--- বিজ্ঞাপন ---

আবহাওয়া কথন…

0
রেফায়াত কবির শাওন, অতিথি লেখক ##
জেরোম কে জেরোমের “থ্রি ম্যান ইন এ বোট” বইটা পড়ে আমার দেশপ্রেম বেশ বেড়ে যায়। পৃথিবীর প্রথম রম্য রচনা হিসেবে খ্যাত এই বইটাতে বেশ ভালভাবেই দেখান হয় সে সময়ের বৃটিশ আবহাওয়া বুলেটিনের পূর্বাভাস কতটা উল্টোপাল্টা ছিল, আর কেউ বোকার মত সেসব বিশ্বাস করলে কতটা বিপদে পড়তে হয়। এই বই পড়ে প্রথম মাথায় ঢুকে আবহাওয়ার খবর শুধু আমাদের দেশেই উল্টাপাল্টা হয় না, উন্নত দেশেও তাই।
যখন বইটা পড়ি তখন আমি স্কুল ছাত্র আর দেশে স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতায়। টিভি চ্যানেলও মাত্র একটা আর তাতে সংবাদ বলতে ক্ষমতায় থাকা ইশ্বরের বন্দনা। তারপরও কোন বিকল্প না থাকায় মানুষ রাত আটটায় আর দশটায় পুরো নিউজ দেখত অসম্ভব মনোযোগ দিয়ে। দেশ বিদেশের ঘটনা দুর্ঘটনার পর, খেলাধুলা আর আবহাওয়ার সংবাদ। সেসময় মানুষ খেলাধুলা খুব পছন্দ করত, আর সংবাদের এই খেলার অংশে কোন সরকার বন্দনা থাকত না।
মাঝে মাঝে মনে হত, খেলার খবরটা দেখার জন্য অনেকে পুরো খবরটা হজম করত। যাইহোক, আমি খেলার পরে আবহাওয়ার সংবাদও দেখতাম, যদিও অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না। যেমন কখনও বলা হত ‘আজ দক্ষিণ, দক্ষিণ পূর্ব দিক হতে বৃষ্টি অথবা বজ্র সহ বৃষ্টি হতে পারে’ – বুঝতে পারতাম না ‘দক্ষিণ’, আর ‘দক্ষিণ পূর্ব’ দিক আলাদাভাবে বলা হত কেন। আবার কখনও বলা হত ‘চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি স্থানে আর ঢাকা বিভাগের কিছু কিছু স্থানে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে’। মাথায় ঢুকত না কয়েকটি স্থানে আর কিছু কিছু স্থানের পার্থক্যটা কি। এগুলো নিয়ে সেসময় সবাই হাস্য কৌতুক করত।
মানুষ নাকি প্রকৃতিকে নিয়ে ঠাট্টা করলে প্রকৃতি নির্মম প্রতিশোধ নেয়। আবহাওয়ার সংবাদও আমাদের ওপর নির্মম প্রতিশোধ নিল একানব্বই সালে। যখন দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেয়া হল, মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলা হল, আবহাওয়া দপ্তরের বুলেটিনকে নিয়ে সবাই আগের মতই হাস্যরস করল, কেউ বিশ্বাস করল না, আর তাতে প্রাণ গেল লক্ষাধিক মানুষের।
বিভিন্ন দেশের সাইক্লোন এলার্টও আবার বিভিন্ন রকম। আমাদের দেশে যেমন সমুদ্র বন্দরগুলোকে এক থেকে দশ নম্বরের সিগন্যাল দিয়ে সাবধান করা হয়, অনেক দেশে আবার ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরণের সিম্বল। চীন, মেক্সিকোসহ কয়েকটি দেশে ব্যবহার করা হয় কালার কোডেড সিগন্যাল। যেমন : এলার্ট ব্লু হলে সাইক্লোনের গতি একরকম তো এলার্ট রেড হলে আরেকরকম। অবশ্য আমেরিকা এই রঙ বেরঙের এলার্ট ব্যবহার করে শত্রু দেশ বা সন্ত্রাসী হামলার সম্ভাবনা থাকলে, দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য নয়। দুনিয়াতে তারা এত মাস্তানি করেছে যে, প্রকৃতির চেয়েও মানুষ তাদের বড় শত্রু।
দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রে আসলেও বিটিভির সংবাদ এখনও বন্দনা সঙ্গীতেই আছে। তবে অনেক অপশন থাকায় এখন আর কেউ বিটিভির সংবাদ দেখে না, তাই সেই আবহাওয়ার সংবাদও আর দেখা হয় না। প্রযুক্তির কারণে এখন আবহাওয়ার বুলেটিন যেমন আগের চেয়ে অনেক নির্ভরযোগ্য হয়েছে তেমনি এ সংক্রান্ত শব্দমালায়ও এসেছে পরিবর্তন। তাই বিটিভি না দেখলেও দেশি বিদেশি চ্যানেল, ইন্টারনেট আর সংবাদপত্রে আবহাওয়ার সংবাদের পাঠক যথেষ্ঠ বেড়েছে বৈকি।
এখন সাইক্লোনগুলোর আছে চমৎকার সব নাম। আমরা যখন হিন্দি ফিল্মে কাস্মিরী সুন্দরি ক্যাটরিনা কাইফের সৌন্দর্যে মগ্ন, তখন উত্তর আমেরিকায় ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিল ‘ক্যাটরিনা’ – কি নির্মম! লাস্যময়ি অভিনেত্রি হল সংহারি ঝড়। এমনকি ওখানকার দিশি নাম ফ্লোরেন্স, হেলেন, ডোনা, ইসাবেলও বাদ যায়নি ধ্বংসাত্মক সাইক্লোনের নাম হওয়া থেকে। তবে সাইক্লোনের নাম কারণে পশ্বিমারা কিছুটা ইকুয়েল অপরচুনিটিতে বিশ্বাসি। ক্যাটরিনা, ফ্লোরেন্স, ইসাবেলের পাশাপাশি এন্ড্রু, ড্যানি, গুস্থাভের মত পুরুষের নামেও এসেছে সাইক্লোন। আমাদের এ অঞ্চলে সাইক্লোনের নামকরণে নারী প্রাধান্যই বেশি। এটা কি নারীর ক্ষমতায়নে এ অঞ্চলের অগ্রগতির কারণেই কি না জানা যায় নি।
অবশ্য, এইসব নামকরণ নিয়ে বেশি পরিক্ষা নীরিক্ষা করার অনেক বিপদ আছে। সাইক্লোনের নাম ‘মহাসেন’ দিয়ে বেশ বিপাকেই পড়েছিল শ্রীলংকার সরকার। ধর্মীয় গোষ্টিগুলো প্রতিবাদ করে তাদের সম্মাননীয় ধর্মীয় প্রতিক সাইক্লোনের নাম দেয়ায়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়, সাইক্লোন বেশ শক্তিশালি একটা ব্যাপার। তাই শক্তির সাথে শক্তির তুলনা করতেই এমন নাম।
তবে আবহাওয়া দপ্তরের সর্বশেষ পরিবর্তনটা আমার একদম পছন্দ হয়নি। বছরের এই সময়ে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এ অঞ্চলে বৃষ্টি হয় বেশ। এসময় আকাশে প্রচুর মেঘ জমে বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিলে, আবহাওয়া বার্তায় বলা হত – “গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালার’ কারনে আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি হবে। বেশ ভারি একটা কথা। কিন্তু এবছর এ কথাটা আর বলা হচ্ছে না। এখন নতুন টার্ম তৈরি করা হয়েছে, ‘মেঘ বলয়’। আবার সাইক্লোনের মত মেঘ বলয়ের নামও দেয়া হচ্ছে। যেমন এই মুহুর্তে সক্রিয় মেঘ বলয়ের নাম ‘আঁখি’। তা নাম দেন আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু “গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালা”র মত সাহিত্যমান সম্পন্ন ভারিক্কি একটা টার্মকে পরিবর্তন করে ‘মেঘ বলয়’ করাটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.