বিশেষ প্রতিনিধি ##
ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোকে বলা হয় বাংলাদেশের পরবর্তি দরজা। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের মধ্যে অন্যতম মনিপুরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে একদল বিচ্ছিন্নতাবাদি। লন্ডনে বসে সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন মহারাজা লেইশেমবা। লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলন করে প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়াহয়।
মনিপুর এখন অশান্ত। রাস্তায় রাস্তায় ছাত্র – জনতার বিক্ষোভ। মনিপুর স্টেট কাউন্সিলের স্ব-ঘোষিত পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী নারেংবাম সমরজিত বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, মনিপুরের স্বাধীনতা ঘোষণার এটাই সঠিক সময়। জাতিসংঘের প্রতিটি সার্বভৌম সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, এ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার। মোদি সরকার হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় ক্ষুদ্র নৃ-তাত্তি¡ক গোষ্ঠীর সঙ্গে অসহিষ্ণু আচরণ করছে। মনিপুরে গত ১০ বছরে অন্যায়ভাবে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আটক হয়েছেন, দেড় হাজারের বেশি।’
ভারতে মোট রাজ্যের সংখ্যা ২৮ টি। এর মধ্যে ৮টি প্রদেশ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলো হলো সিকিম, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, অরুণাচল এবং নাগাল্যান্ড। সিকিম বাদে বাকি সাতটি প্রদেশ সম্মিলিতভাবে সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত। ভৌগোলিকভাবে সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখন্ড বা রাজধানী থেকে অনেক দূরে। নৃতাত্তি¡ক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই অঞ্চলগুলির সাথে মিয়ানমারের অনেক মিল রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে মিল রয়েছে বাংলাদেশের সাথেও।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সাথে দেশের অবশিষ্ট অঞ্চলের সংযোগ রক্ষাকারী একটি সংকীর্ণ ভূখন্ড ‘চিকেনস নেক’ হিসেবে পরিচিত। এ চিকেন নেক’কে কেন্দ্র করে ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর কথা বার বার শিরোনাম হচ্ছে। বাংলাদেশে আওযামী লীগ সরকারের পতনের পর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো। কারণ আশঙ্কা করা হচ্ছে এ রাজ্যগুলো নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে। এরই মধ্যে মণিপুর এ শুরু হয়েছে আন্দোলন। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে মানুষ। মণিপুর ভারতের সাথে থাকতে চাইছে না। অশান্তি দেখা দিয়েছে অরুণাচল নিয়ে। বলা হচ্ছে, অরুণাচলের ৬০ কিলোমিটার এরই মধ্যে দখলে নিয়েছে চীন। স্থাপন করেছে ঘাঁটি। এরই মধ্যে ঘুম হারাম হয়ে গেছে নয়াদিল্লীর। হিসেব নিকেশে ব্যস্ত মোদি সরকার।
এরই মধ্যে সর্বশেষ খবর এসছে, জঙ্গলযুদ্ধ এবং ড্রোন হামলায় প্রশিক্ষিত ৯০০ কুকি জঙ্গি মায়ানমার থেকে ঢুকেছে মণিপুরে। শনিবার প্রকাশ্যে এমনই দাবি করলেন রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা কুলদীপ সিংহ। গোয়েন্দা সূত্রে এমনই খবর পাওয়া গিয়েছে বলে তাঁর দাবি। আর এই রিপোর্টকে হালকা ভাবে নেওয়া উচিত হবে না বলেই সতর্কবার্তা দিয়েছেন কুলদীপ।
সূত্রের খবর, প্রশিক্ষিত এই সব জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ নিয়ে গোয়েন্দাদের রিপোর্ট রাজ্যের সমস্ত জেলার পুলিশ সুপারের কাছে ইতিমধ্যেই পাঠিয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ওই সূত্রটি আরও জানিয়েছে, বৃহস্পতিবারই রাজ্যের কাছে গোয়েন্দাদের রিপোর্ট এসেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রে প্রশিক্ষিত, ড্রোন থেকে বোমা হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট এবং জঙ্গলযুদ্ধে দক্ষ ৯০০ কুকি জঙ্গি প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার থেকে রাজ্যে প্রবেশ করেছে।
মূলত বৃটিশরা ভারত ছেড়ে যাবার আগে ভারতের বৃহৎ ভূ-খন্ডকে এমনভাবে ভাগ করে যান যাতে জিইয়ে থাকে দ্বন্দ্ব, সংঘাত। ৭৭ বছর আগে সিরিল রেডক্লিফ নামের একজন ব্রিটিশ আইনজীবীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বৃটিশ শাসিত ভারতকে ভাগ করার। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা ঠিক করার জন্য। কাগজে কলমে বৃটিশ শাসিত ভারতকে ভাগ করতে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছিলো তাকে। পরে দেখা যায়, তিনি ভারত ও পাকিস্তানের জন্য এমন সীমানা করে যান যার ফলে এখনও উপমহাদেশে নানা উত্তেজনা লেগে আছে। ভারত এবং বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) নিয়ে ‘শিলিগুড়ি’ এখন মহা ঝামেলার নাম। এখানে ‘সিরিল রেডক্লিফ’ মহানন্দা নদী যেখানে বাংলাবান্ধা পার করেছে সেখান থেকে নদীর এপার ভারত এবং ওপার বাংলাদেশ হিসেবে ভাগ করে যান। শেষপর্যন্ত অবস্থা দাড়ালো শিলিগুড়ির একপাশে নেপাল, অন্যপাশে বাংলাদেশ। এ দু’দেশের চিপায় উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে সমগ্র ভারতের ভূ- যোগাযোগের খুবই পাতলা সরু করিডোর তৈরি হয়েছে। ম্যাপে একটু কল্পনা করলেই মনে হয় এটি একটি চিকেন নেক বা মুরগির গলা। যেটি আজ শিলিগুড়ি চিকেন নেক করিডর হিসাবে পরিচিত। মূলতঃ যে কোনো দেশ এই স্থানটি দখল করলেই এ রাজ্যগুলো ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ভারতের মূল ভূ-খন্ডের সাথে উত্তর পূর্ব ভারতের যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। রাজ্যগুলোতে অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ক্ষতি নেমে আসবে। যার ফলে ভারতের কাছে এই করিডোরের গুরুত্ব অপরিসীম। চিকেন নেক ভারতকে সেভেন সিস্টারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ভবিষ্যতে কখনো চিন বা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ হলে চিকেন নেক দখল নিয়ে নিলে সেভেন সিস্টার আলাদা হয়ে যাবে।
চিকেন নেক দিয়ে বাংলাদেশের কাছেই ভারত, ভুটান,নেপাল। এমনকি অরুনাচল দিয়ে চীনও বাংলাদেশের কাছে। কিন্ত ভারত কোনক্রমেই বাংলাদেশকে এই করিডোর ব্যবহার করতে দেয় না। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ-ভারত ফুলবাড়ী চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। যার ফলে ভারতের এই ছোট করিডোর রুট দিয়ে বাংলাদেশ-নেপাল পণ্য পরিবহন ও বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে চুক্তির বাস্তবায়ন হয় না। রয়ে গেছে কাগজে কলমে।
বাংলাদেশের পরবর্তি দরজা বলে পরিচিত ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যের অন্যতম অরুনাচল। প্রায় ৮৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের এ রাজ্যের প্রধান প্রধান উৎপাদিত ফসল হচ্ছে ধান, ভূট্টা, গম, সরিষা, চিনি ও ডাল। ফলের মধ্যে রয়েছে, আনারস, আপেল, কমলা, আঙ্গুর। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে,কয়লা, চুন, পেট্রোলিয়াম পণ্য, পাথর। আসামের আয়তন প্রায় ৭৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার। প্রধান প্রধান উৎপাদিত ফসলের মধ্যে রয়েছে,ভূট্টা, পাট, চিনি, তুলা। চা, রাবার কফির বনায়ন। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কয়লা, চুন, পেট্রোলিয়াম পণ্য, লোহা, বিভিন্ন পাথর। মনিপুরের আয়তন প্রায় ২৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার। প্রধান উৎপাদিত ফসল হচ্ছে, ভূট্টা, তেল, বিভিন্ন বীজ, সরিষা,ধান, চিনি, গম। প্রাকৃতিক সম্পদেও মধ্যে রয়েছে চুনাপাথর ও ক্রোমেট। মেঘালয়ার আয়তন প্রায় ২৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রধান শস্য হচ্ছে ভূট্টা, ধান ও পাট। আছে রাবার ও কফির বনায়ন। প্রাকৃতিক সম্পদেও মধ্যে রয়েছে,কয়লা, কাচঁ, চিনামাটি, আকরিক। মিজোরামের আয়তন প্রায় ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রধান শস্য হচ্ছে ধান ও ভূট্টা। রয়েছে রাবার, চা ও কফির বনায়ন। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়লা, চুনাপাথর এবং গ্যাস। নাগাল্যান্ডের আয়তন ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানেও রয়েছে ধান, ভুট্টা, পাট, চিনি, কলা, আনারস, আদা, হলুদসহ বিভিন্ন পণ্যের সমাহার। রয়েছে চুনাপাথর, কয়লাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ। ত্রিপুরার মধ্যেও রয়েছে ধান, চিনি, কলা, কমলাসহ নানান প্রাকৃতিক সম্পদ।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানার পরিমাণ প্রায় ৪০৯৬ কিলোমিটার। এ সীমারেখার মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় চার রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানার পরিমাণ ১৮৮০ কিলোমিটার। রাজ্যগুলো হল- আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজুরাম। উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর আন্তর্জাতিক সীমারেখার ৩৭ ভাগই বাংলাদেশের সঙ্গে। আসামের সঙ্গে ২৬৩ কিলোমিটার, মেঘালয়ের সঙ্গে ৪৪৩ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সঙ্গে ৮৫৬ কিলোমিটার এবং মিজুরামের সঙ্গে ৩১৮ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ সীমানা থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশের সঙ্গে এসব রাজ্যের সম্পর্কের উন্নতি আশানুরূপ হয়নি। চট্টগ্রাম চেম্বার সূত্র জানায়, এসব রাজ্যের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট যে ৩৩টি সীমানা পথ বা স্থলবন্দরের মধ্যে ১৭টি চালু রয়েছে, বাকী ১৬টি নিষ্ক্রিয়। মেঘালয় সীমানার মধ্যে ১১টি স্থলবন্দরের মধ্যে ৮টি সক্রিয়। এগুলো হল- দাউকি-তামাবিল, ভোলাগঞ্জ-ছাতক, বোরসোরা-চেরারগঞ্জ, সেল¬াবাজার-ছাতক, বাঘমারা-বিজয়পুর, ডলু-নাকুগন, গাছুয়াপাড়া-করইতলি, মেহেন্দ্রগঞ্জ-ধনুয়া। ত্রিপুরা সীমানার ৮টি স্থল বন্দরের মধ্যে ৫টি সক্রিয়। এগুলো হল- আগরতলা-আখাউড়া, শ্রীমন্তপুর-বিবির বাজার, রাগনাবাজার-বাথুলি, খোইয়াঘাট-বাল¬া, মনুঘাট-চাতলাপুর। আসামের সীমানার মধ্যে থাকা ১৩ স্থল বন্দরের মধ্যে ৪টি চালু রয়েছে। এগুলো হল- করিমগঞ্জ- জকিগঞ্জ, সুতারকান্দি-শেউলা, মনকাচর-রৌমারি, গোলকগঞ্জ-বুরুঙ্গিমারি। মিজোরামের সীমানার সঙ্গে থাকা দেমাগ্রি স্থলবন্দরটি নিষ্ক্রিয় রয়েছে। স¤প্রতি বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধ থাকা অনেক স্থল বন্দর পুনরায় চালুর ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে। আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগ, সাবরুম-রামগড় ও দেমাগ্রি-তেগামুখ স্থল বন্দর পুরোদমে চালুর ব্যাপারে উভয় সরকারের মাঝে চুক্তি হয়েছে। তবে এখন দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারতের সাথে সুসম্পর্কের কারণে সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলো ও সীমান্ত চলাচল এক রকম ছিল। এখন অন্যরকম। শেখ হাসিনা ভারতে থাকার কারনে দু’দেশের মধ্যে চলছে নানা টানাপোড়েন। এর মধ্যে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ নিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিষয়ক মন্তব্যে অন্তবর্তি সরকার বিস্ময় প্রকাশ করেছে। ফলে বাংলাদেশকে যদি ভারত অশান্ত করতে চায় তাহলে ভারতেও যে শান্তি থাকবে না এ মন্তব্য খোদ বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের। এটা ঠিক যে সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলো যদি নিজেদের নিজেদের উন্নয়ন চায় তাহলে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশই তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারন বহির্ঃবিশে^র সাথে তাদের যোগাযোগের সহজ পথটি করে দিয়েছিলেন হাসিনা সরকার। দেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। এটি এখন আদৌ কার্যকর থাকবে কিনা এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের নতুন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক দু’দিন আগে ভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভি-কে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও মিয়ানমার, সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ – সর্বত্রই অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়বে।”
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের কয়েক দিনে বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদপত্র বা চ্যানেলকেও দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারেও তিনি মোটামুটি একই ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন, আর প্রতিবারই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বোঝাতে ব্যবহার ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলা হতো।
বিবিসি সূত্রে জানা গেছে, মিজোরামের দু’দুবারের মুখ্যমন্ত্রী, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সর্বোচ্চ নেতা জোরামথাঙ্গা বছর দুয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সাহায্য না-পেলে তাদের মিজো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কখনওই সাফল্যের মুখ দেখত না এবং মিজোরাম একটি পৃথক রাজ্য হিসেবেও হয়তো আত্মপ্রকাশ করতে পারত না। আসলে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) বিদ্রোহীরা ষাটের দশকের শেষে প্রায় তাদের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের ভূখন্ডে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) আশ্রয় পেয়েছিলেন, যা অব্যাহত ছিল প্রায় দীর্ঘ দু’দশক ধরে।
এমএনএফের প্রবাদপ্রতিম নেতা লালডেঙ্গা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আতিথেয়তায় ঢাকার লালমাটিয়া এলাকাতে একটি বাড়িতেই থাকতেন, আর ওই গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেক ভ্যালি ও তার আশেপাশের এলাকায়। তখনকার তরুণ জোরামথাঙ্গা ছিলেন সুপ্রিম কমান্ডার লালডেঙার বিশ্বস্ত অনুচর ও ছায়াসঙ্গী। ১৯৮৭ সালে ভারতে মিজো শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পৃথক মিজোরাম গঠনের পথ প্রশস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ও তার বহু সতীর্থ জীবনের বেশিটা সময় বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন। একই কথা খাটে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফা’র পরেশ বড়ুয়া, অনুপ চেতিয়া বা অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো সর্বোচ্চ নেতাদের অনেকের ক্ষেত্রেই। তাদের সশস্ত্র আন্দোলনের অনেকটা সময়ই তারা ছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে। ত্রিপুরার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এনএলএফটি কিংবা ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্সের (যার নেতা বিজয় কুমার রাংখল এখন একজন মূল ধারার রাজনীতিক) সদস্যরাও অনেকেই বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেয়েছেন, সেখান থেকেই পরিচালিত হত তাদের কর্মকান্ড।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন (১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-০৬) বাংলাদেশ সরকার অবশ্য কখনওই তাদের দেশের মাটিতে এই সব গোষ্ঠীগুলির অস্তিত্ব স্বীকার করেনি – আর এই ইস্যুটিও ঢাকা-দিল্লির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম তিক্ততার জন্ম দিয়েছিল। ২০০৯-এ শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় মেয়াদে এই দৃশ্যপটে একটা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।
জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে হাসিনা সরকার একের পর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে গোপনে বা প্রকাশ্যে ভারতের হাতে তুলে দিতে শুরু করে। বাংলাদেশের মাটিতে ওই সব গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরও একে একে বন্ধ হতে থাকে।
উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া অবশ্য তার আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু অনুপ চেতিয়া বা অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো গোষ্ঠীর অন্য নেতারা ততদিনে ভারতে ফিরে এসে সরকারের সঙ্গে ‘শান্তি আলোচনাও শুরু করে দিয়েছেন। কারণ মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরের বদলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সড়কপথে পণ্য পরিবহন করা ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য তুলনায় অনেক সহজ। ফলে এক কথায় বলতে গেলে ‘সেভেন সিস্টার্সে’র সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নেপথ্যে বিশেষ করে বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
এখন পরিস্থিতি কার্যত পাল্টে গেছে। মোদী সরকার ঠিকই বুঝতে পারছে বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছেতাই কান্ড করার দিন শেষ। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ভারতের সাথে সম্পর্ক ‘নায্যতা ও সমতা’র ভিত্তিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন। এখন সামনের দিনগুলোতে ভারতে আচরণই বলে দিবে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাড়াবে।##