--- বিজ্ঞাপন ---

বৈদেশিক ঋণ ও দেনার ফাঁদে আটকে যাচ্ছে পাকিস্তান

মাথাপিছু বৈদেশিক ঋন ও দেনার পরিমাণ ১ লক্ষ ৪৬ হাজার পাকিস্তানী রুপী

0

::সিরাজুর রহমান ::

অনলাইন ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের তথ্য মতে, পাকিস্তানকে ভয়াবহ ঋণের বেড়া জাল থেকে উদ্ধার করতে চীন আবারো নতুন করে তাৎক্ষণিকভাবে অজানা কোন শর্তের মুখে ১৫০০ মিলিয়ন বা ১.৫০ বিলিয়ন ডলার ঋন সহায়তা দিতে যাচ্ছে। মুলত সৌদি আরবের কাছে পাকিস্তানের পূর্বের ২.০০ বিলিয়ন ডলারের বকেয়া ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা হবে এই নতুন চীনের কাছ থেকে নেয়া এই ঋণ দিয়ে। এক্ষেত্রে চীন যে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে সেখান থেকে চলতি ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে সৌদি আরবের পাওনা বাবদ দ্বিতীয় কিস্তিত ১.০০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে পাকিস্তানের ইমরান সরকার। বাকি ১.০০ বিলিয়ন ডলার আগামী ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে পরিশোধ করবে হয়ত অন্য কারো কাছ থেকে নেয়া বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করে। তার মানে পাকিস্তানকে এখন বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অন্য কোন দেশ বা আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার কাছ ঋন নিয়ে পরিশোধ করতে হচ্ছে আরেক দেশের ঋণ ও দেনা। এতে করে দেশটি সাময়িকভাবে ঋন বা বৈদেশিক দেনার ভারসাম্য কিছুটা রক্ষা করতে সক্ষম হলেও কার্যত দীর্ঘ মেয়াদে বড় ধরণের ঋণের ও বৈদেশিক দেনার ফাঁদে আটকে যাচ্ছে বলেই প্রতিয়মান হয়।

আসলে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে সৌদি আরব সরকার পাকিস্তানকে নুন্যতম ৬.০০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতী প্রদান করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ৩.০০ বিলিয়ন ডলার ছিল সরাসরি আর্থিক সহায়তা এবং অবশিষ্ট্য ৩.০০ বিলিয়ন ডলার জ্বালানী তেল সরবরাহের মাধ্যমে সমন্বয় করার কথা ছিল। আর এই ঋণ সহায়তার ২.০০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ এবং জ্বালানী তেল সৈদি আরব ইতোমধ্যেই পাকিস্তানকে সরবরাহ করে। তবে তুরস্কের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের ইমরান সরকারের অতি মাত্রায় সখ্যতা ও সঙ্গ বৃদ্ধি পাওয়ায় সৌদি আরবের সালমান সরকার পাকিস্তানের উপর চরম নাখোশ হয়। ফলস্রুতিতে তারা পাকিস্তানকে দেয়া সকল আর্থিক সহায়তা বাতিল করে ঋণ বাবদ পূর্বের দেয়া অর্থ ফেরত দেবার জন্য পাকিস্তানের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আবার পাকিস্তানকে আর্থিক সহায়তার ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক প্রভাবশালী ও ধনী দেশ আরব আমিরাতও কিন্তু সৌদি আরবের মতো একই পথে হাঁটছে বলে আশাঙ্খা করা হয়।
এদিকে ৬২ বিলিয়ন ডলারের সুবিশাল চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) এর মেইনলাইন (এমএল)-১ প্রকল্পের প্যাকেজ -১ এর নির্মাণকাজের জন্য চীনের কাছ থেকে ১% সুদে অতিরিক্ত ২.৭০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ঋণ নিতে চায় পাকিস্তান। চীনের অর্থায়নে নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬.১০ বিলিয়ন ডলার। তবে চীন কিন্তু এখনও পাকিস্তানের এই অনুরোধে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন সাড়া দেয়নি। এদিকে বেইজিং জানিয়েছে, টার্মশিটে উল্লিখিত সুদের হার আরো বেশি করা হতে পারে। এর মাধ্যমে চীন কার্যত পাকিস্তানের প্রধান বৈদেশিক ঋণ প্রদানকারী এবং অর্থিক সহায়তাকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
২০২০ সালে চলমান করোনা (কভিড-১৯) মহামারির বিরুপ প্রভাব থেকে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিতে এবং আপদকালীন ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট ব্যবস্থা ঠিক রাখতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এর কার্যনির্বাহী বোর্ড জরুরীভাবে র‌্যাপিড ফিনান্সিং ইনস্ট্রুমেন্টের (আরএফআই) অধীনে এসডিআর ১,১১৫.৫০ মিলিয়ন বা ১.৩৮৬ বিলিয়ন ডলার (কোটার ৫০%) সমপরিমাণ অর্থ পাকিস্তানকে ঋন বাবদ বরাদ্দ দিয়েছে। যদিও ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা বা বেল আউট এড়াবার জন্য ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফাণ্ড (আইএমএফ) এর কাছ থেকে নতুন করে ১০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল আকারের বৈদেশিক ঋন পেতে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে পাকিস্তানের ইমরান সরকার।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে পাকিস্তান মোট ১০.৫০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋন নিয়েছে। আর এই বড় ধরণের ঋন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, বৈদেশিক ব্যাংক, সৌদি আরব, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ সরবরাহ করেছে। তাছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে পাকিস্তান মোট ৮.৪০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋন নিয়েছিল।
স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের তথ্য মতে, ২০২০ সালের জুনের শেষে পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋন এবং দেনার স্থিতির পরিমাণ ১১৩ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া শুধুমাত্র বিগত দুই বছরে দেশটি নজিরবিহীনভাবে ১৭.৬০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋন নিয়েছে। যা কিনা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক ঋন ও দেনা। বিশেষ করে ভারতের সাথে সামরিক শক্তিতে পাল্লা দিতে আধুনিক ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ক্রয় এবং তার পাশাপাশি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের কারণে পাকিস্তানের পাহাড় সমান বৈদেশিক ঋন ও দেনার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋন ও দেনার পরিমাণ ১ লক্ষ ৪৬ হাজার পাকিস্তানী রুপীর সমপরিমাণ অর্থের কাছাকাছি এসে পৌছেছে। আর এখন প্রতি অর্থ বছরে পাকিস্তানের বাজেটের একটি বড় অংশ বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে ঋনের মূল অংশ ও সুদের দেনা পরিশোধ করার জন্য।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্য অনুযায়ী ২০শে নভেম্বর ২০২০ ইং তারিখে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০.৫৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এই রিজার্ভের ৭০% কিনা বৈদেশিক ঋন সহায়তার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আর দেশটির বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋন ও দেনার বিবেচনায় ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ কিন্তু মোটেও যথেষ্ঠ নয়। সেপ্টেম্বর ২০১৮ তে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ৮.৪০ বিলিয়ন ডলার।
২০২০ অর্থ বছরে পাকিস্তানের পন্য রপ্তানির পরিমাণ ২২.৫০৫ বিলিয়ন ডলার এবং এর বিপরীতে ঠিক একই সময়ে পন্য আমদানির পরিমাণ ৪২.৪১৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের পন্য রপ্তানির পরিমাণ ৩৩০ বিলিয়ন ডলার এবং ২৩শে অক্টোবর ২০২০ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫৮০ বিলিয়ন ডলার। যদিও ঠিক একই সময়ে ভারতের বৈদেশিক ঋনের পরিমাণ ৫৫৪ বিলিয়ন ডলার।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পন্য রপ্তানির পরিমাণ ৩৩.৬৭ বিলিয়ন ডলার এবং যা ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৪০.৫৩ বিলিয়ন ডলার ছিল। তবে চলতি ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৫.০০ বিলিয়ন ডলারের সীমাকে স্পর্শ করে। তবে বাংলাদেশের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতির পরিমাণ ৪৪.০২৩ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে। যা কিনা বাংলাদেশের জাতীয় জিডিপির ১৩.৩৪% এর কাছাকাছি প্রায়।
তবে প্রকাশ থাকে যে, বিশ্বের একক কোন দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে চীনের কাছে। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরের হিসেব অনুযায়ী চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা কমে ৩.১২ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৩১২০ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে। তবে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিশ্বের সর্বোচ্চ হলেও চীনের বৈদেশিক ঋনের পরিমাণও কিন্তু মোটেও কম নয়। মে ২০২০ এর হিসেব অনুযায়ী চীনের মোট বৈদেশিক ঋন ও দেনার স্থিতির পরিমাণ ৫.৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৫৪৮০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।

এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, পাকিস্তানের প্রধান বৈদেশিক বিনিয়োগকারী বা ঋন প্রদানকারী দেশ কিন্তু চীন। আর চিনের সাথে পাকিস্তানের রয়েছে প্রায় ৫ দশকব্যাপী এক পরীক্ষিত ও সুগভীর অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক। কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান সরকার প্রধান ইমরান খান ক্ষমতায় আসার শুরু থেকে এ পর্যন্ত একাধিকবার চীন সফর এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সম্পন্ন করলেও, অত্যন্ত সুচতুর চীনের শি জিং পিং সরকার পাকিস্তানকে কার্যত এখনো পর্যন্ত তাদের চরম অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সুনিদিষ্টভাবে একেবারেই শর্তহীন ঋন প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। যদিও চীন ২০১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া চীন পাকিস্তান ইকনোমিক করিডর (সিপিইসি) প্রজেক্টের আওতায় পাকিস্তানের গোয়াদর সমুদ্র বন্দর আধুনিকায়ন এবং সুদীর্ঘ ১৩০০ কিলোমিটার (ওয়ান বেল্ট রোড) মহাসড়কসহ একাধিক প্রজেক্টে এখনো পর্যন্ত ৬২.০০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে বলে জানা যায়।
তবে যাই হোক না কেন, অদূর ভবিষ্যতে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্প পাকিস্তানে বাস্তবায়ন হলেও এর মূল সুবিধাভোগী এবং ব্যবহারকারী কিন্তু চীন নিজেই হতে যাচ্ছে। অবশ্য এখান থেকে মোটা অংকের রাজস্ব আদায় এবং নিজেও ব্যবহারের সুবিধা করতে পারবে দেশটি। তবে ভবিষ্যতে এই রুট ব্যবহার করে চীনের পন্য খুব সহজে এবং কম খরচে মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা এবং ইউরোপে পৌছে দেবার মহা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীনের শি জিং পিং প্রসাশন। চালুর পর এই করিডর দিয়ে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৫.০০ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পন্য পরিবহণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে চীন প্রশাসন। অথচ এ বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিলিয়ন ডলারের ঋন এবং বৈদেশিক দেনায় জর্জরিত পাকিস্তানের আর্থিক খাত এবং তার জাতীয় অর্থনীতি। আর এদিকে পাকিস্তান তার নিজের অর্থনৈতিক খাত শক্তিশালী করার দিকে নজর না দিয়ে জনসাধারণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে ভারতের সাথে সীমান্তে বিরামহীন, অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং প্রাণঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে নিজেকে পরোক্ষভাবে হলেও অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিহীন ও ধ্বংস করে ফেলছে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.