--- বিজ্ঞাপন ---

মোঘল সম্রাট শাহজাহান, বৃটিশ বিজ্ঞানী চাইম ওয়াইজম্যানের স্বজাতি প্রেম!!!!

0

কাজী ফেরদৌস :

মোগল সম্রাট শাহজাহান তাঁর মেয়ে জাহানারা কে অসম্ভব স্নেহ করতেন। সম্রাটের শেষ দিন গুলিতে জাহানারা ছিলেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী যখন তিনি আগ্রার দুর্গে আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী ছিলেন। কৈশোরে জাহানারা একবার অগ্নি দগ্ধ হয়ে মুখের কিয়দংশ পুড়ে গেলে সম্রাট যারপরনাই দুশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়লেন। অনেক বড় বড় ডাক্তারদের চিকিৎসা ও শাহজাদীকে সারিয়ে তুলতে পারছিলেন না।তখন তিনি জানতে পারলেন সুরাটের ইংরেজ কুটিতে একজন ডাক্তার আছেন যে শাহজাদী কে সারিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু একেতো পুরুষ ডাক্তার তার উপর বিদেশি খৃস্টান। এটা কিকরে সম্ভব? দরবারের সবাই এর বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত পিতৃ স্নেহ জয়ী হয়।সুরাটের ইংরেজ ডাক্তার কে তলব করা হলো।দীর্ঘ চিকিৎসার পর শাহজাদী জাহানারা সুস্থ হয়ে গেলে সম্রাট যারপরনাই স্বস্তি বোধ করলেন।সম্রাট একদিন ঐ ইংরেজ ডাক্তার কে দরবারে তলব করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তাঁর চিকিৎসার জন্য কি পুরস্কার চান?কিন্তু ইংরেজ ডাক্তার কাঁচুমাচু হয়ে বললেন তাঁর ব্যক্তিগত কোন পুরস্কার চাওয়ার নেই।শুধু ইংরেজ বনিকদের ভারতে বিনা শুল্কে বানিজ্য করার সুযোগ দান করলেই মহামান্য সম্রাটের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন। সম্রাট তো রীতিমতো অবাক!মাত্র এইটুকু চাওয়া? সম্রাট কালবিলম্ব না করেই ইংরেজ কে বিনা শুল্কে ইংরেজ কে ভারতে বিনা শুল্কে বানিজ্য করার ফরমান জারী করলেন।এই সামান্য ফরমানের বদৌলতে বনিক ইংরেজ একদিন ভারতের শাসকের ভুমিকায় নিয়ে আসে!

দেশপ্রেম আর কাকে বলে?
এরকম আর একজন দেশপ্রেমিক পাওয়া যায় ইতিহাসে।তিনি আর কেউ নন বৃটিশ বিজ্ঞানী চাইম ওয়াইজ ম্যান।সময়টা প্রথম মহাযুদ্ধ কালীন। প্রথম বিশ্বযুদ্বের একটা পর্যায়ে বিস্ফোরক তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান এসিটোন এর ভীষণ ঘাটতি দেখা দেয়। এই ঘাটতি পুরন সম্ভব একমাত্র সম্ভব কৃত্রিম এসিটোন উৎপাদন। অতএব বৃটিশ সরকার দ্বারস্থ হলেন মানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি অধ্যাপক ও গবেষক রসায়নবিদ চাইম ওয়াইজম্যানের।

তিনি দিন-রাত পরিশ্রম করে কৃত্রিম এসিটোন আবিষ্কার করতে সক্ষম হলেন এবং বৃটিশরা ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জর্জ ডেভিড লয়েড ওয়াইজ ম্যানের কাছে জানতে চাইলেন বৃটিশ সাম্রাজ্যকে এই গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানের বিনিময়ে কি পুরস্কার চান তিনি?তিনি কোন রকম ভনিতা না করে তিনি সরাসরি বলে ফেললেন – নিজের জন্য কিছু চাই না, তবে স্বজাতি ইহুদিদের জন্য চাই ফিলিস্তিনে একখণ্ড আবাস ভুমি ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশ্বাস! ডেভিড লয়েড আস্বস্ত করলেন খুব শীগগির তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হবে।

এখন প্রশ্ন জাগে কে এই ওয়াইজ ম্যান?
ওয়াইজম্যানের জন্ম রাশিয়ার অন্তর্গত বেলারুশে।সেখানে প্রথমে হিব্রু স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। মাত্র এগার বছর বয়সে ওয়াইজম্যান জয়নিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।১৮৯২ সালে তিনি বার্লিন চলে যান কেমিস্ট্রিতে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে।সেখানে তিনি বার্লিন ও ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করেন এবং আন্তর্জাতিক জৈনিষ্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। এবং প্রথম বারের মত জৈয়নিষ্ট সম্মেলনে যোগদান করেন।১৮৯৯ সালে তিনি জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান।পরবর্তী কালে ওয়াইজ ম্যান বৃটেন চলে আসেন এবং ১৯০২ সালে বৃটিশ নাগরিক হন এবং মানসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন।

বৃটেন এসেই তিনি একটি স্বতন্ত্র ইহুদি আবাস ভুমির জন্য নিরলস কাজ করতে থাকেন এবং আন্তর্জাতিক জয়েনিস্ট আন্দোলনের সাথে কাজ করতে থাকেন। তিনি বৃটিশ উপর মহলে দেন-দরবার চালাতে থাকেন। তদকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনকুবের রথশিল্ড সহ ইহুদি উপর মহলে প্রভাব বিস্তার করেন। বৃটেনের রাজনৈতিক অঙ্গনেও তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন এবং পররাষ্ট্র সেক্রেটারি লর্ড বেলফোর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চার্চিলের সাথে ঘনিষ্ঠ হন।বেলফোর এর সাথে ওয়াইজম্যান অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি আবাস ভুমি প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে থাকেন। বৃটিশ কর্তৃপক্ষ তখন উগান্ডায় তাদের উপনিবেশ বৃটিশ উগান্ডায় একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছিলেন।কিন্তু ইহুদি নেতারা সেটা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।চায়ের টেবিলে একদিন লর্ড বেলফোর কে ওয়াইজ্যান বলেন আপনাকে কেউ লন্ডনের পরিবর্তে রোচেষ্টার এ থাকতে বললে আপনি কি রাজি হবেন? বেলফোর জবাব দেন তা কেন হবে। আমি জন্মগত ভাবে লন্ডনের অধিবাসী! লন্ডন ছাড়া আর কোন শহরে বসবাস করার কথা আমি কি ভাবতে পারি?

তখন ওয়াইজম্যান বলেন মিস্টার বেলফোর আমরা ইহুদিরা যখন পেলেষ্টাইন শহরে বসবাস করি তখন আপনাদের লন্ডন ছিল একটা বদ্ধ নোংরা জলাভূমি। এখন আপনিই বলুন পেলেস্টাইন ছাড়া আর কোন দেশে আমরা কি করে থাকি? ওয়াইজম্যান জীবনে প্রথম ইজরায়েল গমন করেন ১৯১২ সালে। এরপর তিনি সেখানে পলেষ্টাইন ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি গঠন করে গরীব আরবদের কাছথেকে অল্প মূল্যে জমি কিনে ইহুদি অভিবাসীদের জন্য আবাসস্থল নির্মাণ করা শুরু করেন।এভাবে ধীরে ধীরে বাহির থেকে ইহুদিরা পেলেষ্টাইনে এসে বসতি স্হাপন করতে থাকেন।ইতিমধ্যে তিনি সেখানে হিব্রু ইউনিভার্সিটি স্হাপনের কাজ ও এগিয়ে নিয়ে যান।ইতিমধ্যে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বৃটিশদের কৌশল ও পাল্টে যায়।এতদিন তারা তুরস্কের ওসমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদ উস্কে দিয়ে আরবদের সহায়তা নিয়ে আসছিলেন। এখন তাদের মনে হলো আরব মুসলিমদের চেয়ে ইহুদিরাই মিত্র হিসেবে বেশি নির্ভরযোগ্য হবেন।তাই তাদের সমর্থন আস্তে আস্তে পেলেষ্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৭ সালে বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রী লর্ড বেলফোর বৃটিশ ধনকুবের রথশিল্ড কে এক চিঠির মাধ্যমে পেলেষ্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা ঘোষণা করেন।ইতিহাসে এটাই বেলফোর ঘোষণা নামে খ্যাত।বিনিময়ে বৃটিশ সরকার ইহুদিের কাছথেকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেন। ইহুদিরা বিশেষ করে রথশিল্ড পরিবার বৃটিশ সরকার কে যুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেন।১৯১৯ সালে যুদ্ব শেষ হলে পেলেষ্টাইন বৃটিশ প্রটেক্টরেট এ পরিনত হয়ে যায়।ফলে ইহুদিদের রাস্তা ও পরিস্কার হয়ে যায়।দলে দলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হতদরিদ্র ইহুদিরা পেলেষ্টাইনে এসে বসতি স্হাপন করতে থাকে বিশেষ করে রাশিয়া থেকে জার নিকোলাস কর্তৃক জোর বহিস্কৃত ইহুদীরা দলে দলে পেলেষ্টাইনে এসে বসতি শুরু করে। এবং বিশ্ব ইহুদি সংঘ অকাতরে তাদের আর্থিক সহায়তা দিতে থাকে।ফলে পেলেষ্টাইনে মুসলমানদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা হ্রাস পেতে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে দলে দলে জার্মানী এবং রাশিয়া পোল্যান্ড থেকে উচ্ছেদ কৃত ইহুদিরা পেলেষ্টাইনে আসতে থাকে স্রোতের মত।এরা এখানে এসে আরবদের সাথে সংঘাত ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের অভ্যন্তরিন অনৈক্য ও কামাল আতাতুর্কের ওসমানীয় খেলাফত বিলুপ্তির ঘোষণায় তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের ভেঙে খানখান হয়ে যাওয়ায় মুসলমানদের পরাজয় ঘটে এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।ঐ সময় সবচেয়ে বড় বিশ্বাস ঘাতকতা করেন নব্য তুরস্কের নেতা নাস্তিক কামাল আতাতুর্ক। তিনি পেলেষ্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা সমর্থন দেন।এদিকে ওয়াইজ্যান, আইনষ্টাইন সহ ইহুদি বুদ্ধিজীবীরা আমেরিকা কে ইজরায়েল রাষ্ট্রকে সমর্থন দিতে রাজি করায়। এমনকি রাশিয়ার সমর্থন আদায় করতে ও সক্ষম হয়। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় তাঁর নিরলস ভুমিকা ও ত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৪৯ সালে বৃটিশ নাগরিক প্রফেসর ওয়াইজম্যান কে ইহুদিরা নব প্রতিষ্ঠিত ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন।বিশ্ব ইহুদি সংঘর প্রথম সারির নেতা ওয়াইজ ম্যান ১৯৫২ সালে মারা যান।
দেশপ্রেম, স্বজাতি প্রেম কাকে আর বলে?

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.