বিশেষ প্রতিনিধি#
অবশেষে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন। চেয়ারে বসেই নানামূখি সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে নতুন মেয়রকে। প্রায় ৪১১ কেিিট টাকা দেনা নিয়ে যাত্রা শুরু করতে হবে। দেশের সবগুলো সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ব্যাতিক্রম চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। যেখানে প্রতিটি স্তরে স্তরে দূর্নীতি ও অনিয়ম। লুটপাট করে সিটি কর্পোরেশনের বিপুল কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকার মালিক হেেয়ছেন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মেয়র থেকে শুরু বেশিরভাগ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পালিয়ে গেছেন। কারাগারে রয়েছেন অনেকে। দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করেছেন অনেক কর্মকর্তাও। এ অবস্থায় নতুন মেয়রকে পাড়ি দিতে হবে অনেক কঠিন পথ।
জানা গেছে, নতুন মেয়র হিসেবে ডা. শাহাদাত আগামীকাল মঙ্গলবার দায়িত্ব গ্রহণের কথা। সেই মতে কর্পোরেশনের প্রস্ততিও প্রায় শেষ। গত ২০২১ সালের চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. রেজাউল করিমকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা দেয়ার প্রতিদ্ব›িদ্ব প্রার্থী বিএনপি’র ডা. শাহাদাত রায়ের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। অন্যদিকে ডা. শাহাদাত হোসেন পান ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে ওই বছরের ২৪ ফেব্রæয়ারি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে রেজাউল করিমসহ ৯ জনকে বিবাদী করে মামলা করেছিলেন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। এর মধ্যে দেশের পট পরিবর্তন হয়ে যায়। মেয়র রেজাউল করিম পালিয়ে গেলে সিটি কর্পোরেশনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। অন্তবর্তি সরকার আপাতত বিভাগীয় কমিশনারকে দিয়ে সামাল দিলেও পূর্ণাঙ্গভাবে চলছিল না কর্পোরেশন। এরই মধ্যে বিগত মেয়র নির্বাচনের মামলার রায়ও হয়ে যায়। আদালত গত ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে জয়ী ঘোষণা করেন। একই সাথে আদালত ১০ দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করতে সরকারকে নির্দেশ দেন। আদালতের এ রায়ের ৮ দিনের মাথায় গত ৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনার সচিব শফিউল আজিম এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনে স্বাকর করেন বলে জানা গেছে। শপথের পর ডা. শাহাদাত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেবেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে জোড়াতালি চলছে এ প্রতিষ্ঠানটি। বিগত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী দীর্ঘ সময় ধরে মেয়র হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এরপর বেশ কয়েকজন মেয়র আসছেন আর গেছেন, কিন্ত সিটি কর্পোরেশনের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। দুর্নীতি, অনিয়ম এমনভাবে এ প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রাস করেছে,যা দুর করা সম্ভব হয়নি। প্রতিটি বিভাগে রয়েছে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। এরা এতই শক্তিশালী যে, বরাবরই থেকে যায় ধরা ছোয়ার বাইরে। সিটি কর্পোরেশনের যতগুলো শপিং কমপ্লেক্স আছে, দোকান আছে প্রায় সবগুলোতে কর্মকর্তাদের অনেকে মালিক। কর্পোরেশনের নির্মান কাজের ঠিকাদারদের মধ্যে নামে-বেনামে ঢুকে আছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রকৌশলীদের অনেকে নিজের ছেলে থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনকে দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে অবৈধভাবে টাকা ইনকাম করে চলেছেন।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা প্রকৌশল বিভাগের। এখানে কোন নিয়ম শৃংখলা নেই। নেই কোন যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তা। উপরের চেয়ারে যাকেই বসানো হয়েছে তারঁ বিরুদ্ধে উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ। এমনকি উন্নয়ন কাজে ঠিকাদারের কাছ থেকে স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ঘুষ নেওয়া পর্যন্ত চলেছে। বেশ কিছু প্রকৌশলীকে ওএসডি, কয়েকজনকে বদলী করার পর দেখা গেল এখানে প্রকৌশল বিভাগ চালানোর মতোন লোক নেই।
একই অবস্থা হিসাব বিভাগেও। দীর্ঘদিন ধরে একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রনে ছিল হিসাব বিভাগ। মেয়র রেজাউল করিম পালিয়ে যাবার পর হিসাব বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ধরা হয়। অনেককে বদলী করা হয়। কারও বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। শেষ পর্যন্ত এ বিভাগটিও কার্যত অচল হয়ে আছে। হিসাব বিভাগের কাছে ধর্না দিচ্ছেনা পাওনাদাররা। কিন্ত দায়িত্ব নিচ্ছেন না কেউ।
আরও খারাপ অবস্থা রাজস্ব বিভাগের। পুরো রাজস্ব বিভাগও নিয়ন্ত্রণ করে ‘শক্তিশালী’ সিন্ডিকেট। চট্টগ্রামের ভালো ভালো জায়গাগুলোতে বদলী হয়ে আসতে কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন চলে। অনেকে ¯্রফে ঘুষ দিয়ে এক জায়গায় রয়ে গেছেন বছরের পর বছর। এর মূলে রয়েছে ‘এসেসমেন্ট আর হোল্ডিং’। অভিজান এলাকাগুলোর হোল্ডিং মালিকদের টার্গেট করে গৃহকরের উঠা নামা চলে। বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেন হয় কর কমানোর জন্য। এতে বিগত মেয়রগুলোর কাছের লোকজন সব সময় জড়িত থাকে। রাজস্ব খাত নিয়ে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভযোগে পট পরিবর্তনের পর মেয়র রেজাউল করিমের পিএ,প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও রাজস্ব বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে পদ ছেড়ে দিতে হয়েছে। বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি, জায়গা, বিভিন্ন স্থাপনার গৃহকর নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রথমে বিশাল অঙ্কের কর এসেসমেন্ট দেখানো হয়। এরপর চলে দফারফা। শেষপর্যন্ত বড় অঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে নিস্পত্তি।
চসিক পরিচ্ছন্নতা বিভাগ নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। চট্টগ্রাম শহরে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু প্রভাব বিস্তার করেছে। মশার জ¦ালায় নগরবাসী রাত কাটছে ঘুমহীন। মশার অসুধ ছিটানোর নাম গন্ধও নেই। অথচ বাণিজ্য থেমে নেই। মশার ওষুধ কেনার টাকা থেকে শুরু করে বাসা-বাড়ির ময়লা আবর্জনা নিয়ে সমানে দুর্নীতি চলছে। তাই কেউ এখন অভিযোগও করেন না।
বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, চেয়ারে বসেই নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন ডা. শাহাদাত হোসেন। মেয়র ও কাউন্সিলর নেই। নেই কোন চেইন অব কমান্ড। সতুন মেয়রকে আগে ভেঙে পড়া চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে হবে। নড়বড়ে হয়ে যাওয়া প্রশাসনিক শৃংখলাসহ দুর্নীতির লাগাম টানতে হবে। একইসাথে বর্তমানে দেনা ৪১১ কোটি ৩৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। ##
পূর্ববর্তী সংবাদ
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.