আমদানি বিলের আন্ডার-ইনভয়েসিং উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়া, বড় অঙ্কের অর্থ সরিয়ে নেওয়ার প্রবনতা হ্রাস, হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থপাচার কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সখাতে। হুন্ডিতে ডলারের চাহিদা গিয়ে সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে বেশি ডলার আসতে শুরু করায় দেশে এখন রেমিট্যান্সের জোয়ার বইছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রবাসীরা অক্টোবর মাসে দেশে রেমিট্যান্স হিসেবে ২৩০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪০ কোটি ডলার। যেখানে গত ২০২৩ সালের অক্টোবরে ১৯৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৭২ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মধ্যে একটি ব্যাংকের (কৃষি ব্যাংক) মাধ্যমে এসেছে ১১ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৫৪ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৭১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। তবে অক্টোবরে ৯টি ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল, বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা রাকাব। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- কমিউনিটি ব্যাংক, সিটিজেন্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক। আর বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।
রেমিট্যান্স নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, এ বছরের জানুয়ারিতে ২১১ কোটি ৩১ লাখ ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, মার্চে ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার, এপ্রিলে ২০৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার, মে মাসে আসে ২২৫ কোটি ৩৮ লাখ ডলার, জুন মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার, জুলাইয়ে ১৯০ কোটি মার্কিন ডলার, আগস্ট মাসে ২০৮ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে আসে ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার এবং অক্টোবর মাসে দেশে রেমিট্যান্স হিসেবে ২৩০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে রেমিট্যান্স আসে। মালদ্বীপ থেকে বাংলাদেশের কর্মীরা সে দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘মালদ্বীপ মনিটারি অথরিটি’ (এমএমএ) প্রকাশিত বাৎসরিক ‘পেমেন্ট বুলেটিনে’ উঠে এসেছে এমন তথ্য। এতে বলা হয়, গত বছর মালদ্বীপ থেকে বিদেশি কর্মীদের পাঠানো তহবিল ছিল ৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২২ সালের তুলনায় বেড়েছে ৪০ শতাংশ। দেশটির ১৬ শতাংশ আয়প্রাপ্ত রেমিটেন্স বাদে ৮৪ শতাংশ বিদেশি কর্মীর পাঠানো রেমিটেন্সের মধ্যে বাংলাদেশ একাই ছিল ৫৪ শতাংশ। তারপরই রয়েছে নেপাল ১০.৬ শতাংশ, মিশর ৭.৯ শতাংশ, ফিলিপাইন ৭.৯ শতাংশ এবং ভারত ৪ শতাংশ।
মালদ্বীপে একমাত্র বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল ব্যাংক মানি ট্রান্সফার লিমিটেডের’ কার্যনির্বাহী মাসুদুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, “আগের তুলনায় মালদ্বীপ থেকে ৬০ শতাংশ বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠানো বেড়েছে। যদি দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রায় রেমিটেন্স পাঠানো যায়, তবে এই সংখ্যা তিনগুণ বাড়বে।” এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে দেশটিতে বাংলাদেশি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খোলার দাবি প্রবাসী বাংলাদেশিদের।
দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এর এক চতুর্থাংশই প্রবাসী বাংলাদেশি, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কাজ করছেন অবৈধভাবে। চলতি বছর সীমিত পরিসরে ভিসা চালু করলেও জালিয়াতির কারণে ফের বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশ থেকে নতুন কর্মী নিয়োগ। তার উপর প্রতিদিনই চলছে অবৈধ অভিবাসীদের ধরপাকড় অভিযান। এত সংকটে দেশটিতে প্রবাসীরা থাকলেও রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়েনি, বরং ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। মালদ্বীপে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা স্থাপনের মাধ্যমে যেমন করে প্রবাসীদের সমস্যার সমাধান হবে, তেমনিভাবে অবৈধ হুন্ডির অপতৎপরতা বন্ধের পাশাপাশি আরও রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে বলে অভিমত প্রবাসীদের। দেশটিতে যে কোনো একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা স্থাপনে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি তাদের।
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটিয়ে উঠতে ও রিজার্ভ বাড়াতে রেমিট্যান্স বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ফলে দেশে আসা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে জানা গেছে।#
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.