কাজী ফেরদৌস, কানাডা থেকে
তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ নিম্ন মুখী।আট ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ষোল ডিগ্রিতে উঠানামা করছে। সামনের দিন গুলোতে ক্রমাগত ভাবে কমতে কমতে একসময় শুন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে মাইনাসে চলে যাবে। আকাশ ও কেমন মেঘলা কদিন ধরে। কেমন একটা স্যাঁতসেতে ভাব মনকে আচ্ছন্ন করে আছে গত দুদিন ধরে। প্রকৃতির মতো মনের মাঝে ও একধরনের গুমোট ভাব।কেমন এক ধরনের নিস্পৃহতা নিরাসক্ততা।মনে হয় জগৎ সংসারে কিছু করার নেই এমনকি কিছু ভাবার ও নেই। তাই একটা নিস্পৃহ ভাব নিয়ে অনেক টা আত্মমগ্ন হয়ে বসে বসে সময় পার করছি। এই বিশ্বচরাচরে যেন কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। অন্তরের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল শুন্য গহব্বর যেন মহাশুন্যের এক ভাসমান ব্লাকহোল যার মাঝে সবকিছু বিলীন হয়ে যায়।এমনকি আলোর তরঙ্গ ও তার আশপাশ দিয়ে যেতে ভয়পায়। আমার সুখদুঃখ আনন্দ বেদনার সকল অনুভবও যেন বিলীন হয়ে গেছে সেই শুন্য গহব্বরে।নিজেকে মনে হয় যেন অনির্বাণ প্রাপ্ত এক গৌতম বুদ্ধের মতো – সুখ দুঃখের অনুভবের অনেক উর্ধ্বে এক মুনি ঋষির মতো । বৈরাগ্য যেন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে।
ছোট্ট নাতনি টা আমার সামনে আনমনে খেলছে বহুক্ষণ ধরে। আমার উপস্থিতি তার মনে কোন সাড়া জাগায় কিনা জানি না। তবুও মাঝে মাঝে অস্ফুট স্বরে কি সব বলে আদো আদো ইংরেজিতে। কিছু বুঝি কিছু বুঝতে পারিনা। তবুও হুঁ হাঁ করে সাড়া দেই মাঝে মাঝে। গিন্নি ব্যস্ত টুকটাক রান্না বান্না নিয়ে। নাতি টা স্কুলে। মেয়ে আর জামাই ব্যস্ত তাদের অনলাইন অফিস নিয়ে। কেমন সুনসান নীরবতা চারদিকে। মাঝে মাঝে ছোট্ট নাতনি টা হয়তো খেলতে খেলতে আপন মনে শব্দ তরঙ্গ ছড়াচ্ছে আনমনে।
খোলা জানলা দিয়ে দেখা যায় বাইরের বিস্তৃত আকাশ। কখনো সাদা মেঘ কখনো কালো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায় নীল আকাশের বুকে ।মাঝে মাঝে খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি আনমনে খাঁচায় বন্দী পাখির মতো। আমার মনটা ও কেমন মেঘের ভেলার মতো উড়ে যায় কোন সুদূরে, কোন গন্তব্যহীন ঠিকানায়।মনে পরে দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা। দেশের আলো দেশের বাতাস পাখির গান মানুষের শব্দ কোলাহল – কেমন যেন একধরনের নস্টালজিক আবেগ সৃষ্টি করে। মনে পরে শৈশব কৈশোর যৌবনের নস্টালজিক দিন গুলোর কথা। একধরনের হারানোর বেদনা মাঝে মাঝে বুকের মাঝে কেমন যেন হাহাকার করে উঠে।সময় কে মনে হয় এক কঠিন শিলার মতো।
গত চারটি বছর কেটেগেল যাযাবরের মত এখান থেকে ওখানে ভেসে বেড়িয়ে।কখনো ঢাকা কখনো চট্টগ্রাম কখনো শহর কখনো গ্রাম।কখনো কোলকাতা কখনো মক্কা মদীনা কখনো অস্ট্রেলিয়া – কানাডা। কেমন যেন স্থিতিহীনতার মধ্য দিয়ে। হয়তোবা গতির ক্লান্তি মনকে কাবু করে ফেলেছে। আসলে জীবন আবর্তিত হয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘিরে। লক্ষ্য নেই তো জীবনের আনন্দ ও নেই । তখন মনটা ও কেমন ভাবলেশহীন হয়ে যায়। ভাবনা গুলো হয়ে যায় বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো।
মা’র কথা খুব মনেপরে এখন। মনে পরে তাঁর হাহাকার – বিদায় নেবার আকুতি, সময়ের নিষ্ঠুর বন্ধন থেকে মুক্তির আকুতি!ক্লান্তিময় জীবনের ভার মুক্ত হবার ব্যাকুল বাসনা। তাঁর দুঃখ তাঁর ব্যাকুলতা তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি কি বেদনার ভার তাঁর বুকে চেপে
বসেছিল। মাঝে মাঝে কার যেন ডাক শুনি হৃদয়ের গহীন ভিতরে। কোন মহাসিন্ধুর ওপার থেকে আসে সেই ডাক!ক্ষীণ অস্পষ্ট। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার দিন বুঝি ফুরিয়ে এলো!
মনে পরে সেই দিনটির কথা। আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে আমার ষাট বছর বয়সে। একদিন এ্যালিফেন্ট রোডের এক দোকানে রবীন্দ্র সংগীতের ক্যাসেট রেকর্ডিং করতে গেছি। হঠাৎ শুনি সাগর সেনের কণ্ঠে একটি গান —
আমার দিন ফুরালো….
ব্যাকুল বাদল সাঁঝে
গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে, আমার দিন ফুরালো …..
গানটি ক্যাসেটে অন্তর্ভুক্ত করে নিলাম। চৌদ্দ বছর ধরে ক্রমাগত ভাবে শুনছি সেই গান।শুধু মনে হয় কোন দুরের মানুষ আমায় ডাকছে কাছে অবিরত বিরামহীন। আমি শুধু শুনে যাচ্ছি সেই ডাক সেই গুরুগম্ভীর আহবান মিলনের ব্যাকুল বাসনায়।
আমি আজো যেন কান পেতে শুনছি সেই আহবান। তাই নিজের অজান্তেই মনের মাঝে গুন গুন করে উঠে —
” কোন দুরের মানুষ যেন
এলো আজ কাছে,
তিমির আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে
বুকে দোলে তার বিরহ ব্যাথার মালা
গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা।
মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি
হার মানি তার অজানা জনের সাজে
আমার দিন ফুরালো
ব্যাকুল বাদল সাঁঝে
আমার দিন ফুরালো….”
ক্রিকভিলেজ,
অটোয়া,কানাডা ।
২৯/৯/২০২১