নাহর আস্থাভাজন ছিলেন বলে জানা যায়। তবে জিন্নাহ তাঁর কর্মদক্ষতা ও বিচক্ষণতা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না।তাঁকে নাকি একজন মিডিওকার বলে তিরস্কার করতেন প্রায় সময় ।জিন্নার জীবনীকার বৃটিশ লেখক স্ট্যানলি ওলপার্ট এর লেখা Jinnah of Pakistan বইতে বলেছেন লিয়াকত আলী খান জিন্নাহর অধীনে কাজ করতে গিয়ে প্রায় অস্বস্তিতে ভোগতেন প্রায় ।তিনি নিজেকে একজন আজ্ঞাবহ ছাড়া কিছু ভাবতে পারতেন না। জিন্নাহর মৃত্যু তে লিয়াকত আলী খান যেন অনেক টা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তবে জিন্নাহর আকস্মিক মৃত্যু শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানের অস্তিত্ব কে প্রায় হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল।কারণ তাঁর অবর্তমানে দক্ষতার সাথে হাল ধরার মতো তখন কেউ ছিল না।জর্জ বার্নার্ড স এক চিঠিতে তখন নেহেরু কে বলে ছিলেন ” এখন পুরো উপমহাদেশের দায়িত্ব তোমার উপর এসে পড়বে তোমার প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ “।বার্নার্ড স এর এরকম ভাবাটা অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ টলটলায়মান পাকিস্তান টিকে থাকার ব্যাপারে তখনও অনেক পশ্চিমা পণ্ডিত ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সন্দেহ পোষণ করতেন।
লিয়াকত আলী খান এর গ্রহণ যোগ্যতা ছিল জিন্নাহর পরে। তিনি মিডওকার হলেও দক্ষতার সাথে হাল ধরে ছিলেন।কিন্তু নেপত্যে তখন শুরু হয়ে গিয়েছিল ষড়যন্ত্র। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপর দিকে সোভিয়েত রাশিয়া দুর্বল রাষ্ট্র পাকিস্তানের উপর চেপে বসতে চাচ্ছিল।তারা তাদের প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নেমে পরে।
লিয়াকত আলী খান ছিলেন উত্তর প্রদেশের মানুষ এবং উর্দুভাষী। তিনি পাকিস্তানে এসে অনেক টা রাজনৈতিক destitute এ পরিনত হয়েছিলেন।তাঁর নিজস্ব কোন নির্বাচনী এলাকা ছিল না। তাঁকে পুর্ব বাংলার একটা শুন্য আসন থেকে নির্বাচিত করে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সোভিয়ত ইউনিয়ন পন্থী এক সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা হয়।পাকিস্তানের সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা চীফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আকবর খান সহ সিনিয়র পনের জন কর্মকর্তা ও কিছু বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী এর সাথে জড়িত ছিলেন।প্রখ্যাত বামপন্থী কবি ও লেখক ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও জড়িত ছিলেন এর সাথে যাদের বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হয়েছিল। তবে সামরিক অভ্যুত্থান থেকে বেঁচে গেলে ও ষড়যন্ত্র তাঁর পিছু ছাড়েনি। একই বছর অক্টোবর মাসে রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি। জিন্নাহর মৃত্যুর পর শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য এটা ছিল সবচেয়ে বড় ধাক্কা এবং কঠিন সময়। লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর পর শুরু হয়ে যায় ক্ষমতা দখলের খেলা। তখন ঢাকার খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। তাঁর খায়েস হলো তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। অতএব, তিনি পাঞ্জাবি আইসিএস অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কে গভর্নরজেনারেল পদে বসিয়ে নিজে হয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী।
নাজিমুদ্দিন ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান। তাঁদের পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু। সুতরাং সঙ্গত কারণেই তাদের মধ্যে উর্দু প্রীতি থাকার কথা।অপর দিকে উত্তর প্রদেশের লিয়াকত আলী খান ও ছিলেন উর্দু ভাষী। পাকিস্তানের আর এক বড় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত এক উর্দুভাষী পরিবারের সন্তান। লেয়াকত আলী খানের মতো তিনি ও কোলকতা ছেড়ে এসে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পলিটিকাল ডেসটিটিউটে পরিনত হন।তবে তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন। নিজে উর্দুভাষী হয়েও পূর্ব বঙ্গের মানুষের সাথে একাত্ম হবার চেষ্টা করেছিলেন রাজনৈতিক পুনর্বাসন এর প্রয়োজনে।তিনি তরুণ শেখ মুজিব সহ পূর্ব বঙ্গর একদল তরুণ জনগোষ্ঠী কে দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।অপর পক্ষে নাজিমুদ্দিন ঢাকার মানুষ হয়ে ও গণমানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। তিনি চিরাচরিত কায়েমি স্বার্থের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন।তাঁর মাতৃভাষা ছিল উর্দু। এবং প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি অনেক টা নিস্প্রভ হয়ে যাওয়া ভাষার বিতর্কে নুতন করে উসকে দিলেন এবং বললেন জিন্নাহ সঠিক বলেছিলেন – উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। শুরু হয়ে গেল নুতন রূপে নুতন আঙ্গিকে ভাষা আন্দোলন। আওয়াজ উঠলো – রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই,
নাজিমুদ্দিনের কল্লা চাই,
রাষ্ট্র ভাষা বাংলা কর নয়তো
নাজিম গদি ছাড়!
আমরা তখন একেবারে শিশু। তবুও বড়দের মুখে শুনা শ্লোগান গুলো এখনো মনে আছে। আমরা ছোট ছোট শিশুরা দলবেঁধে এসব শ্লোগান দিয়ে মজা পেতাম।
সময় টা ছিল বিপদ সংকুল। প্রয়োজন ছিল ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে এবং দুরদর্শিতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলার।কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন বা তাঁর সহযোগীদের পরিস্থিতি মোকাবিলার সেই মেধা ও ধীশক্তির অভাব ছিল। তিনি যে বারুদের স্তুপের বসা ছিলেন সেই ধারণা হয়তো তাঁর ছিলই না।তিনি হাঁটলেন গোঁয়ারতুমির পথে, চিরাচরিত ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ভর করে। আলাপ আলোচনার ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধানের পথে না হেটে তিনি শক্তি প্রয়োগের পথে হাঁটলেন।ফলে অহেতুক রক্ত ঝড়লো যার অপেক্ষায় ছিলেন সুযোগ সন্ধানীরা।ছাত্রদের দাবি ছিল যথার্থ তারা উর্দুর সাথে সমান্তরালে বাংলা কে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি করে ছিলেন। এটা কি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতনা? কিন্তু রক্ত ক্ষরণ ও তিক্ততার মধ্যে দিয়েই শেষ হলো এই এপিসোড। ফল হলো নাজিমউদ্দীনের পতন। লাহোরে কাদিয়ানী বিরোধী দাঙ্গা ও বাংলায় ভাষা আন্দোলন যথাযথ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থতার অভিযোগে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তাঁকে বরখাস্ত করে আমেরিকায় নিযুক্ত রাস্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলী কে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করলেন। (চলবে)

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.