কাজী আবুল মনসুর##
বর্তমানে পৃথিবীর কেবল ৩৮ টি দেশে সাবমেরিন রয়েছে। উত্তর কোরিয়া, চায়না, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, ইরান, জাপান, ভারত, গ্রিস, তুর্কি এ দেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমান সাবমেরিন রয়েছে। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়ায় ৭২ টি সাবমেরিন রয়েছে।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সাবমেরিনটির নাম হলো “আকুলা”। এটি ৮০ ও ৯০ এর দশকে সমুদ্রক্ষেত্রে রাজত্ব করেছে। এই সাবমেরিনটির ছদ্মনাম ছিলো “প্রোজেক্ট ৯৪১”। এই সাবমেরিনটি ৫৭৪ ফুট লম্বা এবং এর ওজন হলো ২৩ হাজার ৫০০ টন। এটির গতি ছিলো ঘণ্টায় ২২ নট যা সে সময়কার সবচেয়ে দ্রুতগামী সাবমেরিনগুলোর একটি।পানির তলায় ডুবন্ত অবস্থায় এরা ২৭ নট বেগে চলতে পারতো।
বাংলাদেশে বর্তমানে দুটি সাবমেরিন রয়েছে। ২০১৭ সালের ১২ই মার্চ “নবযাত্রা” ও “জয়যাত্রা” এ দুটি সাবমেরিন বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত করা হয়। এই সাবমেরিন যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী হিসেবে পরিণত হয়। উভয় সাবমেরিনই ৭৬ মিটার লম্বা এবং ৭ দশমিক ৬ মিটার চওড়া। দুটো তেই টর্পেডো ও মাইন রয়েছে যা শত্রু জাহাজ অ অন্যান্য সাবমেরিনকে আক্রমন করতে পারে।
সামরিক সরঞ্জামাদি তৈরিতে রাশিয়া বিশ্বের কাছে জায়ান্ট হিসেবে নিজেকে অনেক উচুতে নিয়েছে আগে থেকেই। সময়ের সাথে সাথে তাদের সামরিক অস্ত্র শস্ত্রও বৃদ্ধি পাচ্ছে বহুগুনে। তেমনি তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর পারমানবিক অস্ত্র বহনকারী সাবমেরিন বানিয়ে আর একবার জানান দিলো নিজেদের শক্তির পরিধিকে।
কাজান বা কে-৫৬১ নামের একটি রুশ সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজের তৈরি করেছে রাশিয়া। চলতি বছরেই এই সাবমেরিনটি রুশ নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হবে। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে শক্তিশালী ওই সাবমেরিনটি উন্মোচন করে পুতিন সরকার। দেশটির পরমাণুবিদদের দাবি এটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাটাক সাবমেরিন।
ইতোমধ্যেই রাশিয়ার অত্যাধুনিক পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন ‘কাজান’কে পানিতে নামানো হয়েছে। রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় বন্দর সেভারোদভিসিস্কে ইয়াসেন এম শ্রেণির ডুবোজাহাজ কাজানের সমুদ্রে নামানোর অনুষ্ঠানটি করা হয়। সাগরে পরীক্ষা শেষ করার পর চলতি বছরে রুশ নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হবে কাজান।
নতুন এই সাবমেরিন হাতে পাওয়ার পর সাগরে টহল দেওয়ার ক্ষেত্রে রুশ নৌবাহিনী প্রাক্তন সোভিয়েত আমলের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন রুশ নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল ভ্লাদিমির কোরোলেভে। এ ছাড়া, একই শ্রেণির আরও চারটি ডুবোজাহাজ ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি করা হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন রাশিয়ান নৌবাহিনী প্রধান।
রুশ নৌবাহিনীর প্রচলিত ডুবোজাহাজ বাহিনীর পুরনো ‘আকুলা শ্রেণির ডুবোজাহাজের স্থলাভিষিক্ত হবে ইয়াসেন এম শ্রেণি। এতদিন আকুলা শ্রেণিকে রুশ নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাটাক সাবমেরিন হিসেবে গণ্য করা হত।
রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাস জানিয়েছে, রাশিয়ার নতুন এ সাবমেরিন ৩১ কিলোনট বেগে চলতে পারে। এতে তিনশ টর্পেডো ও অন্যান্য অস্ত্র সজ্জিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। নতুন এ সাবমেরিন শত্রুপক্ষের সাবমেরিনকে ধ্বংস করতে পারে। এছাড়া এটি জাহাজ, নৌঘাটি ও বন্দর ধ্বংস করতে সক্ষম। এতে ৯০ জন ক্রু থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া সাবমেরিনটি পানির ৬০০ মিটার নিচে নামতে পারে। বাইরের কোনো সহায়তা ছাড়া এটি ১০০ দিন পানির নিচে থাকতে পারে।
পৃথিবীতে বিভিন্ন গোত্রের সাবমেরিন দেখা যায়। এবং এক একটি সাবমেরিন এক একটি বিশেষ কারনের জন্য বিখ্যাত। তবে পৃথিবীতে বিশালাকার সাবমেরিন গুলির দাপট দেখে অনেকেই হতভম্ব হয়ে যায়। আকুলা নামের বিশালকায় এক সাবমেরিন। সোভিয়েত নৌবিদ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ এই নিদর্শন, যা আশি এবং নব্বইয়ের দশকে সমুদ্র রাজত্ব করে বেড়িয়েছে। বলে রাখা ভালো, আকুলা ক্লাস হিসেবে যে সাবমেরিনের কথা এখানে বলা হচ্ছে তার পোশাকী নাম প্রজেক্ট ৯৪১। আমেরিকানরা এই সাবমেরিনগুলিকে ‘টাইফুন ক্লাস’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকে। মূলত বিভিন্ন দেশে নৌযানের প্রকারভেদ করার ধরনে ভিন্নতা থাকার কারণেই নামের ক্ষেত্রে এ ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।
১৯৫০ এবং ১৯৬০ র দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা ব্যালিস্টিক মিসাইল বহন করতে সক্ষম এমন সাবমেরিন তৈরি করতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ ছিল পরমাণু বোমা। সোভিয়েত ও মার্কিন কর্তারা ভাবতেন প্রতিপক্ষ সর্বদা কোনো ছুতোয় তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে, তাই হাতের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র থাকা প্রয়োজন। পরমাণু বোমার মতো বিদ্ধংসী অস্ত্রের হটাৎ হামলার শিকার হলে পাল্টা হামলা চালানোর জন্য অস্ত্র মজুত রাখাও খুব দরকার। এবং এই কাজের জন্য ডুবোজাহাজ বেশ উপযুক্ত। বিশেষ করে উত্তর মেরুর হীমশীতল বরফের নিচে ঘাপটি মেরে থাকা ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন যে মারাত্মক এবং ভয়ংকর নাম, তা দুই দেশই জানতো বেশ ভালো করে।
এসব সাবমেরিন যেহেতু বহুদিন জলের নিচে থাকে, তাই তাদের জ্বালানীও লাগে প্রচুর। তাই সাবমেরিন গুলিতে পরমাণু চুল্লী বসানো শুরু করা হলো। প্রথমাবস্থায় সফল হয় আমেরিকা। তাদের নটিলাস সাবমেরিন একবারে প্রায় ১৫ দিন জলের নীচে থাকতে পারতো। পরমাণু চুল্লীতে জ্বালানী লাগে খুবই সামান্য। ফুয়েল রডগুলো তেজষ্ক্রিয়তার কারণে প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়। উত্তপ্ত রডে জল ঢালা হলে তৈরি হয় বিপুল পরিমাণ বাষ্প। এই বাষ্পকেই বিশেষভাবে ব্যবহার করে চালানো হতো এই ডুবোজাহাজ গুলি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সবথেকে সমস্যার কারন ছিল তাদের সাবমেরিন গুলির শব্দ। সোভিয়েত কে-১৯ বা নভেম্বর ক্লাস সাবমেরিনগুলো ছিল বেশ নিম্নমানের। এর শব্দের কারনে অ্যামেরিকান সাবমেরিন গুলি তাদের সনার সিস্টেমের সাহায্যে সহজেই ধরে ফেলত সাবমেরিন গুলির অবস্থান।
আমেরিকা ওহায়ো ক্লাস সাবমেরিন সার্ভিসে এনেছে। এমনবস্থায় সাড়ে পাঁচশো ফুট লম্বা এই সাবমেরিনগুলো ছিল তখনকার দিনের বৃহত্তম সাবমেরিন। একনাগাড়ে জলের নীচে ২৪টি পরমাণু বোমাবাহী ট্রাইডেন্ট মিসাইল (পাল্লা প্রায় ৪,৬০০ মাইল) নিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াতে পারতো এই সাবমেরিনগুলো। এরই পাল্টা জবাব হিসেবে সত্তরের দশকেই এক বক্তৃতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান লিওনিড ব্রেজনেভ ঘোষণা করেন যে, খুব শীঘ্রই সোভিয়েত বিরাট এক পরমাণু বোমাবাহী নিউক্লিয়ার ইঞ্জিন সম্পন্ন সাবমেরিন তৈরি করতে চলেছে।
ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৮১ সালে জলে নামে আকুলা। রুশ ভাষায় এর অর্থ হাঙ্গর। মার্কিন ও ইউরোপীয়রা রীতিমত হতভম্ব হয়ে পড়ে, কারণ তাদের ধারণা ছিল এই ধরনের অত্যাধুনিক সাবমেরিন তৈরি করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরও এক দশক সময় লেগে যাবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌসীমা ছিল বিশালাকার। সেই কারনেই তাদের দরকার ছিল এক বিরাট আকারের সাবমেরিন। পাশাপাশি সোভিয়েতদের পরমাণু বোমাবাহী ব্যালিস্টিক মিসাইল আর-৩৯ এর ভর ছিল অনেক বেশি। ৫৭৪ ফুট লম্বা এই সাবমেরিনের ভর হলো ৪৮ হাজার টন। ২২ নট গতিসম্পন্ন আকুলা ছিল সে সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগামী সাবমেরিনগুলির মধ্যে একটি। জলের তলায় ডুবন্ত অবস্থায় এরা ২৭ নট গতিবেগে চলার ক্ষমতা ছিল।
জাপানি সাবমেরিনের মতো আকুলার দেহও কয়েক প্রস্থ আবরণ একটির ওপর আরেকটি দিয়ে বানানো হত। এবং এর প্রধান সুবিধা হল বাইরের আবরণটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও গোটা সাবমেরিন অচল হয়ে পড়ে না। আর সেই কারন বশত সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো অপেক্ষাকৃত চওড়া হতো। আকুলার সামনের মজবুত অংশ উত্তর মেরুর শীতল বরফ ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল।
আকুলাতে বসানো দুটি পরমাণু চুল্লী। যার প্রত্যেকটি ২ লক্ষ ৫৫ হাজার হর্স পাওয়ার শক্তি উৎপাদন করতো। এই পরিমাণ শক্তি দিয়ে ছোটখাট একটা শহরের বিদ্যুতের প্রয়োজন খুব সহজেই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। চার মাস অর্থাৎ ১২০ দিন ধরে অন্তত ১৫০ জন মানুষ আরাম আয়েশ করে থাকতে পারতো এখানে। ছিল বিশেষ সুইমিং পুল, জিমনেশিয়াম, ইনডোর খেলার জায়গা। এই সাবমেরিন ছিল সাগরের তলায় এক চলন্ত সামরিক ঘাঁটি। ১০টি ১০০ কিলোটন পরমাণু বোম (প্রত্যেকটি বোম হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত লিটল বয়-এর তুলনায় ছয়গুণ বেশি শক্তিশালী) এছাড়াও বহন করতে পারতো এই সাবমেরিনের আর-৩৯ মিসাইলগুলিকেও।
একেকটি আর-৩৯ মিসাইল লম্বায় ৫৩ ফুট, ওজনে ৮৪ টন। যার খুব সহজেই পার করতে পারতো ৮,৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব। অর্থাৎ আর-৩৯ মিসাইল উত্তর মেরুর যেকোনো অঞ্চল থেকে মূল মার্কিন ভূখন্ডে খুব সহজেই আক্রমণ করতে পারবে।
একইসাথে ২০টি মিসাইল মজুত করে রাখা থাকত একেকটি আকুলা সাবমেরিনে। এর বাইরেও থাকতো একাধিক টর্পেডো মিসাইল। প্রয়োজনে এতে বিমান বিধ্বংসী মিসাইলও বসানোর ব্যবস্থা ছিল। আকুলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এগুলি অন্য সোভিয়েত সাবমেরিনের তুলনায় বেশ উন্নত এবং নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারতো। সর্বশেষে বলা যায় ১৯৮০ র দিকে শ্রেষ্ঠ সাবমেরিন ছিল এই আকুলা ক্লাসের বিরাট ডুবোজাহাজ গুলি।
রাশিয়ার সাবমেরিন মানে বিশাল কিছু। সাবমেরিন বানানোর ক্ষেত্রে রাশিয়ার সাথে টেক্কা দিতে গিয়ে অনেক দেশ নিস্ফল হয়েছে। সেই রাশিয়ার ১৯৮১ সালে নির্মিত দানবাকৃতির সাবমেরিন এখনও বিশ্বে নজির সৃষ্টি করে চলেছে। দিমিত্রি দমিস্কি অনেক দেশের জন্য একটি হিংসার নাম। কারন এধরনের সাবমেরিন বানানো আসলেই অনেক কঠিন।
এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাবমেরিন ক্লাস! যার ডুবন্ত অবস্থায় ওয়াটার ডিসপ্লেসমেন্ট প্রায় ৪৮,০০০ টন! সবমেরিনটি ফুল নিউক্লিয়ার শক্তিচালিত এবং ব্যালাস্টিক মিসাইলে সজ্জিত!
রাশিয়ার কাছে এ ধরনের ৬ টি সাবমেরিন রয়েছে ! দিমিত্রি দমিস্কি হলো এই ক্লাসের প্রথম সাবমেরিন যেটা ১৯৮১ সালে কমিশন করা হয় এবং এখনো সার্ভিসে রয়েছে!
এটির দৈর্ঘ্য ১৭৫মিটার এবং প্রস্থ ২৩ মিটার ! যাতে দুইটি পারমাণবিক ওয়াটার রিয়েক্টর রয়েছে! আরো আছে চারটি ৫০০০ হর্স পাওয়ারের স্টিম টার্বাইন সহ ,৩২০০ কিলোওয়াটের টার্বো জেনারেটর ! ভাসমান অবস্থায় এর সর্বোচ্চ গতি ২২ নট এবং পানির নিচে ডুবন্ত অবস্থায় সর্বোচ্চ গতি ২৭ নট! একবার রসদ নিয়ে টানা ১২০ দিন পানির নিচে কাটিয়ে দিতে পারে এর নাবিকরা!
অস্ত্র হিসেবে আছে ৬টি ৫৩৩মিমি টর্পেডো টি উব!যেগুলো প্রায় ২২টি টাইপ ৫৩ টর্পেডো ফায়ারে সক্ষম! সাথে ২০টি আরএসএম ৫২ (তিন স্তর বিশিষ্ট) ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালাস্টিক মিসাইল বহন করতে সক্ষম,যেগুলোর প্রতিটায় প্রায় ১০০ কিলোটন করে ওয়ারহেড বহন করা যায়!## সূত্রঃডিফেন্স মিলিটারি