--- বিজ্ঞাপন ---

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কোন দেশে কতো

0

সিরাজুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধি#

একটি দেশের অর্থনীতি ঠিক কতটা শক্তিশালী তা যাচাইয়ের একাধিক সূচক বা মানদ্বন্দ থাকলেও তার মধ্যে অন্যতম একটি সূচক হচ্ছে ফরেক্স এক্সচ্যেঞ্জ রিজার্ভ বা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আর এখনো পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে আমেরিকার মুদ্রা ডলার। যদিও বিগত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ডলারে অবস্থান অনেকটাই দূর্বল হয়ে এসেছে। তার পাশাপাশি চলমান ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দার মুখে হোঁচট খেয়েছে আমেরিকার জাতীয় অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে ডলারের অবস্থান।

অর্থনীতি গবেষণা বিষয়ক একাধিক আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংকের দেয়া তথ্য মতে, গত ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী সারা বিশ্বে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বা সংরক্ষণের দিক দিয়ে আমেরিকার ডলার ৫৮.৩৬%, ইউরো ২০.৪৭%, জাপানিজ ইয়েন ৫.৫১%, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড ৪.৯৫% এবং চীনের মুদ্রা ইউয়ানের অবদান ছিল মাত্র ২.৬৯%। যদিও গত ২০১৬ সালের হিসেবে আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও রিজার্ভের দিক দিয়ে মার্কিন ডলার ৬৫.৩৬%, ইউরো ১৯.১৪%, জাপানিজ ইয়েন ৩.৯৫%, পাউন্ড ৪.৩৫% এবং চীনের ইউয়ান ১.০৮%। আর এক্ষেত্রে কিন্তু রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের অবস্থান ঠিক ১% এর অনেক নিচেই রয়ে গেছে।
তবে এটা ঠিক যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মুদ্রা ডলার যেভাবে রাজত্ব শুরু করেছিল বর্তমানে সে অবস্থান কিন্তু অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তার মানে এই নয় যে, চলতি ২০২৩ সালের শেষের দিকে ডলারের পতন হয়ে চীনের মুদ্রা ইউয়ান কিংবা রাশিয়ার মুদ্রা রুবল সারা বিশ্বে রাজত্ব শুরু করে দিবে। বিগত ৫ দশকে চীনের জাতীয় অর্থনীতি এবং বৈদেশিক বানিজ্যের আকার সুবিশাল হলেও শুধুমাত্র আস্থাহীনতার কারণেই বিশ্বের অন্যান্য সকল দেশ চীনের মুদ্রা ইউয়ানকে ফরেক্স কারেন্সি রিজার্ভ হিসেবে রাখতে ভরসা পায় না। বিশেষ করে চীনের ত্রুটিপূর্ণ বৈদেশিক নীতি, ঋনের ভয়াল থাবা এবং এক তরফা বানিজ্য সুবিধা আদায়ের কৌশল কিন্তু বিশ্ববাসীর নজর এড়ায় নি।

এদিকে বর্তমানে ফরেক্স কারেন্সি রিজার্ভের দিক দিয়ে সারা বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে চীনের নাম। রয়টার্স নিউজ এজেন্সির দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৩ সালের জুন মাসের হিসেব অনুযায়ী চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.১৯২ ট্রিলিয়ন ডলার। এ থেকে আসলে চীনের জাতীয় অর্থনীতি ঠিক কতটা বিশাল আকারের হতে পারে তা অনেকটাই অনুমান করা যায়। তাছাড়া সিটিজিএন নিউজের দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন এই ৬ মাসে দেশটির আমদানি-রপ্তানি বানিজ্যের আকার ছিল কিনা ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলার।

তাছাড়া ফরেক্স কারেন্সি রিজার্ভের দিক দিয়ে সারা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জাপান ১.২৫ ট্রিলিয়ন ডলার, তৃতীয় স্থানে সুইজারল্যান্ড ৮৯৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ গড়ে তুলেছে। তাছাড়া বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ ফরেক্স রিজার্ভকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ভারত। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৩ সালের ১৪ই জুলাইয়ের হিসেব অনুযায়ী ভারতের কাছে ফরেক্স এক্সচ্যেঞ্জ রিজার্ভ রয়েছে ৬০৯.০২২ বিলিয়ন ডলার। যা কিনা নিশ্চিতভাবে দেশটির স্থিতিশীল ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থানের জানান দেয়।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া হালনাগাদ তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি ২০২৩ সালের জুন মাস শেষে ছিল ৩১.২০৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও একই সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দেয়া (বিপিএম-৬) নতুন গাইড লাইন অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যবহার যোগ্য নীট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ২৪.৭৫৪ বিলিয়ন ডলার।
অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে রাশিয়া ৫৯৪.৪ বিলিয়ন ডলার, তাইওয়ান ৫৬২.৮৭ বিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া ৪২১.৪৫ বিলিয়ন ডলার, হংকং ৪২১.০০৭ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ গড়ে তুলেছে। তার পাশাপাশি সৌদি আরব ৪০৪.৪৭ বিলিয়ন ডলার, ব্রাজিল ৩৪১.১৫৮, তুরস্ক ৯৭.০৮, ভিয়েতনাম ৯৫ বিলিয়ন এবং সিঙ্গাপু্রের ২৮৯.৪৮৪ বিলিয়ন ডলারের বিশাল আকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে।
তাছাড়া কয়েক বছরের ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারো কিছুটা চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। চলতি ২০২৩ সালের মে মাসের হিসেব অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.৪৮৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও দেশটির পাহাড় সমান ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋন ও দেনার বিপরীতে এই রিজার্ভ আসলে কিছুই নয়।
এদিকে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে অন্যান্য দেশের আর্থিক সহায়তা ও আইএমএফ এর ঋন প্যাকেজ ছাড় করার জন্য পাকিস্তানের রিজার্ভ পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া হালনাগাদ তথ্য মতে, চলতি ২০২৩ সালের ২১শে জুলাইয়ের হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের সেন্ট্রাল ব্যাংকে ৮.১৮৬ বিলিয়ন ডলার এবং অন্যান্য বানিজ্যিক ব্যাংকে ৫.৩৪৮ বিলিয়ন ডলারের ফরেক্স রিজার্ভ ছিল। যে হিসেবে দেশটির হাতে ব্যবহার যোগ্য মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ১৩.৫৩৪ বিলিয়ন ডলার।
বিশেষ করে গত সপ্তাহে রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় পাকিস্তানের সেন্ট্রাল ব্যাংকে সৌদি আরব ২ বিলিয়ন ডলার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ১ বিলিয়ন ডলার ডিপোজিট করে। তার পাশাপাশি আইএমএফ ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋন প্যাকেজের আওতায় ১.২ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড পাকিস্তানের হাতে তুলে দিলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। তবে বিগত এক যুগে অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋনের অর্থ দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে আরেক দেশের ঋনের দায় পরিশোধ করার জন্য আজ পাকিস্তানের এই বেহাল দশা দেখা দিয়েছে।
এদিকে ডলারের বিকল্প মুদ্রা হিসেবে চীন রাশিয়ার নেতৃত্বে ব্রিকস জোট নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রচলনের ব্যাপক চেষ্টা করে গেলেও বাস্তবে তার সফলতা এখনো পর্যন্ত কাগজে কলেমের ভিতরেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ‘ব্রিকস’ জোটের ভাঙ্গনের সুর বেজে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বানিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে জোটের সাথে একমত হলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলারের বিপরীতে এ মুহুর্তে নতুন কোন মুদ্রাকে বেছে নিতে চায় না ভারত। ব্রিকস জোটকে ব্যবহার করে চীন তার মুদ্রা ইউয়ানকে একতরফা ভাবে ডলারের বিকল্প মুদ্রা হিসেবে প্রচলনের জোড় চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করে ভারত।##

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.