-- বিজ্ঞাপন ---

একটি দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কি বড় ফ্যাক্টর?

সিরাজুর রহমান,বিশেষ প্রতিনিধি#

একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে শুধু জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বিবেচনা করলে দেশটির প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কখনোই বাস্তব ধারণা পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের এবং উন্নয়নশীল পর্যায়ের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বৈদেশিক ঋণ ঠিক কোন পর্যায়ে রয়েছে তা কিন্তু গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

তাছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে বৈদেশিক (আমদানি রপ্তানি) বাণিজ্য ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকলে তাকে কোন অবস্থাতেই একটি টেকসই, শক্তিশালী এবং ইতিবাচক ধারার দেশ হিসেবে বিবেচনা করার কোন সুযোগ থাকে না। সারা বিশ্বে বর্তমানে আমেরিকার নিজস্ব মুদ্রা ডলারের গ্রহণ যোগ্যতা কিছুটা হ্রাস পেলেও বাস্তবে বিশ্বের সকল দেশই কিন্তু এখনো পর্যন্ত রিজার্ভের জন্য মূল কারেন্সি হিসেবে ডলারকেই বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, চলমান অস্থিরতার মধ্যেও ইতিবাচক রেমিটেন্স আয় বৃদ্ধি এবং সার্বিক আমদানি ব্যয় হ্রাস পাওয়ার কারণে দেশের গ্রস ফরেক্স রিজার্ভ এখনো পর্যন্ত ২০ বিলিয়ন ডলারের উপরেই রয়েছে। গত ২৪শে অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসারে, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ১৯.৮১ বিলিয়ন ডলার। যেখানে গত সেপ্টেম্বর মাস শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯.৮৬২ বিলিয়ন ডলার এবং গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৪.৮৬৩ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি ২০২৪ সালের ৭ই মার্চ এর হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে (বিপিএম-৬) ২১.১৫ বিলিয়ন ডলার দেখানো হয়েছিল। তবে ১৭ কোটি বিশাল জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমপক্ষে ৫৫ বিলিয়ন ডলার বা তারও অধিক থাকা উচিত বলে মনে করা হয়।

করোনা মহামারি চলাকালীন অবস্থায় ইতিবাচক রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে গত ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভব ৪৮ বিলিয়ন ডলারের সীমাকে স্পর্শ করে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। তবে আমরা কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা পরবর্তীতে আর বজায় রাখতে পারিনি। তাছাড়া ২০২১ সালের পরবর্তী চার বছরের মধ্যে দেশের রিজার্ভ ৬০ বিলিয়ন ডলারের পৌঁছে যেতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হলেও সে লক্ষ্য আর কোন দিনই অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের ফরেন ট্রেড এন্ড ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট ডাটাবেজ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং দীর্ঘ মেয়াদি ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যেও দেশটি তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, গত ২৫শে অক্টোবরে দেশটির হাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬৮৪.৮০৫ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি ২০২৪ সালের ১লা মার্চে এই রিজার্ভ ছিল ৬২৫.৬৩ বিলিয়ন ডলার।

তবে বিশ্বের শীর্ষ প্রথম স্থানীয় একক কোন দেশ হিসেবে চীনের কাছে গত ৩১শে অক্টোবরের হিসেব অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩.৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারের ফরেক্স রিজার্ভ মজুত ছিল। তাছাড়া চলতি ২০২৪ সালের ৩১শে অক্টোবরের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শীর্ষ স্থানীয় ফরেক্স রিজার্ভ অর্জনকারী দেশ হিসেবে জাপানের কাছে ১.১৮৩ ট্রিলিয়ন ডলার এবং সুইজারল্যান্ডের কাছে ৮৬৪.৫২ বিলিয়ন ডলারের ফরেক্স রিজার্ভ মজুত ছিল। আর এদিক দিয়ে বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ স্থানীয় রিজার্ভ অর্জনকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ভারত।

এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এক ভারত ব্যতীত অন্য সকল দেশই কিন্তু বর্তমানে চরম মাত্রায় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংকটের মধ্যে পড়ে রয়েছে। বিশেষ করে বিগত দুই দশক থেকে অর্থনৈতিক সংকটে ধুঁকতে থাকা পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফ এর দেয়া বেল আউট ঋণ প্যাকেজ এবং চীন কিংবা সৌদি আরবের মতো দেশের ঋণ ও দেনার উপর ভর করে কোন রকমে টিকে রয়েছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া হালনাগাদ তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ২৫শে অক্টোবর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিট ১১.১৬ বিলিয়ন ডলারের ফরেক্স রিজার্ভ মজুত ছিল।

তবে করোনা মহামারির সময় গত ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চরম মাত্রায় অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ দক্ষতার সাথেই তাদের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠছে। বিশেষ করে গত ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশটি। একাধিক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও চলতি ২০২৪ সালের আগস্ট মাস শেষে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৫.৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে শ্রীলংকার হাতে মাত্র ১.৮৯৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে চলতি ২০২৪ সালের একই সময়ে আফগানিস্তান ৬.২২৮ বিলিয়ন ডলার, নেপাল ১৮.৪ বিলিয়ন ডলার, ভুটানের ৯২৭ মিলিয়ন ডলার এবং মালদ্বীপের ৫৮৮ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (স্বর্ণের মজুতসহ) ছিল। যা কোন অবস্থাতেই একটি স্থিতিশীল দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কিন্তু মোটেও যথেষ্ট নয়। তাছাড়া জনসংখ্যার অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ফরেক্স এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ যে ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে সেটি বলার কিন্তু কোন সুযোগ নেই।## তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক, সেন্ট্রাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.