--- বিজ্ঞাপন ---

ইন্দোনেশিয়ার ডুবে যাওয়া সাবমেরিন অনেক দেশের জন্য সতর্কবার্তা

0

২০২১ সালের সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং দূঃখজনক একটি ঘটনা ছিল সাগরের বুকে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর সাবমেরিন ধ্বংস এবং মানবিক বিপর্যয়। আসলে চলতি ২০২১ সালের ২১শে এপ্রিল দেশটির নৌবাহিনীর একটি এ্যাটাক সাবমেরিন কেআরআই নাঙ্গালা বালি দ্বীপের কাছাকাছি সাগরের বুকে ধ্বংস হয়ে ৫৩ জন নিরাপরাধ নাবিক মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেন। আসলে কমাণ্ড সেন্টারের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সাবমেরিনটি বালি দ্বীপের কাছাকাছি সাগরের বুকে লাইভ টর্পেডো ড্রিল পরিচালনা করেছিল এবং নিখোঁজ হওয়ার আগে একটি সরাসরি টর্পেডো নিক্ষেপ করেছিল সাগরে। সাবমেরিন থেকে রেডিও সংকেত পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে সাবমেরিনে থাকা ক্রুরা খুব সম্ভবত সরাসরি টর্পেডো ফায়ার করে সাবমেরিনের অবস্থান এবং ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণের সর্বচ্চো চেষ্টা করে যায়।

এই ঘটনার পর পরই ইন্দোনেশিয়ার এবং অন্যান্য দেশের একাধিক রেসকিউ জাহাজ সাবমেরিনটির সন্ধানে পাঠানো হয়। তবে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর নিজস্ব কোন সাবমেরিন রেসকিউ ভ্যাসেল না থাকায় বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায় এই উদ্ধার অভিযান। ৬টি যুদ্ধ জাহাজ, একটি হেলিকপ্টার ও ৪০০ উদ্ধারকর্মী সাবমেরিন উদ্ধার অভিযানে অংশ নিলেও সাবমেরিনে থাকা নিষ্পাপ মানুষগুলোর জীবন কোন ভাবেই রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

জার্মানি তৈরি টাইপ ২০৯ ক্লাসের কেআরআই নাঙ্গালা এ্যাটাক সাবমেরিনটি ১৯৭৮ সালে পরীক্ষামুলকভাবে সাগরের বুকে ভাসানো হলেও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীতে চূড়ান্তভাবে সার্ভিসে আসে ১৯৮১ সালে। সে হিসেবে এটি এ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৪৩ বছর অপারেশনাল ছিল ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীতে। অথচ বাস্তবে কিনা এর সার্ভিস লাইফ টাইম আরো অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কারণ সাধারণত ডিজেল চালিত একটি এ্যাটাক সাবমেরিনের আদর্শ সার্ভিস লাইফ টাইম ধরা হয় ২৫ বছর এবং ১ থেকে ২ বার মেজর আপগ্রেডিং বা পূর্ণঃ মেরামত করে এর সার্ভিস লাইফ টাইম আরো সর্বোচ্চ ৮ বছর পর্যন্ত বর্ধিত করা যেতে পারে।

তবে সার্ভিস লাইফ টাইমের সর্বোচ্চ সীমা শেষ হওয়ার পর সাবমেরিনটি গভীর সমুদ্রে দীর্ঘ মেয়াদে অপারেশনে ব্যবহার করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে যে কোন মুহূর্তে বড় ধরণের প্রাণহানি বা ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা থেকে যায়। তাছাড়া বড় ধরণের প্রাণহানী এড়াতে এটিকে তার এক্সটেনশন সার্ভিস লাইফ শেষে একেবারে ডিকমিশনিং বা নেভাল ফ্লীট থেকে অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে প্রয়োজনে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বেসিক ট্রেনিং সাবমেরিন ভ্যাসেল হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ থাকে।

জার্মানির নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি টাইপ ২০৯ ক্লাসের সাবমেরিন বর্তমানে তুরস্কের নৌবাহিনীতে ৪টি, ইকুয়েডর নৌবাহিনীতে ২টি এবং পেরুর নৌবাহিনীতে মোট ৪টি রয়েছে। যেগুলোর সার্ভিস লাইফ টাইম ২৫ থেকে ২৮ বছর অতিক্রম করলেও এখনো পর্যন্ত ৩৫ বা ৪০ বছরের সীমাকে স্পর্শ করেনি। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তাদের নৌবাহিনীতে থাকা অতি পুরনো কিছু সংখ্যক সাবমেরিন অবসরে পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি গুরত্ব সহকারে বিবেচনা করেছে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উচ্চ প্রযুক্তির ৪টি লসএনজেলস ক্লাস নিউক্লিয়ার পাওয়ারড (এসএসএন) সাবমেরিন ৩৬ বছরের অপারেশনাল সার্ভিস লাইফ টাইম শেষে ২০১৭ সালে অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে ২০০৩ সালের ২৫শে মার্চ চীনের নৌবাহিনীর একটি টাইপ-০৩৫জি মিং-৩ (সিরিয়াল নম্বর ৩৬১) সাবমেরিন বোহাই সমুদ্রের উপকূলের কাছাকাছি প্রশিক্ষণ মিশন চলাকালীন অবস্থায় খুব সম্ভবত কারিগরি ত্রুটি জনিত কারণে ধ্বংস হয়ে যায় এবং সাবমেরিনে থাকা সকল নাবিক ও ক্রু মৃত্যুবরণ করেন। পর দিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চ চীনের নেভাল রেসকিউ টিম সাবমেরিনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় এবং তখন তারা ভেতরে ৭০ জন চীনা সাবমেরিনারের মৃতদেহ সেখানে দেখতে পায়। তবে পরবর্তীতে চীন আর কোন দিনই এই মিং ক্লাস সাবমেরিন দূর্ঘটনার প্রকৃত কারণ বিশ্বের সামনে প্রকাশ করেনি।

যদিও আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী তার সাবমেরিন বহরে ৪৩ বছরের অতি পুরনো কেআরআই নাঙ্গালা এ্যাটাক সাবমেরিনকে সার্ভিসে রাখাটা যুক্তিসঙ্গত ছিল কিনা তা কিন্তু একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় হিসেবে থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বড় আকারে নৌবাহিনী থাকা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীতে নিজস্ব সাবমেরিন রেসকিউ ভ্যাসেল না থাকাটাও একটি প্রশ্নবিদ্ধ ইস্যু হয়ে থেকে যাচ্ছে।

তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই ইন্দো্নেশিয়ার সরকার এবং তার নৌবাহিনী কেআরআই নাঙ্গালা সাবমেরিন ধ্বংসের পিছনে তাদের চরম অবহেলা এবং অদক্ষতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এক্ষেত্রে তাদের জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা কোনভাবেই এঁরাতে পারে না। যা হোক ইন্দোনেশিয়ায় ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক সাবমেরিন দূর্ঘটনা কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের নৌবাহিনীর বহরে থাকা পুরনো সাবমেরিন পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনায় আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করার বিষয়ে চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা প্রদান করে।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.