--- বিজ্ঞাপন ---

তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেল, আহত ৩৫ হাজার

উদ্ধার ভাই বোন

0

হঠাৎ করে তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তে কি হয়ে গেলো। কোন কিছু বুঝে উঠার আগে একের পর এক ভবন ধসে পড়তে লাগলো। মানুষের আহাজারী দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪ টা ১৭ মিনিটে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় তুরস্ক এবং সিরিয়ায়। কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৮। সবাই ঘুমিয়ে। সেই কম্পনে যে ধ্বংসলীলা চলেছে তাতে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেল। আহতের সংখ্যা ৩৫ হাজারেরও বেশি। ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা থেকে বেঁচে গিয়েও নতুন উপদ্রবের মুখে সে দেশে মানুষ। কোথাও তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে ৩ ডিগ্রিতে, কোথাও হিমাঙ্কের নীচে পৌঁছেছে তাপমাত্রা। তার সঙ্গে চলছে তুষারপাত আর বৃষ্টি। ফলে ভূমিকম্পের হাত থেকে বেঁচে গিয়েও স্বস্তিতে নেই তুরস্কের মানুষ। হাড় জমানো ঠান্ডায় মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও জুটছে না। ফলে বাধ্য হয়েই খোলা আকাশের নীচে কাটাতে হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ সকলকে।
প্রবল ঠান্ডা আর বৃষ্টির মধ্যে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে বলেও তুরস্ক প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। বহু এলাকায় রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় উদ্ধারকারীরা পৌঁছতে পারছেন না। পৌঁছচ্ছে না ত্রাণও। ফলে এলাকায় এলাকায় ক্ষোভ বাড়ছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভূমিকম্পে বেঁচে গিয়েও প্রাণ সংশয় তৈরি হচ্ছে। হাড় জমানো ঠান্ডা আর খিদের জ্বালায় অনেকেই মৃত্যুমুখে যেতে বসছেন। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, চরম ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে যাঁরা দিন কাটাচ্ছেন, হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমে যাবে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

তুরস্কের এমনই একটি শহর আন্তাকিয়ার বাসিন্দা বছর চৌষট্টির বৃদ্ধা মেলক বলেন, “শহরে উদ্ধারকারীদের দেখা নেই। কোনও শিবির তৈরি করা হয়নি যেখানে গিয়ে আশ্রয় নেব। খাবার, জল কিছুই পাচ্ছি না।” তাঁর কথায়, “ভূমিকম্প থেকে তো বেঁচে গিয়েছি বরাতজোরে। কিন্তু এখন ঠান্ডা আর খিদের জ্বালায় মারা যাব।”

বহু জায়গায় উদ্ধারকাজ না হওয়ায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বুধবার দক্ষিণ তুরস্কের কম্পনবিধ্বস্ত এলাকাগুলিকে সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট তায়িপ এর্দোয়ান। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, ভূমিকম্পে বেঁচে ফেরা নাগরিকদের জন্য অস্থায়ী শিবিরের আয়োজন করা হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সীমান্তলাগোয়া এলাকাগুলির। কাহরামানমারাস শহরের বাসিন্দা আলি সাগিরোগলু বলেন, “ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে রয়েছে আমার ভাই, ভাইপো। ওঁদের কী ভাবে বাঁচাব! কোনও উদ্ধারকারী নেই। প্রশাসনের কোনও লোক নেই। কোথায় যাব, কী করব।”

আমেরিকা, চিন এবং উপসাগরীয় দেশগুলি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ৭০টি দেশ ত্রাণ এবং উদ্ধারকারী দল পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভারত ইতিমধ্যেই তুরস্ককে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য ৪৫ সদস্যের একটি মেডিক্যাল দল পাঠানো হয়েছে সেখানে। একের পর এক ভূমিকম্প এবং আফটার শকে বিধ্বস্ত সিরিয়া এবং তুরস্ক। দুই দেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মাত্রাছাড়া। মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সিরিয়ার ধ্বংসস্তূপের একটি ভিডিয়ো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সমাজমাধ্যমে।

উদ্ধার দু’ভাই বোন

ছোট্ট দুই ভাইবোনের বাঁচার অসহায় আর্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষকে নাড়া দিয়েছে বেশি। তাদের মাথার উপরেই ভেঙে পড়েছে বাড়ি। ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে আশ্রয় নিয়ে কোনও রকমে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে দু’জন। মেয়েটির বয়স মাত্র ৭ বছর। আর তার পাশেই দেখা গিয়েছে তার ছোট্ট ভাইকে। ভাইয়ের মাথা নিজের হাতে আগলে রেখেছে বোন।
সংবাদ সংস্থা সিএনএন সূত্রে খবর, নিজেদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপে প্রায় ৩০ ঘণ্টা আটকে ছিল ভাইবোন। অবশেষে উদ্ধারকারী দল পাথর সরিয়ে তাদের বার করে আনতে পেরেছে। ভিডিয়োতে যে মেয়েটিকে দেখা গিয়েছে তার নাম মারিয়ম। ছোট ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে ধুলোবালি যাতে ভাইয়ের চোখেমুখে না ঢোকে, নিজের ছোট্ট হাত দিয়ে সেই চেষ্টাই সে করছিল। ভিডিয়োটিতে তাদের বিছানার উপরে শুয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। বাড়ি ভেঙে পড়ার সময় ভাইবোন বিছানায় শুয়ে ছিল বলে মনে করছেন অনেকে।
দুই শিশুকেই উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে। তুরস্ক এবং সিরিয়ায় উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে আবহাওয়া। কনকনে ঠান্ডায় বাধা পাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। তবে আবহাওয়াকে তুচ্ছ করেই প্রতিটি ভেঙে পড়া বাড়ির নীচে প্রাণের সন্ধানে তাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিপর্যয়ের পরে যাঁরা বেঁচে আছেন, ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বার করে আনা হচ্ছে তাঁদের।

কি এই আফটারশক

প্রথম কম্পনের পর ১০০ বারেরও বেশি কেঁপেছে তুরস্ক। যেটাকে ‘আফটারশক’ বলা হয়। রিখটার স্কেলে প্রথম বার কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৮। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, সাধারণত কোনও বড় কম্পনের পর আরও বেশ কয়েক বার কম্পন হতে পারে। যে কম্পন অনেক সময় মূল কম্পনের তীব্রতা থেকেও বেশি হতে পারে।
তুরস্কে প্রথম কম্পনের কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একশোরও বেশি আফটারশক হয়েছে। আমেরিকার ভূসর্বেক্ষণ বিভাগের মতে, প্রথম বার কম্পনের পর ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে এই অঞ্চলে একশোরও বেশি কম্পন হয়েছে। প্রথম কম্পনের ১১ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় কম্পন হয়। যার তীব্রতা ছিল ৬.৭। প্রথম কম্পনের ৯ ঘণ্টার মধ্যে তৃতীয় কম্পন হয়। যার তীব্রতা ছিল ৭.৫। তার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে চতুর্থ কম্পন হয়। যার তীব্রতা ছিল ৫.৯। এর পর একাধিক বার কেঁপেছে তুরস্কের মাটি। যার মধ্যে ৩০টি আফটারশকের তীব্রতা ছিল ৪-এর বেশি।

ভূবিজ্ঞানীদের মতে, কোনও বড় ভূমিকম্পের পর যে সব আফটারশক হয় সেগুলির স্থায়িত্ব কয়েক ঘণ্টা, এমনকি কয়েক দিনও হতে পারে। এই আফটারশক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তুরস্কে ৭.৫ তীব্রতার যে আফটারশক হয়েছিল তার গভীরতা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিমি গভীরে ছিল। যেখানে মূল ভূকম্পের উৎসস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭.৯ কিলোমিটার গভীরে। ভূবিজ্ঞানীরা আরও জানাচ্ছেন, ‘মেনশক’ বা মূল কম্পনের পর আসে ‘আফটারশক’। একই জায়গায় একাধিক বার আফটারশক হয়। প্রকৃতি সব সময় সমতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। ভূকম্পনের ফলে সেই ভারসাম্য প্রভাবিত হয়। তাই মূল কম্পনের পর টেকটনিক প্লেটগুলি যখন আবার নিজের অবস্থানে ফিরে আসার চেষ্টা করে তখনই আফটারশকের সৃষ্টি হয়।আফটারশকের কথা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু ‘ফোরশক’ও রয়েছে। কী এই ফোরশক? কোনও জায়গায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আগে এই ফোরশক আসে। তবে বড় ভূমিকম্প না আসা পর্যন্ত এই ফোরশককে চিহ্নিত করা যায় না।
ভূবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, তুরস্কের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে, এখানে ভূমিকম্প হওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। তবে সাম্প্রতিক অতীতে এমন ভয়াবহ তীব্রতার ভূমিকম্পের কোনও রেকর্ড নেই কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী এই দেশে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বার বার ভূমিকম্পের শিকার হতে হয় তুরস্ককে। তাঁদের মতে, তুরস্কের বেশির ভাগ অংশই অ্যানাটোলীয় প্লেটের উপর রয়েছে। এই প্লেটের দু’টি বড় চ্যুতি রেখা (মেজর ফল্ট লাইন) রয়েছে। যার মধ্যে উত্তর অ্যানাটোলীয় চ্যুতি রেখাটি দেশের পশ্চিম ভাগ থেকে পূর্ব ভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যটি হল, পূর্ব অ্যানাটোলীয় চ্যুতি। যেটি তুরস্কের পূর্ব ভাগে রয়েছে।

তুরস্কের ভূমিকম্পে এখনও পর্যন্ত ৮ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা কত সে বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারেনি প্রশাসন। এখনও বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নীচে আটকে রয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছে প্রশাসন।## সূত্রঃ আনন্দবাজার

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.