--- বিজ্ঞাপন ---

আমার দাদা রাজাকার কেমনে হলো…মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ফারাজ করিমের

0

চট্টগ্রামের রাউজানের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিমের বাবা ফজলুল কবির চৌধুরীর নামও রাজাকারদের তালিকায় তোলা হলো !!এ নাম দেখে হতাশ চট্টগ্রামবাসী। প্রশ্ন উঠেছে কেন এবং কার ইঙ্গিতে এ কাজটি হয়েছে। যুদ্ধের সময় যিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসরদের হাত থেকে যিনি রক্ষা করেছেন অসংখ্য মানুষকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি বিভিন্নভাবে কুটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন। তিনিই কিনা রাজাকার!! তালিকায় নামটি দেখে রাউজানের মানুষ ক্ষুদ্ধ। রাউজানের সংসদ সদস্য ফজলে করিমের পুত্র ফারাজ করিম চৌধুরী নিজের দাদার নাম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘোষিত রাজাকারের তালিকায় দেখে ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন

ফারাজ করিম চৌধুরী লিখেছেন-

একেএম. ফজলুল কবির চৌধুরী ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। যদি এককথায় শুনতে চান তাহলে তাকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেই আমি ব্যক্তিগতভাবে গর্ব করি। তবে পেশায় ছিল একজন রাজনীতিবিদ যিনি ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তাকে নিয়ে আমি গর্ব করি তার পদ পদবির জন্য অথবা তার ভিআইপি স্ট্যাটাসের জন্য নয়। বরং তার ভিআইপি স্ট্যাটাস যাদের দ্বারা অর্জিত সেই ভিআইপির (পি) অর্থাৎ (পারসন) বা যদি বলি পিপল, যে জনগণের পক্ষে তার সীমাহীন ভালোবাসার জন্য। পার্লামেন্টের পুরনো বইগুলো যদি আপনারা দেখেন, তবে আপনারা অনেক কিছুই জানতে পারবেন। ১৯৬২’র দিকে যখন বাংলাদেশ ছিল না, সে সময় পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থ ও বাঙালিদের পক্ষে দাবি আদায়ে সংসদে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন এ.কে.এম. ফজলুল কবির চৌধুরী।

তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রায় সময় চাপ প্রয়োগ করতেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় তিনি যে আওয়াজ তুলেছিলেন তাও এখানে প্রতীয়মান। আজ আপনারা দেখতে পান চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম নাইট কলেজ, চট্টগ্রাম মহিলা কলেজ এবং চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যেগুলোর প্রতিটার প্রতিষ্ঠার মধ্যে তার এবং চট্টগ্রামের আরো কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্বের অবদান রয়েছে। যদি প্রমাণ চান আমি তা তুলে ধরতে পারবো। জনাব চৌধুরী একক প্রচেষ্টায় ১৯৬৩ সালে রাউজান কলেজ এবং ১৯৬২ সালে রাউজানের গহিরায় শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী বেলজিয়ামের ডমিনিক পীয়ের অনুদানে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তির দ্বীপ।

ফজলুল কবির চৌধুরী, আলহাজ খান বাহাদুর আবদুল জব্বার চৌধুরীর ও মাতৃকুল মধ্যযুগীয় মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নেসার পৌত্রী বেগম ফাতেমা খাতুন চৌধুরীর ঔরশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা। প্রাদেশিক আইন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ছিলেন এবং দু’ দুবার সংসদ সদস্য ছিলেন। প্রথমে রাউজান রাঙ্গুনিয়া বোয়ালখালীর (১৯৬২) আর পরবর্তীতে রাউজান হাটহাজারীর (১৯৬৫)। কোন রাজনৈতিক দলও করতেন না, বরং স্বতন্ত্রভাবে অন্যান্য স্বতন্ত্র সদস্যদের একত্রিত করে বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি মুসলিম লীগের কেউ ছিলেন না। যেহেতু রাজনীতির সূত্রেই আজ আমার মরহুম দাদাকে তার মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাধিক বছর পর অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক পরিচয় আমাকে তুলে ধরতেই হলো।

বিজয়ের মাসে বিজয় দিবসের আগ মুহূর্তে, গত ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে রাউজান কলেজে আমি যাই যা অভিযুক্ত মরহুম এ.কে.এম ফজলুল কবির চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেছিল। সন্ধ্যা ৭টার দিকে রাউজান কলেজের শহীদ মিনারে খোলা আকাশের নিচে বসে আমরা আওয়ামী পরিবার ও ছাত্রলীগের ভাইয়েরাসহ একত্রে রাউজানের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ গল্পগাথা শুনছিলাম। রাউজানে তাদের সেই যুদ্ধের পুরনো স্মৃতিগুলি বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু জাফর সাহেব বলেন, আজকে আমাদের মাঝে যে বসে আছেন তার দাদা ফজলুল কবির চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ও আমার সহকর্মীদের ১৯৬৫ সালে ফাতেমা জিন্নাহ’র পক্ষে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন করায় জেল থেকে মুক্ত করে আনেন। সেসময় থেকে ফজলুল কবির চৌধুরী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুপ্রাণিত করতে থাকেন এবং বিভিন্নভাবে আমাদের সুযোগ-সুবিধা করে দিতেন।

যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখন খবর এলো আমার দাদা ফজলুল কবির চৌধুরী নাকি রাজাকার ছিলেন। এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় আমার দাদার নাম তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের পাথরঘাটায়। বাড়ির নাম ইকবাল ভিলা যা কিনা এই অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি হিসেবে পরিচিত। কথা বলতে গেলে অনেক কিছু চলে আসবে আর লিখতে গেলে এই বাড়ির অনেক ইতিহাস যা লিখে শেষ করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার দাদা এ.কে.এম ফজলুল কবির চৌধুরী পাথরঘাটার বাড়িতে অবস্থান করতেন।

তার দ্বিতীয় পুত্রের নাম ফজলে রাব্বি চৌধুরী, আমার বাবার বড় ভাই, আমার মেঝো চাচা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ২১। তাকে অনেকেই একজন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর বাঙালিদের পক্ষে অবস্থান করে নিরীহ বাঙালিদের রক্ষা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। নালাপাড়ার হাজি আবদুর রহিমকে চেনেন কেউ? চিনে থাকলে নিশ্চই জানবেন যে মেঝো চাচা ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ দিকে গান পাউডার নিয়ে টেরিবাজার মিঠা গলিতে গিয়েছিলেন। এবং পরে সেই গান পাউডার ফিরিঙ্গি বাজারের মনাকে দিয়েছিলেন। সেই মনা কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ৬ দফার ৬ তারা বিশিষ্ট পতাকা ও টুপি ব্যবহার করতেন বলে বর্তমান কাজির দেউরির পাশে অবস্থিত নেভাল একাডেমির ছাদ হতে আমার দাদার সেই ল্যান্ড ক্রুসার গাড়িটিকে (গাড়ি নং ৮১৪৭) লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে পাকিস্তানি আর্মি। সেসময় আমার চাচার সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন এ.কে. খানের আত্মীয় আব্দুল হামিদ।

সেই ল্যান্ড ক্রুসার গাড়ি ব্যবহার করে আমার চাচা ফজলে রাব্বি চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষকসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের তাদের নিজ বাসায় নিরাপদে নামিয়ে দিয়ে আসতেন। এই সকল ঘটনার সাক্ষী দেবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ জাহান খান রুশনীর ভাই জার্মান প্রবাসী রুমু। শুনেছি যুদ্ধের সময় চাচা একদিন চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকায় রিকশা নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ৪ জন নিরীহ বাঙালিকে ধরে পাকিস্তানি ৩ জন আর্মি ব্যাপক মারধর করছিল। সে সময় তিনি রিকশা থেকে নেমে পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং নিরীহ সেই বাঙালিদের উদ্ধার করেন। এর কিছুদিন পর চট্টগ্রাম শহর থেকে রাউজান যাওয়ার পথে কয়েকজন হিন্দুকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে যেতে দেখলে জনাব ফজলে রাব্বি চৌধুরী গাড়ি থেকে নেমে সেসব হিন্দুদের রক্ষা করে নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দেন।

বলী শামসুর নাম অনেকেই শুনেছেন, বিশেষ করে যারা তৎকালীন ইতিহাস সম্পর্কে অবগত আছেন। বলী শামসুও আমার চাচার সঙ্গে গাড়িতে থাকতেন। তার ভাই মাহবুবও গাড়িতে থাকতেন। তারা যুদ্ধকালীন আমার চাচার ভূমিকার সাক্ষী দেবেন যদি বেঁচে থেকে থাকেন। চাচার কথা বলার পেছনে কারণ আছে। চট্টগ্রামের মানুষ ভালো করে জানে যে আমাদের সেদিকে একটি সংস্কৃতি আছে। বাপ বিষ খেলে ছেলেও বিষ খেতে চায়। অর্থাৎ বাপ ছাড়া ছেলে এক পা দিতে অসঙ্গতি প্রকাশ করেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বীর বাঙালির মহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার আমার দাদাকে ৮ জন রাষ্ট্রীয় পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা প্রদান করতো। যেহেতু আমার দাদার আপন ছোট ভাইয়ের নাম ফজলুল কাদের চৌধুরী এর রেশ ধরে পরিবারের অন্য কারো যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্সসহ বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করেন তখনকার সরকার। এই কথার প্রমাণ ও সাক্ষী দু’টি আছে। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সন্তান সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলে মুক্তিযুদ্ধের সময় জনাব এ.কে.এম. ফজলুল কবির চৌধুরীর ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারবেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং এর আগে থেকেই পাকিস্তান সরকারের বাঙালিদের প্রতি নিপীড়ন ও শোষণমূলক আচরণের প্রতি ইংগিত করে এ.কে.এম. ফজলুল কবির চৌধুরী বলতেন, ‘শুধু বন্দুকের নল দিয়ে দেশ শাসন করা যায় না, পাকিস্তানের নিষ্ঠুরতম আচরণের জন্য একদিন কঠিন মাশুল দিতে হবে।’ তিনি পাকিস্তান সরকারের অন্যায়-শোষণকে কখনো মেনে নিতে পারেননি।বাঙালিদের সবসময় তিনি সহযোগিতা করতেন। সেই সময় শ্রী শ্রী বর্মণ নামে একজন হিন্দু ব্যক্তিকে তিনি পাথরঘাটার বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। যিনি একটি ব্যাংকে চাকরি করতেন।

তবে কি মন্ত্রণালয়ের গেজেটেড ভাতা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার ছিল কারণ তার মেয়ে অন্য রাজনৈতিক দল করে বলে? তবে কি যে ট্রাইব্যুনাল দ্বারা যুদ্ধ অপরাধের বিচার করলেন, সেই ট্রাইব্যূনালের কৌঁসুলি রাজাকার ছিল? তবে কি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই মঞ্চে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা, মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মুজিবুল হক ও রাজাকার ছিল? তবে কি বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইও রাজাকার ছিল? উত্তর দিবেন কি মাননীয় মন্ত্রী? ### ১৭.১২.১৯

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.