বিশেষ প্রতিনিধি#
চীনের প্রযুক্তি শিল্প এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সম্প্রতি চীনা বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন কম দামের একটি জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) মডেল, যার নাম ‘ডিপসিক-আর১’। এই মডেলের আত্মপ্রকাশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে শুধু চীনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেনি, বরং আমেরিকাসহ বিশ্ব প্রযুক্তি বাজারে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
এক দিনে NVIDIA-র শেয়ারে ১৭ শতাংশ পতন
‘ডিপসিক-আর১’ উন্মোচনের পরদিনই আমেরিকার প্রথম সারির এআই চিপ প্রস্তুতকারক সংস্থা NVIDIA-র শেয়ারের দাম প্রায় ১৭ শতাংশ কমে যায়। এই পতনের ফলে একদিনেই কোম্পানির মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ লক্ষ কোটি টাকা। বিশ্লেষকদের মতে, এই পতন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে চীনের দ্রুত অগ্রগতির একটি সরাসরি প্রভাব।
ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার উল্লেখ করেছে, এত দিন তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের বাজারে অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রথমেই আসত আমেরিকার নাম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় রাজত্ব চালানো ওপেনএআই, গুগ্ল, মেটা বা মাইক্রোসফ্টের মতো বহুজাতিক নানা সংস্থার জন্মও আমেরিকাতেই। কিন্তু ‘ডিপসিক-আর১’ আসার দিনেই বড়সড় পতনের মুখ দেখেছে আমেরিকার শেয়ার বাজার। ব্রডকমের ১৭.৪ শতাংশ, মাইক্রোসফ্টের ২.১৪ শতাংশ, গুগ্লের ৪ শতাংশ এবং ন্যাসড্যাকের শেয়ার প্রায় ৩ শতাংশ পড়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নতুন এআই প্রযুক্তি এনে রীতিমতো হইচই ফেলে দেওয়া ডিপসিকের বাজেটেও রয়েছে চমক। চিনের দাবি, এর আগে ‘ডিপসিক-ভি৩’ নামের একটি এআই প্রযুক্তিনির্ভর ‘বট’ তৈরি করতে মাত্র ৫৬ লক্ষ ডলার খরচ করেছিল চিন, ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে যার মূল্য মাত্র পাঁচ কোটি টাকার কাছাকাছি। অন্য দিকে, ওপেনএআইয়ের ‘জিপিটি-৪’ মডেলের জন্য এখনও পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। ফলে আমেরিকার এআই সাম্রাজ্যে অচিরেই চিড় ধরাতে পারবে চিন, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। চোখে পড়ার মতো বিষয় হল, বর্তমানে চিনকে এনভিডিয়া এআই চিপ রফতানি বন্ধ রেখেছে আমেরিকা। কিন্তু তাতে ডিপসিকের সাফল্যে এতটুকুও ভাটা পড়েনি! উল্টে আমেরিকাকেই পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে চিন।
ডিপসিক-আর১: প্রযুক্তি এবং বৈশিষ্ট্য
ডিপসিক-আর১ তৈরি করা হয়েছে এমনভাবে, যা এআই প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য এবং খরচ-দক্ষ করে তুলবে। এই মডেলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল:
কম খরচে উচ্চ কার্যকারিতা: এটি উন্নত চিপ এবং জটিল মডেলের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে এনেছে, যা উৎপাদন খরচ অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
অ্যানালাইসিস এবং জেনারেটিভ ক্ষমতা: এটি বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে এবং দ্রুত গতিতে ভাষা ও চিত্র প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম।
গ্লোবাল বাজারে প্রতিযোগিতা: ডিপসিক-আর১-এর কার্যক্ষমতা এবং কম খরচ এটি গ্লোবাল এআই প্রযুক্তির বাজারে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
মার্কিন আধিপত্যের জন্য হুমকি?
চীনের এআই প্রযুক্তি উন্নয়ন দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষত, চীন তাদের ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ প্রকল্পের মাধ্যমে এআই এবং উন্নত প্রযুক্তি ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হওয়ার পরিকল্পনা করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ডিপসিক-আর১-এর মতো উদ্ভাবন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে মার্কিন একচেটিয়া আধিপত্যে আঘাত হানতে পারে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব
ডিপসিক-আর১-এর আত্মপ্রকাশ বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
- এআই চিপ বাজারে অস্থিরতা: NVIDIA-র শেয়ার পতনের ফলে আমেরিকার এআই চিপ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- গ্লোবাল এআই প্রতিযোগিতা: চীন এখন শুধু সাশ্রয়ী এআই মডেল সরবরাহই করছে না, বরং এটি বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে নেতৃত্ব দেওয়ারও চেষ্টা করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিপসিক-আর১ শুধু একটি এআই মডেল নয়; এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ যা ভবিষ্যতে এআই বাজারে চীনের আধিপত্যের ভিত্তি তৈরি করবে। চীনের লক্ষ্য শুধু বাজারে উন্নত পণ্য সরবরাহ করা নয়, বরং খরচ-দক্ষ সমাধানের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের বাজারে স্থান করে নেওয়া। ডিপসিক-আর১ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্বে চীনের সক্ষমতার একটি বড় দৃষ্টান্ত। এটি আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশের জন্য সতর্কবার্তা হতে পারে যে এআই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন আরও কঠিন হবে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.