--- বিজ্ঞাপন ---

‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এখন বিশ্বের ব্র্যান্ড

0

কাজী আবুল মনসুর/সিরাজুর রহমান#

বিগত চার দশক থেকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প (রেডি মেড গার্মেন্টস) খাত সার্বিক রপ্তানি আয়ে অতি দ্রুত বড় ধরণের অবদান রাখতে শুরু করে। মূলত গত ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮১.৮২% আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। আর অন্যান্য সকল খাত মিলিয়ে মাত্র ১৮.১৮% অবদান রয়েছে জাতীয় রপ্তানি আয়ে। যা আমাদের দেশের একটি শতভাগ রপ্তানি খাত নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এ সেক্টরে কাজ করছে প্রায় ২৫ লক্ষ নারীসহ প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের (জুলাই/২০২২ থেকে মার্চ/২০২৩ পর্যন্ত) প্রথম ৯ মাসে মোট ৩৫.২৫৩ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে সারাবিশ্বে।

এক সময় অতি সম্ভাবনাময় ঔষধ শিল্প খাত থেকে বড় ধরণের রপ্তানি আয় করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হলেও বাস্তবে তা কিন্তু আজ অব্ধি ১ বিলিয়ন ডলারের সীমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ঔষধ রপ্তানি খাত থেকে মাত্র ১৮৯ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। তবে বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি হোম টেক্সটাইল খাত ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে শুরু করেছে। তবে আশির দশক পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয়ের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পাট ও পাটজাত শিল্প পন্য থেকে আসলেও ধীরে ধীরে এ খাতকে পেছনে ফেলে সবার উপরে উঠে আসে মেইড ইন বাংলাদেশ খ্যাত তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত।

আশা করা হচ্ছে, আগামী ৫ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে ৪৮ বিলিয়ন ডলার এবং হোম টেক্সটাইল খাত থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। এ জন্য আমাদের অবশ্যই আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারের পাশাপাশি নতুন নতুন সম্ভাবনাময় বৈদেশিক রপ্তানির বাজার সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো হতে পারে আমাদের তৈরি পোশাকের আকর্ষণীয় রপ্তানির ক্ষেত্র। বর্তমানে বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই অবস্থান করছে বাংলাদেশের। সারা বিশ্বে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাতি এনে দিয়েছে অতি সম্ভাবনাময় রপ্তানিমুখী ‘রেডি মেড গার্মেন্টস’ শিল্প। বর্তমানে শ্রমঘন এই রপ্তানিমুখী শিল্পটি দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

যদিও একেবারে শুরুতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প গড়ে তোলাটা ছিল বেশ কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। আসলে বাংলাদেশ প্রথম তৈরি পোশাক রপ্তানি করে ১৯৭৮ সালে ‘রিয়াজ গার্মেন্টসে’র হাত ধরে। বাংলাদেশের এক সফল উদ্যোক্তা রিয়াজ উদ্দিন তার প্রতিষ্ঠিত ‘রিয়াজ গার্মেন্টস’ ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথম ফ্রান্সে ১০ হাজার পিস শার্ট রপ্তানি করে নতুন এক ইতিহাসের সূচনা করেন মাত্র। যার পরে ধারাবাহিকভাবে আস্তে আস্তে ইতিবাচকভাবে বিকশিত হতে শুরু করে আমাদের রপ্তানীমুখী তৈরি পোশাক শিল্প। যদিও ১৯৬৩ সালে পুরোনো ঢাকার উর্দূ রোডে রিয়াজ ষ্টোর নামে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম ‘রিয়াজ গার্মেন্টস’। ১৯৬৫ সালে রিয়াজ ষ্টোর এর মালিক জনাব রিয়াজ উদ্দিন করাচি ভ্রমণকালে একটি গার্মেন্টসকে মাসে ১ লক্ষ পিস পোশাক রপ্তানী করতে দেখে নিজেও বিদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির স্বপ্ন মনে মনে লালন করতে থাকেন।

পোশাক তৈরির শুরুতে তাঁরা শুধু দেশের চাহিদাই পুরণ করত। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর রিয়াজ উদ্দিন ১৯৭৩ সালে ‘রিয়াজ ষ্টোর’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘রিয়াজ গার্মেন্টস’ রাখেন। তার পাশাপাশি বিদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেন তিনি। অবশেষে ১৯৭৮ সালের ২৫শে জুলাই টিসিবির সহায়তায় রিয়াজ গার্মেন্টসে’র হাত দিয়ে সর্বপ্রথম ফ্রান্সে ১০ হাজার শার্ট রপ্তানি করে বাংলাদেশ। যার রপ্তানি মূল্য ছিল কিনা ৪ লক্ষ টাকা।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ‘রিয়াজ গার্মেন্টস’ প্রথম পোশাক রপ্তানি করলেও শতভাগ রপ্তানিমুখী রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্প হিসেবে ‘দেশ গার্মেন্টস’ আত্মপ্রকাশ ১৯৮০ সালে। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক বা বস্ত্র শিল্পের আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল কাদের। তিনি প্রথম ১৯৭৭ সালের ২৭ই ডিসেম্বর দক্ষিন কোরিয়ার দাইয়ু গ্রুপের সাথে যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশের প্রথম শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘দেশ গার্মেন্টস’।

তার প্রতিষ্ঠিত ‘দেশ গার্মেন্টস’ রপ্তানিযোগ্য তৈরি পোশাক উৎপাদন শুরু করে ১৯৮০ সালে। তার পর থেকেই শুরু হয় তৈরি পোশাক রপ্তানির আদম্য অগ্রযাত্রা। আর শুরুর দিকে ‘রিয়াজ গার্মেন্টস’ এবং ‘দেশ গার্মেন্টসে’র মতো কিছু প্রতিষ্ঠানের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিশ্বের বুকে তৈরি পোশাক রপ্তানির অতি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। যদিও চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেশের প্রধান শতভাগ রপ্তানিমুখী ‘রেডি মেড গার্মেন্টস’ বেশ চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তবে দেশের এই খাত সকল প্রতিকূলতা ও সমস্যার মোকাবেলা করে এবং তার পাশাপাশি সরকারের আর্থিক সহায়তা ও সহযোগিতায় বিশ্ব বাজারে বড় ধরণের চমক সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যায়।##

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.