অলক বিশ্বাস, কলকাতা থেকে##
পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরকালের মতো চলে গেলেন দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ধনকুবের একজন আদর্শ ও দেশপ্রেমিক শিল্পপতি রতন টাটা। গত বুধবার ৮৬ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। তিনি মূলত টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে গত ১৯৯১ সাল থেকে একটানা ২০ বছর দায়িত্ব পালন করে ২০১২ সালে অবসরে যান। মুম্বইয়ে ১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন রতন টাটা। গত ৭ অক্টোবর তাঁকে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। বয়সজনিত রুটিন চেক-আপের জন্য তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসা চলাকালীন অসুস্থতা বাড়ে। তারপরই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বর্ষীয়ান এই শিল্পপতি। গত ৭ অক্টোবর যখন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, সেই সময় তিনি একটি বিবৃতি জারি করেছিলেন। সেই সময়ই জানিয়েছিলেন যে, তাঁর শরীর ভালো আছে। অথচ, তার দু’দিন পর ৯ অক্টোবর তিনি প্রয়াত হলেন।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলিং, ধমক, হুমকির বিষয়টি যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালে এই বিষয়ে কিছৃ কথা লিখেছিলেন রতন টাটা, ‘আজ আমরা যা দেখি তার চেয়ে আমাদের আরও বেশি সংবেদনশীল হওয়া, দয়ালু হওয়া প্রয়োজন… অনলাইনে আমার উপস্থিতি সীমিত, তবে আমি সত্যিই আশা করি ঘৃণা এবং গুন্ডামি না করে, আপনাার প্রত্যেকের জন্য সহানুভূতিশীল হবেন, এবং সমর্থনের জায়গায় বিকশিত হবে, কারণ সে যাই হোক না কেন।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় একবার এক পোস্ট করে তিনি লিখেছিলেন, রাস্তায় সাধারণ মানুষকে দু’চাকা গাড়িতে গাদাগাদি করে যেতে দেখেই তাঁর মনে এমন একটা গাড়ি তৈরির কথা এসেছিল। স্কুটারে যেভাবে গোটা পরিবারের সবাই মিলে যেতেন, তা দেখেই তাঁর মনে হয়েছিল, এঁদের সাধ্যের মধ্যে দাম থাকবে, এমন একটি গাড়ি বানানো উচিত।
রতন টাটা’র বিখ্যাত কিছু উক্তি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, রতন টাটা বলেছিলেন, ‘তুমি যদি দ্রুত হাঁটতে চাও, তাহলে একা হাঁটো। কিন্তু তুমি যদি অনেকটা দূর হাঁটতে চাও, সবাই মিলে একসঙ্গে হাঁটো ‘ আরও বলেছিলেন,‘মানুষ আপনার দিকে যে পাথরগুলো ছুঁড়ছে সেগুলি সংগ্রহ করুন। তা দিয়ে একটি অট্টালিকা বানান।’
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না রতন টাটা। তবে বেশ কয়েক বছর আগে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সঙ্গে খানিকটা মন খুলে কথা বলেছিলেন তিনি। রতন টাটা বলেছিলেন, প্রেম করলেও বিয়ে করার সাহস আর পাননি। কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে পিছু হটেছেন। প্রথম প্রেমিকা ছিলেন এক মার্কিন তরুণী। যুক্তরাষ্ট্রে তখন কাজ করতেন তিনি। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু তাকে বিয়ে করতে পারেননি। তখন ১৯৬০ সাল। ১৯৬২ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেল। ভারত ও চিনের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আকার নিল। রতন টাটা দেশ ও পরিবারের কথা ভেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়লেন। ভেবেছিলেন তার প্রেমিকা তার সঙ্গে আসবেন। কিন্তু মেয়ের বাবা-মা নারাজ। বিয়ে দিয়ে ভারতে মেয়েকে পাঠাতে চান না তারা। সম্পর্ক সেখানেই ভেঙে যায়। দ্রুত ভারতে ফিরে আসার কারণে সে সম্পর্ক পূর্ণতা পায়নি।
ষাটের দশকের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে রতন টাটার প্রেমের কথা শোনা যায়। কিন্তু বিয়ে হয়নি। পরে অভিনেত্রী অন্য একজনকে বিয়ে করেন। সে সম্পর্ক বেশি দিন টেকেনি।
অনেকে মনে করেন ছোটবেলা বাবা-মায়ের বিচ্ছেদই রতন টাটার মধ্যে বিয়ের ভীতি তৈরি করেছে। ১৯৩৭ সালে মুম্বাইয়ে রতন টাটার জন্ম। রতন টাটার বাবা নাভাল টাটা পরিবারে এসেছিলেন দত্তক সন্তান হিসেবে। রতন টাটার বয়স যখন ১০ বছর, তখন মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেই সময় থেকেই ঠাকুরমা নভাজিবাই টাটা তার দেখাশোনা করেন। মুম্বাইয়ের ক্যাম্পিয়ন স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় রতন টাটার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেন। এরপর তাকে ভর্তি করানো হয় মুম্বাইয়ের ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন কনন স্কুলে। পরে তিনি শিমলার বিশপ কটন স্কুল এবং আমেরিকার নিউইয়র্কের রিভারডেল কান্ট্রি স্কুলেও পাঠ নেন। ১৯৫৫ সালে রতন গ্র্যাজুয়েট হন একই প্রতিষ্ঠান থেকে। ১৯৫৯-এ কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্যবসাকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বের নানা দেশে। বিশ্বের ছয় মহাদেশের ১০০টি দেশে রয়েছে টাটাদের সংস্থা। রয়েছে ৩০টিরও বেশি সংস্থা।টাটাদের সংস্থার মোট ব্যবসার পরিমাণ ৩৩.৭ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু, তার মূল মালিক হয়েও প্রয়াত রতন টাটার মোট সম্পত্তির পরিমাণ মাত্র ৩৮০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। কারণ, রতন টাটা বহু অর্থ দান করতেন। বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজে তিনি দান করতেন এই সব অর্থ। এমনটাই দাবি করা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। রতন টাটা তাঁর আয়ের একটা বড় অংশ দিয়ে দিতেন টাটা ট্রাস্টে। টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমে অভাবী মেধাবীদের জেএন টাটা এনডাউমেন্ট, স্যার রতন টাটা স্কলারশিপ এবং টাটা স্কলারশিপের মাধ্যমে তিনি সাহায্য করতেন। ২০০৪ সালের সুনামি থেকে করোনা অতিমারি, সব ক্ষেত্রেই দেশবাসীকে আর্থিক সাহায্য করেছেন এই শিল্পপতি। এক বিংশ শতাব্দীতে এসেও সার জীবনের অর্জিত সমস্ত সম্পত্তির প্রায় ৬৫ শতাংশ দান করে গেছেন তিনি। ভারতের ধনকুবের বা বিলোনিয়ার হিসেবে সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছেন রতন এন টাটা। তিনি ছিলেন ভারতের এক মুকুট বিহীন মানবতার সম্রাট। ১৯৩৭ সালের ২৮শে ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহন করেন। একজন সুদক্ষ ও সৎ ধনকুবের বা ব্যাবসায়ী হিসেবে সারা বিশ্বে তার বেশ খ্যাতি রয়েছে।
মূলত আজ থেকে প্রায় ১৫৫ বছর আগে ১৮৬৮ সালে জামশেদজী টাটার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ভারতের এক নম্বর ব্রান্ড টাটা গ্রুপ। টাটার প্রতিষ্ঠাতা জমশেদজী টাটা মূলত মাত্র ২১ হাজার রুপি দিয়ে তার ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বর্তমানে টাটা গ্রুপের মালিকানাধীন কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ১০০টি অতিক্রম করেছে। সব মিলিয়ে তাদের টার্ন ওভার প্রায় ১২৬ বিলিয়ন ডলার।
চলতি ২০২৪ সালের ২০শে আগস্ট অনুযায়ী টাটা গ্রুপের মার্কেট ক্যাপিটাল ভ্যালু ৪০৩ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে রেভিনিউ অর্জন করে ১৬৫ বিলিয়ন ডলার। এই গ্রুপের বিভিন্ন সেক্টরে মোট কর্মরত কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ। সারা বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে টাটা গ্রুপ ব্যবসা পরিচালনা করে। টাটা গ্রুপের সদরদপ্তর ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের বিখ্যাত মুম্বাই শহরে অবস্থিত।
বর্তমানে টাটা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে টাটা স্টিল, টাটা মোটরস, টাটা কনসাল্টেন্সি সার্ভিসেস, টাটা এডভান্স সিস্টেম, টাটা মোটরস, টাটা পাওয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠান। তার পাশাপাশি অনেকগুলো অলাভজনক ও সেবামূলক সংস্থা (যেমন ক্যান্সার হাসপাতাল) পরিচালনা করে থাকে টাটা গ্রুপ। বিশ্বের সেরা মার্কেট ক্যাপিটাল ভ্যালু ৫০০ কোম্পানির তালিকায় টাটা কনসাল্টেন্সি সার্ভিসেস এর মার্কেট ক্যাপিটাল ভ্যালু চলতি ২০২৪ সালের অক্টোবরের হিসেব অনুযায়ী ১৮২.৬৪ বিলিয়ন ডলার এবং টাটা মোটরস এর মার্কেট ক্যাপিটাল ভ্যালু ৪৫.৪৩ বিলিয়ন ডলার।
সবচেয়ে বড় কথা ভারতের বেসামরিক এয়ারলাইন্স পরিসেবা পরিচালনা করে টাটা। এয়ার ইন্ডিয়া, এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস, ভিস্তারা এবং এয়ার এশিয়া এয়ার লাইন্সের মতো বেসরকারি যাত্রী পরিবহন বিমান পরিসেবার বা এয়ারলাইন্সের মালিক এখন টাটা গ্রুপ। বিশেষ করে গত ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে টাটা গ্রুপ প্রায় ১৮ হাজার কোটি রুপিতে ভারতের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা ‘এয়ার ইন্ডিয়া’ কে কিনে নিয়ে এক নতুন নজির সৃষ্টি করে।
তাছাড়া আগামী ২০২৬ সাল থেকে এয়ার বাসের সাথে যৌথভাবে টাটা সি-২৯৫ ট্যাক্টিক্যাল মিডিয়াম ওয়েট সামরিক পরিবরণ বিমান ম্যানুফ্যাকচারিং শুরু করবে। বিশেষ করে এই সামরিক পরিবহণ বিমানের ইঞ্জিন, ল্যান্ডিং গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু যন্ত্রাংশ এয়ারবাস নিজেই সরবরাহ করবে। তবে অন্যান্য যন্ত্রাংশ, ডিভাইস এবং সফটওয়ার ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি বা ডেভলপ করবে টাটা।##