কাজী আবুল মনসুর ##
অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ইসরাইলের উপর হামলা করার কি পরিমান মাশুল ফিলিস্তিনিদের দিতে হবে তা বলাবাহুল্য। এরই মধ্যে সীমান্ত চুরমার করে ইসরাইল গাজাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন রণতরীসহ অনেক কিছুই এখন ছুটছে ইসরাইলকে রক্ষার জন্য। ফিলিস্তিন এর হামাস’এর এ হামলাটি ইসরাইলের অনেক ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে। ইসরাইলের একটি অনুষ্ঠানেই মারা গেছে ২৭০ জন। বলা হচ্ছে ,প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে ইসরাইলে। এত মৃত্যু ইসরাইলের মানুষ অনেক যুগ দেখেনি। ইসরাইলের আধুনিক যত সব কৌশল চুরমার করে হামাস যে এতবড় ক্ষতি করবে তা কখনো ভাবতে পারে নি ইসরাইল। হামাস তুলে নিয়ে গেছে শতাধিক ইসরাইলীকে। ফিলিস্তিনি হাজার হাজার মানুষ ইসরাইলে কারাবন্দী। হামাস দরকষাকষি করেই প্রায়শঃ এদের ছাড়িয়ে আনেন। এবারও কি তাই হবে। নাকি ফিলিস্তিনের জন্য আরও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে এটাই এখন বিশ্ববাসীর দেখার বিষয়।
ইসরাইল সর্বশেষ ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’ নাম দিয়ে গাজাঁ ধংসের অভিযান শুরু করেছিল ২০১৪ সালের দিকে। এ নাম দিয়ে মাসব্যাপি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তারা। ইসরাইলীদের ভাষায়, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘হামাস’ কে শেষ করার জন্য তাদের অভিযান। চিরতরে হামাসকে নির্মূল করাই তাদেও লক্ষ্য। ইসরাইল তাদের মিত্র সাম্রাজ্যবাদি শক্তিদের একথা বুঝিয়ে হামলার পর হামলার অব্যাহত রেখেছে। নীরব দর্শকের মতোন চেয়ে ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে সব দেশ কথা বলার কথা তারাও নীরব ছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও উন্নত রাষ্ট্রগুলো তো বটে, অবাক করার মতো বিষয় হলো আরব রাষ্ট্রগুলোরও সমর্থন নাকি ইসরাইলের পক্ষে! এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। মূখে কুলুপ এটে বসে আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ইসরাইল যে চরম প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত সবাই। কোন দেশ কথা বলছে না। বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইল নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দেখেও না দেখার ভান করে আছে। এমন কি মুসলিম দেশগুলোও!
৬,২২০ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। বছরের পর বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে তারা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। পাশেই রয়েছে ২২ হাজার বর্গকিলোমিটারের আরেক ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। ভুখন্ড দখল বেদখল জনিত সমস্যা নতুন কিছু নয়। ইসরাইল কোনভাবেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মেনে নিতে পারছে না। বছরের পর বছর ধরে চলছে ইসরাইলের থাবা। ফিলিস্তিনদের গাজাঁ পরিপূর্ণভাবে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রনে নেবার জন্য গত ৫০ বছরে ডজন খানেক বড় ধরনের লড়াই হয়েছে। ইসরাইলের শক্তি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো। আরব রাষ্ট্রগুলো পাশে ছিল ফিলিস্তিনিদের। কিন্ত ২০১৪ সালের পর থেকে পাল্টাতে থাকে অনেক কিছু। ‘হামাস’ কে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে ইসরাইল-আমেরিকাসহ আরব রাষ্ট্রগুলোও! ফলে হামাসকে ধংস করতে হবে যে কোন মূল্যে। তাই বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সমর্থন নিয়ে গাজাঁ ধংসের কাজে নেমে পড়ে ইসরাইল। প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’। এবার হয়ত চুড়ান্ত বিজয় হবে ইসরাইলের। আসলে কি হামাস ধংসই তাদের লক্ষ্য। নাকি গাজাঁ দখল? এ প্রশ্ন এখন ঘুরে ফিরে আসছে। নির্বিচারে বোমা হামলা করে গাজাঁকে ফিলিস্তিনবাসী শূন্য করার মিশন শুরু হয়ে গেছে। হামাস ধংসের নামে গাজাঁর নিয়ন্ত্রন নেয়াই ইসরাইলের এখন প্রধান লক্ষ্য।
ইহুদী-মুসলিম দ্বন্দ্ব বহু বছরের পুরানো। কি করে এক জায়গায় দু’জাতি এলো তা নিয়ে রহস্যের বেড়াজাল তো রয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, ইসরাইল উড়ে এসে জুড়ে বসে গেল। তাদের পেছনের শক্তিরাই আরব বিশ্বে এমন একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঢুকিয়ে দিলো।
১৯৪৭ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিন আরব বিশ্বের এ অঞ্চলের মানুষগুলো শুনতে পেলো, যুগ যুগ ধরে বাস করা ফিলিস্তিন জাতি উচ্ছেদ হবে। কারন জাতিসংঘের ব্যবস্থা মতে, ভাগাভাগি হয়ে গেছে মাটি। তেলাআবিব থেকে হাইফা নেবে ইহুদিরা। এখানে ছিল বৃটিশদের আর ফিলিস্তিনিদের রাজত্ব। অপরদিকে ওয়েষ্টব্যাংক, গাজাঁ, গালিলি হবে ফিলিস্তিনিদের। মাঝখানে জেরুজালেম থাকবে আর্ন্তজাতিক শাসকদের হাতে। ১৯৪৮ সালের ১৪মে বৃটিশরা পাততাড়ি গুটায়। ঘোষিত হয় নতুন দেশ ‘ইসরাইল’। আর ইসরাইলের জম্মের সাথে সাথে জ্বলে উঠে লড়াই। হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে অস্ত্র। শুরু হয়ে মাতৃভুমি রক্ষার সংগ্রাম। কিন্ত যুদ্ধে আর জেতা হয় না।
ইসরাইল নামক দানবটি দখল করতে শুরু করে একের পর এক ভুখন্ড। আরব বিশ্বও থেমে থাকে না। জর্ডান, মিশর, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, সৌদিআরব, ফিলিস্তিন সবাই এক সাথে ভুমি দখলের প্রতিযোগিতায় নামে। যারা ফিলিস্তিনিদের লোক বলে পরিচিত সেই জর্ডান নিয়ে গেল ওয়েষ্ট ব্যাংক, মিশর নিয়ে নিল গাজাঁ।’ এভাবে চলছিল ইতিহাস। ৪৮ এ আরব-ইসরাইল লড়াই এর পর বিভিন্ন দেশের কোণে কোণে গড়ে উঠছিল ফিলিস্তিনিদের বসতি। নীরবে গড়ে উঠে বিভিন্ন শিবির। সে সব শিবির থেকেই আক্রমন শানিত হতে থাকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে।
১৯৬৪ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের এর নেতৃত্বে তৈরি হয় আরব লীগ। আর এই আরব লীগের ছাতার তলায় জন্ম নেয় ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)’। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল হানা দেয় মিশরের উপর। কিন্ত জর্ডান-মিশর মিলেও ইসরাইলকে পরাজিত করতে পারেনি। মূলত জর্ডান-মিশরের পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে পিএলও নিজেদের অল্পসংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে আরব লীগের ছাতা থেকে বেরিয়ে আসে। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকে পিএলও। ইয়াসির আরাফাতের উত্তানকে স্বাভাবিকভাবে নেয় নি অনেক আরব দেশ। ১৯৭০ সালে ফিলিস্তিনি গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমন চালায় জর্ডান। ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ক্রেকডাউন’ নামে জর্ডানের আক্রমনে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। জর্ডানের এ কাজে খুশি হয় ইসরাইল। ফিলিস্তিনিরা এতদিন মনে করেছিল, ইসরাইল বুঝি তাদের একমাত্র শক্র। কিন্ত জর্ডানও তাদের ছাড় দেবার পাত্র নয়। জর্ডানের পর ইসরাইল আর বসে থাকে না।
১৯৮২ সালে লেবানন আক্রমন বুঝিয়ে দিল তারা ওত পেতে আছে সব সময়। ইসরাইলের পেছনে আমেরিকানদের সমর্থন প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে। এ সময় আরাফাতকে ধরার জন্য ইসরাইল যখন মরিয়া, তখন আলজেরিয়ায় বসে ১৯৮৮ সালে ‘ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং জেরুজালেম তার রাজধানী’ বলে ঘোষণা দেয় পিএলও। ১৯৮৯ সালে আরাফাতকেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সেই থেকে ফিলিস্তিনিদের যাত্রা শুরু। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনিদের পাশে এসে দাড়ালো।
১৯৯৩ সালে আমেরিকা, ইসরাইল ও নরওয়ের সাথে পিএলও’র বৈঠকে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো ফিলিস্তিনিদেও বড় একটি অংশ। ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আরাফাতের ‘অসলো চুক্তি’ মেনে নেয়া তার জন্য কাল হয়ে দাড়ালো। ইসরাইলের কাছে এ রকম আত্মসমর্পন মেনে নিতে পারেনি গেরিলাদের বড় অংশ। ১৯৯৪ সালে জন্ম নিল ‘হরকাত আল মুকাওয়াম্মাহ আল ইসলামিয়া (হামাস)’। তারা শপথ নিল, ইসরাইলকে জঙ্গি পথেই ক্রমে ক্রমে মারা হবে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি আত্মঘাতি হওয়ার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের কাছে নাম লেখাতে থাকলো। আর ইসরাইলে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো মানব বোমার ভীতি। হামাসের জন্মের পরও দীর্ঘদিন আরাফাতের কারনে বড় ধরনের যুদ্ধ ইসরাইল করেনি। আরাফাতের মৃত্যুও পর ‘হামাস’এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ভীতি বাড়ে ইসরাইলেও। ২০০৮, ২০০৯, ২০১২ সালে ইসরাইল গাজাঁ হামলা চালায়। ২০১৪ সালে এসে বড় ধরনের হামলা শুরু করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে হামাস দিল মরণ কামড়। বলা হচ্ছে, অনেক বছর ধরে গোপনে তারা ইসরাইলে বড় ধরনের হামলার প্রস্ততি নিচ্ছিল।
প্রায় ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তনীদের মূখ্য প্রশ্ন ইসরাইল কেন গাজাঁর বিপুল ভুখন্ড দখল করে আছে। ওয়েস্ট ব্যাংক, গাজাঁ, পূর্ব জেরুজালেম, গোলান হাইটসে ইসরাইলের নুন্যতম অধিকার নেই। গাজাঁ দীর্ঘসময় ধরে ইসরাইলী সেনাবাহিনী দ্বারা অধিকৃত ছিল। স্বাধীন ফিলিস্তিন হবার পর তাদেও ভুখন্ড ছেড়ে দিতে হবে। কিন্ত ইসরাইল যে কোন মূল্যে গাজাঁ দখলে রাখতে মরিয়া। তারা চাইছে গাজাঁ ফিলিস্তিন শূন্য করে পুরোটা দখল করা। তাই ১৫০০ বিমান নিয়ে গাজাঁ দখলে মরিয়া ইসরাইল ২০১৪ সালে বড় ধরনের হামলা চালায়। গাজাঁয় ইসরাইলের মৃত্যুর হোলিখেলা চলে। এ সময় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। গাজার হাসপাতালগুলোতে বিশ্ব দেখেছে লাশের সারি । কোল্ড স্টোরেজে যেখানে খাদ্য দ্রব্য রাখার কথা সেখানে ছিল লাশের স্তুপ। জাতিসংঘের রির্পোট অনুযায়ী এ সময় ইসরাইলি বাহিনীর কাছে মারা যাওয়াদের ২৯ শতাংশই ছিল শিশু। স্কুলে আশ্রয় নিয়েও রক্ষা পায়নি নিরীহ মানুষ। হামলা হয়েছে সেখানেও। এবারও তার ব্যাতিক্রম হবে না।
গাজাঁয় শুধু হামলা নয় নেই বিদ্যুত, জল শোধন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। হাসপাতালে লোডশেডিং শুরু হয়ে গেছে। চরম বিপর্যয়ে অসহায় মানুষ পরিত্রানের উপায় খুজে পাচ্ছে না। ইসরাইল চরমভাবে হামলা চালাচ্ছে। ইসরাইল যে গাজায় যুদ্ধাপরাধ করে চলেছে তা বিশ্বের পরাশক্তিরা দেখেও দেখছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শিবির ইসরাইলকে আড়াল করতে তৎপর। অনেকে মুখে ইসরাইলের নিন্দা করলেও প্রকৃতপক্ষে ইহুদীদের সম্প্রসারন নীতির সমর্থক তারা। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে বেশ কয়েক বছর ধরে ইসরাইলের দহরম-মহরম ছিল নজরে পড়ার মতো। এবার মনে হয়, ফিলিস্তিনি মানুষের রক্তের সাগরের উপর দিয়ে গাজা দখল করে নেবে ইসরাইল।##