সিরাজুর রহমান, বিশেষ প্রতিবেদক#
সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান ইস্যু এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার সাথে ব্যাপক সামরিক দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে চীন তার কৌশলগত অস্ত্র বৃদ্ধি ও মোতায়েন করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে চলতি গত ২৫শে সেপ্টেম্বর চীন প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে লং রেঞ্জের ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। এই পরীক্ষায় চীনের স্ট্র্যাটিজিক মিসাইল ফোর্সেস ইউনিট ডামি ওয়ারহেড এবং শত্রুপক্ষের কাল্পনিক টার্গেট চিহ্নিত করে মিসাইল ফায়ার করে।
আসলে নতুন করে চালানো মিসাইল পরীক্ষায় চীন ঠিক কোন সিরিজের ব্যালেস্টিক মিসাইল পরীক্ষা চালিয়েছে তা প্রকাশ না করলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, চীন তার অস্ত্র ভান্ডারে সবচেয়ে শক্তিশালী ডংফেং-৪১ ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়েছে। চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার এই কৌশলগত মিসাইল পরীক্ষা আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে এবং তাদের পরিকল্পনা মাফিক চালানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়। তবে জাপান দাবি করে যে, মিসাইল পরীক্ষার পূর্বে চীন তাদের সতর্ক করেনি।
এর আগে গত ১৯৯৮০ সালে মে মাসে শেষ বারের মতো ৯ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের ডংফেং-৫ সিরিজের ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইলের সফল পরীক্ষা চালিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল চীন। তবে বর্তমানে চীনের অস্ত্র ভান্ডারে থাকা ১৫ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের ডংফেং-৪১ সিরিজের সবচেয়ে শক্তিশালী ও লং রেঞ্জের আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির নিউক্লিয়ার ফোর্সের হাতে খুব সম্ভবত হাজারের অধিক বিভিন্ন সিরিজের ও রেঞ্জের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপাবল মিসাইলের বিশাল মজুত রয়েছে।
এদিকে গত ২০২৩ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমানে সারা বিশ্বের মধ্যে নিউক্লিয়ার অস্ত্রের দ্রুত বর্ধনশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে রেড জায়ান্ট চীন। পেন্টাগন মনে করে এ মুহূর্তে চীনের অস্ত্র ভান্ডারে আনুমানিক মোট ৫০০টি বা এর কিছু বেশি সংখ্যক নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড থাকতে পারে। যা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে হয়ত এক হাজারের সীমাকে অতিক্রম করতে পারে বলে আশাঙ্খা করা হয়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একাধিক সামরিক থিংক ট্যাংক চীনের নিউক্লিয়ার অস্ত্র ভাণ্ডার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যা প্রকাশ করলেও বাস্তবে চীনের সরকারের তরফে তাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্র সক্ষমতা নিয়ে কখনোই তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করেনি। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার যা প্রকাশ পায় তা কিন্তু অনেকটাই আনুমানিক তথ্যের উপর ভিত্তি করেই তৈরি করা। তবে এটা ঠিক যে, চীনের শি জিং পিং সরকার বর্তমানে তাদের প্রচলিত ডিফেন্স সিস্টেমের পাশাপাশি নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স এন্ড লং এন্ড ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ বেসড মিসাইলের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে।
এদিকে চীন তার সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ আধুনিকায়নের জন্য চলতি ২০২৪ সালের জন্য মোট ২৩১.৩৬ বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট বরাদ্দ দেয়। যা ছিল কিনা তার আগের ২০২৩ সাল অপেক্ষা ৭.২% বেশি সামরিক ব্যয়। তবে দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিজের দেয়া প্রেডিকশন ও অনুমান মতে, চীন তার সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করার স্বার্থে বাস্তবে চলতি ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত আনুমানিক মোট ৪৩৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে পারে। আসলে অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত গণ মিডিয়ার কারণে চীনের সামরিক সক্ষমতা ও এ খাতে মোট ব্যয় নিয়ে প্রকৃত অবস্থা জানার কোন সুযোগ নেই।
এশিয়াব প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি আগামী ২০৪০ সালের মধ্যেই বৈশ্বিক সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে চীন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তাদের নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স এন্ড স্ট্র্যাটিজিক মিসাইল ফোর্সেস ইউনিটকে একেবারে ঢেলে সাজাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপাবল লং এন্ড ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের মিসাইলের সংখ্যা সর্বোচ্চভাবে বৃদ্ধি করা এবং তার প্রযুক্তিগত মান আধুনিকায়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে দেশটি।
বর্তমানে চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিগত মান ও সক্ষমতা যাই হোক না কেন, পিপলস লিবারেশন চাইনিজ স্ট্র্যাটিজিক মিসাইল ফোর্সের ইউনিটের নিয়ন্ত্রণে খুব সম্ভবত প্রায় ৬ হাজারের কাছাকাছি বিভিন্ন রেঞ্জের ও সক্ষমতার নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপাবল ট্যাকটিক্যাল এণ্ড স্ট্র্যাটিজিক মিসাইলের বিশাল মজুত রয়েছে। মনে করা হয় তাদের একেবারে নতুন প্রজন্মের সর্বোচ্চ ১৫ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের ডিএফ-৪১ (আইসিবিএম) মিসাইল রয়েছে আনুমানিক ৩০টি থেকে ৪০টি। যা কিনা একাধারে ১০টি করে নিতুন প্রজন্মের (এমাইআরভি) নিউক ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। তাছাড়া তাদের হাতে আরো ২ হাজারের কাছাকাছি ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের বিভিন্ন সিরিজের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপাবল ব্যালেস্টিক এন্ড হাইপারসনিক মিসাইলের বিশাল মজুত থাকতে পারে।
তবে এটা ঠিক যে, চীনের অস্ত্র ভান্ডারে থাকা নিউক্লিয়ার অস্ত্র এবং কৌশলগত মিসাইলের সংখ্যা ও সক্ষমতা নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ার সামনে যে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে তা অনেকটাই কিন্তু অনুমানের উপর ভিত্তিক করে তৈরি করা। যা নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ মিডিয়া বা সূত্র দ্বারা প্রমাণ করার কোন সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই বলে উপস্থাপিত এই তথ্য উপাত্ত একেবারে যে ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ তা বলারও কিন্তু কোন সুযোগ থাকে না। তাছাড়া চীনের নিজস্ব কৌশলগত মিসাইলের পরিসংখ্যান এবং সক্ষমতা নিয়ে প্রদত্ত তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে তা কিন্তু অবশ্যই যৌক্তিকভাবে বাস্তবে যথেষ্ট কম বা বেশি হতে পারে।