সিরাজুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধি #
বর্তমানে বিশ্বের দুই ইকনোমিক সুপার জায়ান্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এক অভিনব শীতল প্রযুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর সেই যুদ্ধটি হচ্ছে বৈশ্বিক উচ্চ প্রযুক্তির জগতে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বাজার দখলের এক অন্য রকম যুদ্ধ বা প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় আমেরিকা ও রেড জায়ান্ট চীন যে যার মতো করেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই সেমিকন্ডাক্টর বা ন্যানো চিপ ইন্ডাস্ট্রির বাজার দখলের অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে সেই চীনের পাশেই ছোট্ট দেশ তাইওয়ান। তবে সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিযোগিতায় রাশিয়ার মতো হেভি সুপার পাওয়ারের অবদান এক রকম জিরো।
সারা বিশ্বে ২ ন্যানোমিটার ক্ষুদ্র আকারের উচ্চ প্রযুক্তির চিপ ডিজাইন ও তৈরির রাজা হচ্ছে এই সেই তাইওয়ান। এ মুহুর্তে তাইওয়ান আমেরিকার জন্য ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ তা খুব সহজে বোঝানোর কোন উপায় নেই। বর্তমানে সারাবিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বাজার মূল্য প্রায় ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের সীমাকে স্পর্শ করেছে। যা আগামী ২০২৯ সালের মধ্যেই ১ ট্রিলিয়ন ডলারে সীমাকে অতিক্রম করে যেতে পারে। আর অবিশ্বাস্যভাবে এই অতি সম্ভাবনাময় উচ্চ প্রযুক্তির সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত একাই নিয়ন্ত্রণ করে তাইওয়ান। ৮০ এর দশকে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে টেক জায়ান্ট জাপানের বড় ধরণের উত্থান হলেও পরবর্তীতে তারা এ শিল্পে জাপান কিন্তু তার যোগ্য স্থান ধরে রাখতে পারেনি।
যদিও অবশ্য উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি হিসেবে মার্কিন টেক জায়ান্ট ইন্টেল বিগত দুই দশকের বেশি সময় ধরে একক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে। তবে ইন্টেলের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার টেক জায়ান্ট স্যামসাং, জাপানের মিতসুবিশি কোম্পানি এবং চীনের বেশকিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও কিন্তু মাইক্রো এন্ড ন্যানো চিপ ডিজাইন ও ম্যানুফ্যাকচারিং এ অনেকটাই এগিয়ে গেছে বলেই প্রতিয়মান হয়। তার পাশাপাশি ভারতে বেশকিছু সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠলেও ভারত কিন্তু তার মোট সেমিকন্ডাক্টর চাহিদার ৭০% পর্যন্ত আমদানি করে থাকে। তবে চিপ আমদানি নির্ভরশীল কমাতে এ খাতে ভারত বড় আকারের বিনিয়োগ শুরু করেছে।
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি হচ্ছে তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি)। এটি কোম্পানিটি আজ থেকে ৩৬ বছর আগে ১৯৮৭ সালে তাইওয়ানে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই কোম্পানির মোট সম্পদের (মার্কেট ক্যাপিটাল) পরিমাণ ৪০০ বিলিয়ন ডলার এবং প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী ৭১.৬৬ বিলিয়ন ডলার রেভিনিউ অর্জন করে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) এর মূল মালিকানা তাইওয়ানের হলেও এর মোট শেয়ার মার্কেটের ৯০ শতাংশ মালিকানা কিন্তু কিনে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে চীনের সবচেয়ে বড় সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি হচ্ছে Semiconductor Manufacturing International Corporation (SMIC)। যেটি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই কোম্পানির নিট রেভিনিউ ৭.২৭ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে সারা বিশ্বের ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রযুক্তি খাতে সেমিকন্ডাক্টর বা মাইক্রোচিপ ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর দ্রুত ক্রমবর্ধমান শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শত বিলিয়ন ডলারের এই সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে বাংলাদেশেরও কিন্তু সীমিত পরিসরে হলেও অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে সেজন্য অবশ্যই বেসরকারি খাতের উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারের কার্যকর নীতি ও সহায়তা থাকা প্রয়োজন। যদিও আমরা এখনো পর্যন্ত আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে জন্য প্রস্তুত করতে পারিনি। বলতে গেলে এ সেক্টরে আমাদের অবস্থান কিংবা অবদান একেবারে নেই বললেই চলে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এসিআই লিমিটেড এবং ওয়াল্টন গ্রুপ অব কোম্পানি একেবারে নিজস্ব অর্থায়নে সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে খুব শিগগিরই বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে জমিও নিয়েছে বাংলাদেশের ওয়াল্টন টেক জায়ান্ট কোম্পানি। তবে এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে যে, সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে শুধুমাত্র বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করাটা কিন্তু যথেষ্ট কিছু নয়। তার আগে উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর এই খাতে প্রয়োজনীয় দক্ষ দেশীয় প্রযুক্তিবিদ এবং গবেষণার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। আর এজন্য অবশ্যই সবার আগে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির বিষয়টি সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।##