--- বিজ্ঞাপন ---

কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত হলো বঙ্গবন্ধু টানেল, ব্যয় ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা

উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম আসবেন ২৮ অক্টোবর

0

কাজী আবুল মনসুর##
কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটি একটি নতুন অভিজ্ঞতা। যা এক সময় মানুষের কাছে ছিল অসম্ভব, ছিল কল্পনার রাজ্যে, তাই এখন বাস্তবায়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ টানেল জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে আগামী ২৮ অক্টোবর। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। এই টানেলকে ঘিরে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম প্রবেশ করবে আরো বড় আকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে। টানেল ঘিরেই রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। বিদেশীরা টানেলকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দর থেকে সরাসরি টানেল ভেতর দিয়ে যাওয়া পর্যটন নগরী কক্সবাজার। পর্যটন শিল্পের জন্য ইতিবাচক বিনিয়োগও হাতছানি দিচ্ছে।
কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মানের পরিকল্পনার বিষয়টি প্রকাশের পর চট্টগ্রামের বিএনপি নেতারা অনেক হাস্যরস করেছেন। বক্তৃতা-বিবৃতিতে একে পাগলের প্রলাপের সাথে তুলনা করা হয়েছিল। কিন্ত প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা সবকিছুকে চুরমার করে দিল। টানেল নির্মানের জন্য চীন আগ্রহ দেখালে গত ২০১৬ সালের শুরুতে শুরু হয় তোড়জোর। চীন থেকে পর্যবেক্ষক দল পরিদর্শন করে চট্টগ্রামের কর্ণফুলি এলাকাটি। এ বছরের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। সিদ্ধান্ত হয় চীন ও বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে টানেল নির্মান করবে। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চলে নানা স্টাডি। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী টানেল নির্মানের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেস হাসিনা। চীনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন টানেল নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান ‘চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন’ লিমিটেড কাজ শুরু করে। টানা সাড়ে ৪ বছর ৮ মাস করার পর টানেল নির্মান শেষ। এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, বড় ধরনের ভ‚মিকম্প সহনীয় টানেলটি ৩৫ ফুট চওড়া ও ১৬ ফুট উঁচু দুটি টিউব ১১ মিটার ব্যবধানে নির্মাণ করা হয়েছে। সহজে যাতে ভারী যানবাহন প্রবেশ করতে পারে তার সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। টানেলের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের একটি অ্যাপ্রোচ রোড। রয়েছে ৭৪০ মিটার ব্রিজ। টানেলটি কর্নফ‚লি নদীর পশ্চিম পাশের চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দরকে নদীর ভেতর দিয়ে পূর্ব দিককে সঙ্গে সংযুক্ত করবে। পূর্বদিকে রয়েছে চট্টগ্রামের পাহাড় ঘেরা আনোয়ারা উপজেলা। আনোয়ারার মধ্যে দিয়ে সহজে যাওয়া যাবে মাতারবাড়ী, কক্সবাজার, টেকনাফ।
টানেল দিয়ে চললে কি টোল দিতে হবে
অক্টোবরের শেষের দিকে উদ্বোধনের পর পরই টানেলটি গাড়াী চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। এরই মধ্যে পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় টানেলের টোলও নির্ধারণ করে দিয়েছে। গত ১৩ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়,বঙ্গবন্ধু টানেল পারাপারে প্রাইভেটকার ও জিপের জন্য সর্বনিম্ন টোল ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ টোল দিতে হবে ট্রাক ও ট্রেইলারকে। ট্রেইলারের ক্ষেত্রে নির্ধারিত টোলের সঙ্গে প্রতিটি এক্সেলের জন্য আরও ২০০ টাকা করে বাড়তি দিতে হবে। এছাড়া পিকআপ ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ২৫০ টাকা, বাস (৩১ সিটের কম) ৩০০ টাকা, বাস (৩২ আসনের বেশি) ৪০০ টাকা, বাস (৩ এক্সেল) ৫০০ টাকা, ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) ৪০০ টাকা, ট্রাক (৫ দশমিক ০১ থেকে ৮ টন) ৫০০ টাকা, ট্রাক (৮ দশমিক ০১ থেকে ১১ টন) ৬০০ টাকা, ট্রাক ও ট্রেইলার (৩ এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রাক ও ট্রেইলার (৪ এক্সেল) ১০০০ টাকা এবং চার এক্সেলের বেশি ট্রাক ও ট্রেইলারগুলোকে ১০০০ টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য আরও ২০০ টাকা করে টোল দিতে হবে।
বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকেল্পনা
কর্ণফুলি নদীর এ অংশকে ঘিরে কিছু একটা হবে এমনতর গুঞ্জন ছিল ৯০ দশক থেকে। বিশেষ করে ২০০০ সালের পর থেকে দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ী কর্ণফুলি নদীর পশ্চিম পাশ ঘিরে বিশাল বিশাল জায়গা কিনে রাখে। এসব জায়গাগুলো এক সময় সস্তায় বিকিকিনি হতো। কিন্ত এখন দাম আকাশ ছোয়া। এর একমাত্র কারন টানেলকে কেন্দ্র করে চীনের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’পরিকল্পনা। ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে বিপুল অংকের বিনিয়োগে নিজেদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে অন্তত ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগ পরিবহণ করে ডেনমার্কের মার্কস লাইন। ডেনমার্ক ভিত্তিক এ দীর্ঘদিন ব্যবসা করলেও নিজস্ব কোন বিনিয়োগ ছিল না। বর্তমানে টানেল ঘিরে মার্কস লাইনের ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নতুন কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জানা গেছে, এই টানেলকে ঘিরে বিনিয়োগের মহাপরিকল্পনা নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে লাগানো বলে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নদীর তলদেশের এই টানেল। বন্দর জানায়, এরই মধ্যে বিদেশি ৭টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে এবং নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত বে- টার্মিনালে ডি পি ওয়ার্ল্ড এবং রেড সি ছাড়াও সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি, ভারতের আদানি গ্রুপ ও নেদারল্যান্ডসের এপি টার্মিনাল বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
গুরুত্ব বাড়বে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সারা বিশে^ নজর কাড়লেও অবকাঠামোগত কারনে বিদেশীদের আনা-গোনা কম। বর্তমান সরকার টানেলের মতো কক্সবাজার বিমান বন্দরকেও নজর কাড়াভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলছে। চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমান বন্দরের সাথে কক্সবাজার বিমান বন্দরের সংযোগ স্থাপন করবে বঙ্গবন্ধু টানেল। এ টানেলের মধ্যে দিয়ে মাত্র আড়াই ঘন্টায় পৌছানো যাবে কক্সবাজারে। ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রাম আসলে সহজে পর্যটন নগরী কক্সবাজার যেতে পারবেন। আবার যারা সরাসরি কক্সবাজারে আসবেন তারা সহজে চট্টগ্রামের এসে বিমান ধরতে পারবেন। এছাড়াও টানেলকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত এলিবেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান কাজও শেষের পথে। প্রায় ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মাত্র ১৫ মিনিটে আসা যাবে চট্টগ্রাম শহরে। যেখানে সময় লাগতো দেড় ঘন্টা। তাছাড়া টানেল হওয়ার পর চট্টগ্রাম ইপিজেড, কেইপিজেড এর শিল্প কারখানাগুলোতেও উৎপাদন বহুগুনে বেড়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করে প্রস্ততি চলছে
এদিকে ২৮ অক্টোবরে টানেল উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে সাজ সাজ রব শুরু হয়েছে আনোয়ারায়। বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করতে আনোয়ারায় যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম শহরে আসবেন। এরপর টানেল উদ্বোধন করে টানেলের ভেতর দিয়ে নদীর পূর্ব পাড়ের আনোয়ারায় যাবেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারার কাফকো কলোনি সংলগ্ন মাঠে জনসভায় ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। এ সমাবেশ ঘিরে আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণের মাঝে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।##

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.