--- বিজ্ঞাপন ---

কানাডার বেগমপাড়ায় জনাব’দের সাম্রাজ্য

টাকা যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে

0

আব্দুল্লাহ আরাফাত

ম্যাপল পাতা ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হচ্ছে কানাডা। দশটি প্রদেশ ও তিনটি টেরিটোরি নিয়ে কানাডার প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ‘অটোয়া’ দেশটির রাজধানী হলেও ‘টরন্টোর’ বিশ্বের কাছে সর্বাধিক পরিচিত। উত্তর আমেরিকার এই দেশকে অভিবাসনের জন্য স্বর্গ হিসেবে বললেও অত্যুক্তি হবে না। বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের ক্যারিশম্যাটিক প্রধানমন্ত্রী মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বিশ্বজুড়ে তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও কল্যাণকর কাজের জন্য তিনি সমান জনপ্রিয়।

ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি কানাডার দাফতরিক ভাষা ফ্রেঞ্চ। অন্যতম বৃহত্তম প্রদেশ কুইবেকের মূল ভাষাও ফ্রেঞ্চ। আয়তনে বিশাল হওয়ার পরও কানাডায় মাত্র ৩.৭৭ কোটি লোক বসবাস করে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, কানাডায় প্রায় এক লাখের বেশী বাংলাদেশী বসবাস করে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে কানাডার বেগম পাড়া নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে থাকলেও এক দশক আগেও এটি নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে সংবাদ প্রচার হয়েছিল। ২০১১ সালে কানাডার দ্য স্টার পত্রিকা ‘কলোনি অব ওয়াইভস’ ট্রাইভস ইন মিসিসাগা ‘ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রচার করে। সেখানে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো ভারতীয় ও পাকিস্তানী পরিবারগুলোর ‘বেগমদের’ নিয়ে সচিত্র সংবাদ প্রচার করে। ‘বেগমপুরা’ মানে ‘যেখানে অভিজাত মহিলারা বসবাস করে’ থাকে বুঝানো হয়। এই ‘বেগমপুরা’ থেকে ‘বেগমপাড়া’ শব্দটি এসেছে বলে মনে করা হয়। সেসব দেশের মহিলাদের স্বামীরা মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করেন এবং বছর দুয়েক পর পর কানাডায় গিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে নির্দিষ্ট সময় কাটান। পরিবার থেকে দূরে থাকার একাকিত্বতা, বৈবাহিক দূরত্ব, একক অভিভাবকত্ব প্রভৃতি কাহিনী অবলম্বন করে রাশমি লাম্বা ‘বেগমপুরাঃ দ্য ওয়াইভস কলোনি’ নামে একটি ডকুমেন্টারি এক দশক আগে তৈরি করেছিলেন। তিনি সেখানে দুই বৈরি প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তানের পরিবারগুলোকেই উপজীব্য করেছিলেন। আলোচ্য বাংলাদেশীদের বেগমপাড়া পূর্বের বেগমপুরা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের।

বেগমপাড়ার অবস্থান

কানাডার নির্দিষ্ট কোন অঞ্চল নিয়ে এই বেগমপাড়া গড়ে উঠেনি। অতীতে বাংলাদেশিদের বসবাস অভিজাত টরন্টোর আশেপাশের এলাকায় হলেও বর্তমানে ধীরে ধীরে কানাডার অন্যান্য অঞ্চলেও বাংলাদেশীদের বসবাস শুরু হয়েছে। টরন্টো এবং নিকটবর্তী শহর রিচমন্ড হিল, মিসিসাগা এবং মার্কহামের অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশিদের এরকম দামি বাড়ি আছে বলে জানা যায়। বর্তমানে অবশ্য কানাডায় বেগমপাড়াকেও ছাপিয়ে যেতে শুরু করেছে বিশেষ কিছু পাড়া। কানাডাপ্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর দেশের প্রথম সারির এক পত্রিকায় লিখেছেন, কানাডার বেগমপাড়ার চেয়েও নতুন কিছু নাম টরন্টোর বাংলাদেশিদের আড্ডায় এখন উচ্চারিত হয়। বিশেষ কয়েকটি পেশা বা বিভাগের নামে পল্লি বা পাড়া যুক্ত হয়ে নতুন উপমাগুলো বেগমপাড়াকেও ম্লান করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশী বেগমদের নিয়ে কেন আলোচনা

মূলত বাংলাদেশী সাহেবদের কারণে এতসব আলোচনা। তারা দেশের মাটিতে অর্থ উপার্জন করে এবং বিভিন্ন পন্থায় সে অর্থ কানাডায় পাঠিয়ে দেয়। ‘সেকেন্ড হোম’ সুবিধায় মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, কানাডা প্রভৃতি দেশে অর্থ বিনিয়োগ করে লোকজন স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পায়। সম্প্রতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, তারা কিছুসংখ্যক বাংলাদেশী সরকারী কর্মকর্তাদের কানাডায় বাড়িঘরের খবর পেয়েছেন। এছাড়াও বলা হয়, বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া বহু ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিক তাদের স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এই ‘বেগমপাড়া’। ‘বেগমপুরা’ থেকেও বাংলাদেশী বিবিদের ‘বেগমপাড়ার’ কাহিনী ভিন্ন। বেগমপুরায় তাদের স্বামীরা মধ্যপ্রাচ্যে কঠোর পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন করলেও বাংলাদেশীদের অবস্থা অন্যরকম। কারণ, বিভিন্ন অনুসন্ধানে বলা হচ্ছে, নিজ দেশে উপার্জন করা বাংলাদেশীরা তৃতীয় কোন দেশের মাধ্যমে কানাডায় অর্থ পাচার করেন। আইনের দূর্বলতা, ফাঁকফোকর বের করে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করাটা বিত্তশালীদের জন্য তেমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশী ঋণ খেলাপি, দুর্নীতিগ্রস্ত বিত্তশালীদের পরিবার কানাডায় বসবাস করতে শুরু করলেও ‘নির্দিষ্ট আয়ের’ সরকারী কর্মকর্তারা কিভাবে কানাডার মতো দেশে বাড়িঘর, সম্পত্তি কেনেন তা বিস্ময়কর হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ সরকারের নজরদারি

বাংলাদেশ থেকে কানাডার বেগমপাড়ার জনাব’দের টাকা নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি দেরিতে হলেও সরকারের নজরে এসেছে। নজর পড়েছে আদালতের। তাইতো দুদকের চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও এর আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ঢাকার জেলা প্রশাসককে আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের নাম, ঠিকানাসহ বিস্তারিত বিবরণ জমা দিতে বলেছেন হাইকোর্ট।

জানা গেছে,  প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার নামে এক ব্যবসায়ীর বেগম পাড়ার সাম্রাজ্য নিয়ে কথা উঠার পর অনেকের নজরে আসে এ পাড়ার কেচ্ছা কাহিনী। পিকে নাকি চারটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) কাছ থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। সেই টাকায় তিনি কানাডায় সম্পদ কিনেছেন ও ব্যবসা করছেন।থাকছেন বেগম পাড়ার বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদে। শুধু পিকে হালদার না দুদকের তালিকায় চট্টগ্রামের কয়েকজন শিল্পপতির নামও। যারা ব্যাংক ঋন নিয়ে ব্যাংকে টাকা পরিশোধ না করে বেগম পাড়ায় সাম্রাজ্য গড়েছেন।  কিনেছেন ‘বেগম পাড়ায়’ বিলাসবহুল বাড়ি।  বাংলাদেশ থেকে পাচার করা কোটি কোটি টাকায় তারা সেখানে রাজত্ব করছেন। এসব কোটিপতিদের স্ত্রী এবং সন্তানরা বাস করেন এ বেগম পাড়ায়।

কিভাবে অর্থ পাচার হয়

বিদেশে কালো টাকায় পাচার হয়। বিশ্বব্যাপী কালোটাকার সবচেয়ে বড় গবেষক জার্মান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নাইডার। অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নাইডারের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ২৮ শতাংশ। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে কালোটাকা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্যোগে ২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছিল। ‘বাংলাদেশের অপ্রকাশ্য অর্থনীতির আকার: একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ’ নামের এ সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে কালোটাকার হার জিডিপির সর্বনিম্ন ৪৬ থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৮১ শতাংশ। সমীক্ষায় ১৯৭৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়কে বিবেচনা করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী, টাকার অঙ্কে বাংলাদেশে সে সময় কালোটাকা ছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। (সূত্রঃ প্রথম আলো, ১২ জুলাই ২০২০) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩০৯ কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সংস্থাটি বলছে, উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ ভাগই পাচার হয়েছে নানা কৌশলে। আর পাচারকৃত টাকার বড় অংশই গেছে আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত দাম গোপন করার মাধ্যমে। এছাড়া একই সংস্থা, ২০২০ সালের নথিতে বলেছে, জিএফআই-এর প্রতিবেদন বলছে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার বা ৯৮ হাজার কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালের পর কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা প্রকাশ করতে পারেনি জিএফআই৷ কারণ হিসেবে তারা বলছে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথ্য দিলেও বাংলাদেশ ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কোনো তথ্য দেয়নি৷ তাই অন্যান্য দেশের ব্যাপারে ২০১৭ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন করা হলেও বাংলাদেশের জন্য ২০১৫ সালের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

কেন অর্থ পাচার হয়

কেন অর্থ পাচার হয় এর কারণ অনুসন্ধানে সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর পাওয়া যাবে না।মনস্তাত্ত্বিক ,অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও পারিবারিক সুযোগ-সুবিধার আশায় মানুষের মাঝে অন্য দেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা বাড়ছে। ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াশোনা, চিকিৎসা প্রভৃতি কারণেও মানুষ বিদেশে অর্থ পাঠাচ্ছে। তবে এর একটা নির্দিষ্ট সীমা রেখাও টেনে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, দেশে সুশাসনের অভাব, সুষম পরিবেশের অভাব, বিনিয়োগে জটিলতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যত প্রভৃতি কারণও প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।

প্রতিবাদ ও পদক্ষেপ

অর্থ পাচার রোধে যে আইন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের দরকার তা বাংলাদেশের রয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করতে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও উৎসাহ। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার রোধে সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। সম্প্রতি, মহামান্য আদালত মন্তব্য করেছেন, যারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। তারা দেশ ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করছে। এদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব বলেছেন, কানাডার টরন্টোর ‘বেগম পাড়া’য় বাড়ির মালিকানা রয়েছে, এমন সরকারি কর্মকর্তাদের তালিকা দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছে দুদক। এরও আগে কানাডায় বসবাসরত সচেতন বাংলাদেশীরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে গিয়েছেন। ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ প্রভৃতি উপায়ে তারা রাজনৈতিক, সামাজিক, গণমাধ্যম, সরকারের নীতিনির্ধারকদের নজরে আনারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ( সূত্রঃ বিবিসি, জিএফআই, ডয়চে ভেলে)

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.