১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট বাতিল নিয়ে গুজব, রটনা এখনও অব্যাহত

১৯৭৭ সালে ৫০০ টাকার নোট এবং ২০০৮ সালে ১০০০ টাকার নোট সরকার বাজারে ছাড়ে। এরই মধ্যে বড় আকারের এ নোট দুটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ বলছে বাতিল করা হোক। আবার কেউ বলছে বাতিল করলে দেশ জুড়ে সমস্যা দেখা দেবে। তবে শেষপর্যন্ত নোট দুটির বাতিলের বিষয়টি যে গুজব তা বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়ে দিল। তারপরও কথা থেকে যায়, সরকারের ভেতরে  ও বাইরে ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকা নোট নিয়ে যেভাবে কথা বাড়ছে তাতে সাধারন মানুষই আতঙ্কে আছে। দেশে চলমান দূর্নীতি বিরোধী অভিযান নতুন নয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। যেহেতু দলের ভেতরে দূর্নীতিকে লালন করে এক শ্রনির লোক রাজস্ব, আয়কর না দিয়ে  কোটি কোটি নগদ টাকা জমা করছে তখন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। আর এসব নগদ অর্থ দুটি নোটের মাঝে সীমাবদ্ধ তাহলো ৫০০ আর ১০০০ টাকা। এমতাবস্থায় কোনো কোনো মহল থেকে আওয়াজ উঠেছে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে নতুন টাকা ছাপালে দূর্নীতি কমবে। কারো কাছে এমন টাকা থাকলে সরকারি আইন ও নিয়মনীতি মেনে তা ব্যাংকে জমা দিয়ে নতুন টাকা নেবে। এতে সরকারের আয় যেমন বাড়বে তেমনি দেশে বিনিয়োগও বাড়বে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে  বলছে, সংবাদ মাধ্যমে ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট বাতিলের বিষয়ে কিছু বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা খবর ছাপানো হয়েছে। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে জনমনে ভীতি ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। যার ফলে দেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনার স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। বাংলাদেশ ব্যাংক জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে যে, ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমান নোট বাতিলের কোনো চিন্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কোনো নির্দেশনাও দেয়া হয়নি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে যে কোনো প্রকার নোট, মুদ্রা, কয়েন মুদ্রণ, ইস্যু কিংবা বাতিলের এখতিয়ার শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। বিধায় এ ধরনের মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করা বর্ণিত আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী এ ধরনের সংবাদ প্রচার-প্রচারণা না করতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

দেশের দৈনিক কালেরকন্ঠের একটি রির্পোটে উল্লেখ করা হয়, ‘সম্প্রতি দেশে ক্যাসিনো, জুয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের বাসা, অফিসে প্রশাসন অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ উদ্ধার করেছে। এতে আটক করা হয়েছে একাধিক ব্যক্তিকে। উদ্ধার হওয়া কোটি কোটি টাকা আয়ের কোনো উৎস বলতে পারছে না আটককৃত ব্যক্তিরা। কালোবাজারি, মাদক, জুয়া, ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এসব জমানো অর্থ। অবৈধভাবে আয়ের সব টাকাই বাড়িতে জমিয়ে রাখছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অভিযানে দেখা গেছে, উদ্ধার হওয়া অর্থের মধ্যে বেশির ভাগ ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। দেশের সবচেয়ে বড় মানের টাকা হলো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। জমাতে সুবিধা হওয়ায় তারা এই দুটি নোট পছন্দ করছে। ফলে ব্যাংক থেকে বের হওয়ার পর বাড়ির সিন্দুকে আটকে যাচ্ছে সব টাকা।

ভারত সরকার দেশের এই অবৈধ জমানো টাকা মূল স্রোতে বা বিনিয়োগে নিয়ে আসতে ২০১৬ সালের নভেম্বরে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে। নরেন্দ্র মোদি সরকার এই বিশাল সফলতা পায় সব অবৈধ আয় করা নগদ অর্থ বিনিয়োগে নিয়ে আসাতে। ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে লেনদেন অনেকাংশে দুই বড় মানের নোটের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে। এসব বড় নোট বাতিল করার ফলে রেকর্ডবিহীন ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেনের ক্ষেত্রে বড় সফলতা পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফলত ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে লেনদেনের বিস্তৃতি বেড়েছে। আর এতে আয়ের ওপর আরোপনীয় কর বিশেষ করে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর পরিশোধে বাধ্য হচ্ছে লেনদেনকারীরা। এর বাইরে বেআইনিভাবে প্রাপ্ত বা আয়কর ফাঁকি দিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে গৃহে রক্ষিত সম্পদ দুর্নীতি, ঘুষের অর্থ সাধারণত বড় নোট যথা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট করে রাখা হয়ে থাকে। ভারত সরকার বড় অঙ্কের টাকার নোট বাতিল করার পর এসব দুর্নীতিবাজের অবৈধ সঞ্চয় আহরণ ও রক্ষাকরণের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে।

বাংলাদেশে এসব নোট বাতিল করা হলে একই সুবিধা পাবে সরকার। অবশ্য এর আগে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রচলিত ৫০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করে। এই নোট সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা নিকটস্থ ডাকঘরে জমা দিয়ে নতুনভাবে মুদ্রিত নোট নেওয়ার জন্য তিন দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তন আমলে প্রচলিত ১০০ টাকার নোট বাতিল করে। ১০০ টাকার নোট যাতে দেশের অর্থব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে পারে এবং পাকিস্তান প্রত্যাগতরা বা পাকিস্তানপন্থীরা বাংলাদেশের সম্পদ পাকিস্তানে পাচার না করতে পারে সে জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এতে বাংলাদেশ সরকার সফলতা পেয়েছিল।

অন্যদিকে চলতি বছরে বাজেট ঘোষণায় বলা হয়, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনে অপ্রদর্শিত আয় থেকে বিনিয়োগ করা অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিলে ওই অর্থের উৎস সম্পর্কে আয়কর বিভাগ থেকে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে না। প্রস্তাবিত বাজেটে আবাসিক প্রয়োজনে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ সহজতর করা হয়েছে। নির্ধারিত হারে ট্যাক্স পরিশোধ করলে বিনিয়োগ করা টাকার উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে না সরকার। বর্তমানে প্রচলিত বাসাবাড়ি, অফিসে জমানো অর্থ বাতিল করা হলে সব টাকা বিনিয়োগে চলে আসবে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ টাকার কর আদায় করা যাবে। যারা নিজের বাড়ির সিন্দুকে টাকা রাখছে সেগুলো নির্দিষ্ট সময় দিয়ে সরকারি নিয়মনীতি মেনে ব্যাংকে জমা করার সুযোগ দিলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যানে ড. আব্দুল মজিদ বলেন, ‘অবৈধভাবে উপার্জন করেছে যারা, তাদের সব টাকা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট হয়ে বাসাবাড়িতে স্তূপ হয়েছে, সিন্দুকে রেখেছে। এসব অর্থ বিনিয়োগে আনতে বড় নোট বাতিল করা হবে দেশের অর্থনীতির একটি বড় অর্জন। নির্দিষ্ট সময় দিয়ে ঝটিকা ঘোষণার মাধ্যমে এসব নোট বাতিল করার সময় এসেছে। শুধু বাতিল অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা উচিত। ওই সময়ের মধ্যে জরিমানা-কর দিয়ে অর্থ ব্যাংক ব্যবস্থায় জমা করা না হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন ঘোষণা দিলে যারা বাসাবাড়িতে টাকা জমিয়েছে সব বের হয়ে যাবে। ২০০৮ সালে এমন একটি ঘোষণা দিয়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা বাড়তি কর আদায় করা হয়েছিল। ১০ শতাংশ বাড়তি কর হিসেবে এই টাকা আয় করা হয়েছিল। মূল অর্থ ছিল অনেক বেশি। আমাদের অর্থনীতি আরো বেশি গতিশীল হবে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে।’ জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম বলেন, সাধারণ মানুষ যাতে ভোগান্তির শিকার না হয় এমন পদ্ধতি মেনে বড় নোট বাতিল করা যায়। এভাবে যাদের কাছে বিপুল অর্থ সঞ্চিত আছে সেটা বিনিয়োগে নিয়ে আসতে হবে। তাদের খুঁজে বের করতে হবে ‘।

কিন্ত প্রশ্ন হলো ভারতের অর্থনীতি বিশাল। তাছাড়া ভারতে এ ঘটনার পর অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ভারতের টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে অনেকদিন ধরে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুই না। দেশে দরিদ্র মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। সাধারন মানুষ যা রোজগার করে তা থেকে নগদ টাকা সঞ্চয় করে জমায়। এ টাকা তাদের শেষসম্বল। যে ঘটনা ভারতের দরিদ্র মানুষের বেলায় ঘটেছে। অনেক দরিদ্র আত্মহত্যা করেছে ভারতে। নিজের টাকা চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখে। এ অবস্থায় প্রশ্ন বাংলাদেশ সরকার কি আদৌ এ ধরনের কোন পদক্ষেপ ভবিষ্যতে নেবে? ৫০০ টাকা আর ১০০০ টাকার নোট কি আদৌ বাতিল হবে। তবে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে এ ধরনের কোন উদ্যোগ সরকারের নেই। যেগুলো চলছে তার বেশিরভাগই রটনা।

 

 

Comments (০)
Add Comment